রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মিলাডা।

কেমন লাগছে বলুন তো সরস্বতীর লীলাকমল? উনিশ বিশ শতকের পর্দানশীন মেয়েদের লেখক হওয়ার গল্প তো চলছে। আজ বলি ভারতীয় স্বামীকে বিয়ে করে আসা বিদেশিনী এক বধূর কলমের কথা। তাঁর চোখ দিয়ে ভারতবর্ষকে দেখার সুযোগ নেহাত কম কথা নয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি সদস্যই প্রতিভার হিরকদ্যুতি। দেশে বিদেশে তাঁরা স্বমহিমায় আকৃষ্ট করতেন সকলকে।

চেকোস্লোভাকিয়ার মেয়ে মিলাডা সেই ভাবেই মুগ্ধ হয়েছিলেন তরুণ ভারতীয় ছাত্র মোহনলালের সঙ্গে আলাপ করে। পৃথিবীর দুই ভিন্ন দেশের মানুষকে সেদিন কিন্তু একসূত্রে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঘটনাটা সত্যি হলেও গল্পের মতোই আকর্ষক। গল্পের শিকড়ে প্রবেশ করার আগে মোহনলালের পরিচয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি ছিলেন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথের অকালমৃতা মেয়ে করুণার সন্তান। করুণা তিনটি শিশুসন্তান রেখে চিরঘুমের দেশে চলে যান। তখন তাঁরা জোড়াসাঁকোর বৈঠকখানা বাড়িতেই এসে থাকতেন।
করুণার তিন সন্তান বড় হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথের বড় ছেলে অলকেন্দ্রের স্ত্রী পারুলের স্নেহছায়ায়। অবনঠাকুরের খেয়ালিপনা, তাঁর চিত্রশিল্প,রবীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক চর্চা, মায়ের স্মৃতি—এই সবকিছুই মোহনলালের ব্যক্তিত্বকে তৈরি করেছিল। নিজে ছিলেন পরিসংখ্যানবিদ। পরে ‘দক্ষিণের বারান্দা’ লিখেছিলেন, জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়ির উত্থান পতনের গল্প। আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে কিন্তু মোহনলাল নয়, থাকবেন তাঁর স্ত্রী মিলাডা। কোনও এক শীতের সন্ধ্যায় গান শুনতে এসে চেকোস্লোভাকিয়াবাসী এক তরুণী ভারতীয় এক তরুণকে দেখে আলাপ জমালো।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩২: সংজ্ঞা দেবী—ঠাকুরবাড়ির লেখক ও মৌনী সাধক

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?

দু’জনের মধ্যে অদৃশ্য সেতুর মতো ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘দি গার্ডেনার’ এবং ‘গীতাঞ্জলি’র চেক অনুবাদ পড়েছিলেন মিলাডা। পড়ে মু্গ্ধ হয়েছিলেন। কথায় কথায় জানতে পারলেন মোহনলাল তাঁর প্রিয় কবির আত্মীয়, মিলাডা মুগ্ধ হলেন। তারপর দুই ভিনদেশীর বন্ধুত্ব গড়ালো প্রেমের সংজ্ঞার দিকে। পরিচিতরা বাধা দিয়েছিলেন। আসলে মিলাডা আদৌ ভারতীয় পরিবারের যথাযথ অংশ হয়ে উঠতে পারবেন কি না, এই নিয়ে সকলের মনেই মেঘ জমছিল। কিন্তু অন্তরের টান কি উপেক্ষা করা অত সহজ? তাই গোপনেই বিয়েটা সারলেন তাঁরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কাজটা সহজ ছিল না। চেকোস্লোভাকিয়ার উপর ঘনিয়ে আসতে পারে জার্মানির আক্রমণ।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

মোহনলাল দেশে ফিরে আসার আগে মিলাডাকে লন্ডনেই ফিরে আসতে বলেছিলেন। ভারতে যাওয়ার জন্য ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর অদর্শনে মায়ের শারীরিক অসুস্থতার কথা জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। কিন্তু বিধাতার আশ্চর্য খেলায় ১৯৩৯ সালের পর মা ও মেয়ের আর দেখা হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল অভিঘাতে ঠাকুরবাড়ির এই বিদেশিনী বধূটি নিজের শিকড় ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছিলেন। স্বদেশ থেকে ফেরার পথে তিনি ছিলেন একলা। যুদ্ধের কারণে যান চলাচল বিপর্যস্ত। তবু রবি ঠাকুরের দেশে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁর স্বামী মোহনলাল। সব বাধা উপেক্ষা করে কালো কাঁচে ঢাকা জাহাজে করে কলকাতায় পৌঁছলেন মিলাডা। বোম্বে শহরে মোহনলালের দেওয়া উপহার গিয়ে পৌঁছয় তাঁর কাছে। বাঙালি মেয়েদের তখনকার দিনের সাজপোশাক —শাড়ি! জাহাজের এক মহিলার সাহায্য নিয়ে সেই শাড়ি পরেই ভারতে পৌঁছলেন মিলাডা। হাতে পেলেন পদ্মগুচ্ছ, শঙ্খ বাজিয়ে অভ্যর্থনা করেছিল ঠাকুরবাড়ি।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

অবনীন্দ্রনাথ ছবি আঁকছিলেন সাধকের মতো। সেইসময় যেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো বলেছিলেন মিলাডার অভিভাবকদের সঙ্গে তাঁর চিরবিচ্ছেদের কথা। শান্তিনিকেতনে গিয়ে হাতের কাজ শিখলেন। প্রথমে সাঁওতালদের নিয়ে কাজ শুরু করলেও পরে মণিপুরী এক রাজকন্যার সাহায্যে নাগাল্যান্ড গিয়েছিলেন মিলাডা। সেখানে নিবিসা চাসি নামে এক নাগা তরুণ মিলাডাকে নাগা সমাজের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে সাহায্য করেন। চেক ভাষায় নাগাদের নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন মিলাডা। এরপর জীবনের বিভিন্ন সময় লিখেছিলেন দুটি ইংরেজি বই—‘আ পিলগ্রিমেজ টু দ্য নাগাজ’, এবং ‘নাগা আর্ট’। দুর্লভ ছবিও রয়েছে বইদুটিতেই। চেক, বাংলা ইংরেজি —এই তিনভাষাতেই সমান দক্ষ ছিলেন। তিনভাষাতেই বই লিখেছেন। রূপকথা সংগ্রহ করেছেন, মোহনলালের সঙ্গে যৌথ অনুবাদের কাজও করেছেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

জীবনে প্রতিটি মানুষের কাজ নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। দৈবনির্দিষ্ট। না হলে সুদূর চোকোস্লোভাকিয়ার একটি অচেনা মেয়ে কেমন করে ঠাকুরবাড়ির যথার্থ বধূ হয়ে উঠবেন কেমন করে? বিদেশিনী হয়েও তাঁর কাজের ঝোঁক। ছিল ভারতের লোকজ সম্পদের উপর।

ঠাকুরবাড়ির যথাযথ পুত্রবধূ হয়ে ওঠার পথ এবং লড়াইটি কত দীর্ঘ ছিল জানা নেই, কিন্তু মিলাডা ঠাকুরবাড়ির আদর্শ সদস্য। শুধু বৈবাহিক সম্পর্ক সূত্রে নয়, বিপুল কর্মযজ্ঞের এক ঋত্বিক রূপেও। কত মেয়ের মনেই তো ব্যথার পাহাড় থাকে। দেশ বিদেশের আঙিনা ছাড়িয়ে সে বেদনা যখন কলমের স্পর্শডগায় আসে তখন তার রূপ হয় অন্যরকম। মিলাডার কথাও সেই অন্য তাৎপর্যে এসেছে তাঁর লেখায়। সরস্বতীর লীলাকমল কিন্তু পৃথিবী ছুঁয়ে ছিল, আছে থাকবে।

ঋণ
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
দক্ষিণের বারান্দা, মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content