মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


জ্ঞানদানন্দিনী।

সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে লেখা চলছে, উনিশ শতকের মেয়েদের বিদ্যাচর্চার প্রসঙ্গ আসবে, অথচ জ্ঞানদানন্দিনীর প্রসঙ্গ আসবে না— এ হতে পারে না। উনিশ শতকের আধুনিক মনের মহিলাদের অগ্রদূত ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। মেয়েদের অন্দরমহল থেকে বাহির মহলে নিয়ে আসার জন্য তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। উনিশ শতকে বাঙালি মেয়েদের জীবন ছিল খাঁচায় বন্দি পাখিদের মতো। বাইরের পৃথিবীতে রেনেসাঁর আলো, অথচ বাঙালির অন্দরমহল তখনও আঁধারে। উনিশ শতকের মেয়েদের লেখা চিঠিপত্রেও রয়ে যায় মনকেমনের সুর—‘ধন্য পুরুষজাতিকে। স্ত্রীলোকের ন্যায় যদ্যপি পুরুষের এককণা যন্ত্রণা হইত তাহা হইলে প্রণয়ে কি সুখ হইত!’

আসলে পিঞ্জরমুক্ত হওয়ার ইচ্ছেটা তৈরি হচ্ছিল বাঙালি অন্দরমহলের আনাচকানাচে। বাঙালির সামাজিক জাগরণ পর্বে দুটি পরিবারের উল্লেখ করতেই হয়। একটি কাঁটালপাড়ার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার আর অন্যটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। অথচ বঙ্কিমের ছোটমেয়ে উৎপলকুমারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছিলেন। বঙ্কিমের বড় মেয়ে শরৎকুমারীর বিধবা পুত্রবধূ কমলার দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে মামলা হয়েছিল। এর পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও গঙ্গাস্নান করতে যেতেন যখন, তাঁদের পালকিশুদ্ধ জলে ডুবিয়ে আনা হত।
রবীন্দ্রনাথের মা সারদাদেবীকে দেবেন্দ্রনাথের পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করে নিয়ে আসা হয়, তাঁর মায়ের অমতে। সেই খবর পেয়ে সারদাদেবীর মা, মেয়ের বিচ্ছেদে কেঁদে কেঁদে মারা গিয়েছিলেন। এইসব ঘটনাকে উনিশ শতক তুচ্ছই মনে করত বোধহয়! সেই সময় মেয়েরা প্রতিবাদ করতে বা সাহসী পদক্ষেপ নিতে জানত না। সেই সময়কার এক অন্যরকম মেয়ের গল্প বলি আজ। বাঙালি মেয়েদের ‘আধুনিক’ করে তোলার অন্তরালে তাঁর ভূমিকা অসীম। আজকের কথকতা আবর্তিত হোক সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে ঘিরে।

যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। বাবা নরেন্দ্রনাথ ও মা নিস্তারিণী দেবী দু’জনেরই ছিল লেখাপড়ায় উৎসাহ। নরেন্দ্রনাথ বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠশালা খুলেছিলেন। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে দিব্যি লেখাপড়া করতেন জ্ঞানদানন্দিনী। নিস্তারিণী দেবী গভীর রাতে লুকিয়ে লেখাপড়া করতেন। জ্ঞানদানন্দিনীর মগ্নচেতনে রয়ে গিয়েছে সেই স্মৃতি। ছেলেবেলায় বড় আদরের ছিলেন জ্ঞানদা। সকালে প্রথমে উঠেই খেতেন আনালে ভাত, দুপুরবেলা ভাতের সঙ্গে কতরকমের শাক তরকারি, টাটকা মাছের ঝোল,কচ্ছপের ডিমের বড়া কিংবা কচ্ছপের মাংসের ঝোল। বিকেলে ঘরের সরবসানো দুধ, গরম গরম মুড়কি, রাতে মাছের ঝোল ভাত, কোনও কোনও দিন পাঁঠার ঝোল। অভিজাত পরিবারের বৌ হওয়ার পরেও ছেলেবেলার সেই আদর ও যত্নের কথা বারবার স্মরণ করেছেন জ্ঞানদানন্দিনী।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৭: মোক্ষদায়িনী— প্রথম মহিলা সম্পাদক

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

ছোটবেলায় নতুন কাপড় পরার আগে কাপড়ের একদিক থেকে সুতো বার করে নিয়ে সেটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ‘কাঁটা নাও’, ‘খোঁচা নাও’, ‘আগুন নাও’—এই বলে নাকি কাপড় অনিষ্টকারী সব জিনিসকে এক এক টুকরো দিয়ে পরতেন। পরে এই জ্ঞানদানন্দিনীই বাঙালি মেয়েদের শাড়ি পরার নতুন ধরণ তৈরি করবেন। মাত্র সাত বছর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে হয় জ্ঞানদানন্দিনীর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসিক উদারতা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল জ্ঞানদানন্দিনীর জীবনে। সত্যেন্দ্রনাথের বৈপ্লবিক ভাবনাচিন্তা জ্ঞানদানন্দিনীকেও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করেছিল। গভীর রাতে বন্ধু মনোমোহন ঘোষকে অন্দরমহলে মশারির মধ্যে নিয়ে এসে বৌয়ের সঙ্গে আলাপ করানোর মতো ঘটনা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরই ঘটিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

জ্ঞানদানন্দিনীর জীবন শুরু হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের আর পাঁচজন মেয়েদের মতো করেই। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের বিলেতযাত্রা এবং মহর্ষির কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে জ্ঞানদানন্দিনীর বোম্বাই যাত্রার মতো ঘটনা তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সত্যেন্দ্রনাথ ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে স্ত্রীর জন্য ওরিয়েন্টাল পোশাক তৈরি করিয়েছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর বম্বাই যাত্রার দিন ঠাকুরবাড়িতে প্রবল শোকপালন হয়েছিল। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দাসদাসীরাও প্রবল কান্নাকাটি শুরু করেছিল। আসলে এমন ঘটনা আগে তো কখনও ঘটেনি। পরিবর্তনের এই পথ জ্ঞানদানন্দিনীর জন্যও খুব কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ঘেরাটোপ দেওয়া পালকি চড়ে জাহাজে ওঠা, পার্সি পরিবারে থাকা, লাটসাহেবের সঙ্গে কথা না বলতে পারার অস্বস্তি—সবটাই অতিক্রম করতে হয়েছিল তাঁকে। লজ্জায় কারও সঙ্গে কথা বলতেন না বলে তাঁকে ‘মুগী মাসি’ অর্থাৎ বোবা বলা হত। ধীরে ধীরে জ্ঞানদানন্দিনী অদ্ভুত পোশাক ছেড়ে নিজের মতো করে শাড়ি পরা শুরু করলেন জ্ঞানদানন্দিনী। পার্শিরা ডানদিকে আঁচল দিতেন, জ্ঞানদানন্দিনী বাঁদিকে আঁচল দিলেন। শুরু হল বাঙালি মেয়েদের নিজস্ব শাড়ি পরার ঘরানা। প্রবাসে সত্যেন্দ্রনাথ বেশিরভাগ জায়গায় জ্ঞানদানন্দিনীকে নিয়েই ঘুরেছেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁকে জীবনের প্রতি নতুনরকম দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৭: মূর্খকে উপদেশ দিলে সেটা তার রাগের কারণ হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

ইন্দিরাদেবী আর সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও জ্ঞানদানন্দিনীর কবীন্দ্র নামের এক পুত্রসন্তান হয়। কিন্তু বছর দুই বয়সে সে সন্তান মারা যায়। জ্ঞানদানন্দিনী এই তিন সন্তানকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিলেতযাত্রা করেছিলেন। বাঙালি মেয়েদের কাছে এই ঘটনা বেশ সাহসিকতার। তবে বিলেতে পৌঁছে যে সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী, সেও বাঁচেনি। পুত্র কন্যার জন্য কাতর ভাব জ্ঞানদানন্দিনীর সারাজীবন ছিল। তবে ব্যক্তিগত শোক তাঁর বৃহত্তর কর্মযজ্ঞের পথে অন্তরায় হয়নি কখনও। কলকাতায় ফিরে তাঁরা থাকতেন লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের নিত্য আনাগোনা ছিল সে বাড়িতে।

রবীন্দ্রনাথ, মৃণালিনীও খুব স্নেহ পেয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনীর কাছ থেকে। মৃণালিনীদেবীর মৃত্যুর পর মাতৃহারা সন্তানদের জ্ঞানদানন্দিনীর কাছেই রেখে নিশ্চিন্ত থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর উন্মাদ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রফুল্লময়ীর মনখারাপের মুহূর্তে জ্ঞানদানন্দিনী তাঁকে কাছে ডেকে মায়ের মতো করে বোঝাতেন। পরিবারের প্রত্যেকের প্রতি জ্ঞানদানন্দিনীর খেয়াল ছিল। অবনীনন্দ্রনাথের, প্রতিমা দেবীর ছবি আঁকা,জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের লেখালিখি—সব বিষয়েই খুব উৎসাহ ছিল তাঁর।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

এ প্রসঙ্গে একটি মজার কথা মনে পড়ে। অনেকদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক লেখেননি। জ্ঞানদানন্দিনী তাঁকে একটা ঘরে কাগজ কলম দিয়ে আটকে দিলেন। বাইরে পাহারায় বসল তারকনাথ পালিতের মেয়ে। বাধ্য হয়ে লেখা হল নাটক—‘হিতে বিপরীত’!জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পাদনায় ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশিত হল। বাড়ির ছোটদের সঙ্গেই অনেক লেখা লিখলেন রবীন্দ্রনাথও। নতুন নতুন ভাবনা ও তার রূপায়ণ—জ্ঞানদানন্দিনী অনবরত এই কাজ করে গিয়েছেন। ঠাকুরবাড়ির অনেক মেয়েদের ছবি তাঁর উদ্যোগেই তোলা হয়েছিল। ফটোগ্রাফিচর্চাতেও খুব উৎসাহ ছিল জ্ঞানদানন্দিনীর। বোর্ন শেপার্ডের কাছে ছবি তুলতে শিখেছিলেন এবং অন্দরমহলের মহিলাদের ছবিও তুলে দিয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়িতে জন্মদিন পালনের রেওয়াজও তিনিই শুরু করান। নাটক অভিনয়েও খুব উৎসাহ ছিল তাঁর। ছোটদের নিয়ে লিখেছেন এবং ভেবেছেন। ছোটদের ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতে জ্ঞানদানন্দিনী লিথো প্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই প্রেসের খরচা নিজেই বহন করতেন তিনি।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভারতীতে কিন্টারগার্টেন ও স্ত্রীশিক্ষা নামে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘ভাউ সাহেবের খবর’ নামে মারাঠি লেখার অনুবাদ করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। ইংরেজ নিন্দা আর স্বদেশী অনুবাদ নামের প্রবন্ধও লিখেছিলেন তিনি। সাত ভাই চম্পা আর টাক ডুমাডুম ডুম নামের দুটি গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। জ্ঞানদানন্দিনী সেইসময়কার একজন সমাজসংস্কারক এবং বলিষ্ঠ লেখক।

সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর অনেক বছর বেঁচেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। কিন্তু যে আশ্চর্য মানসিক জোর পেয়েজিলেন সত্যেন্দ্রনাথের থেকে তাকে শক্তি করে রেখেছিলেন মনের গহনে। উনিশ শতকের এক অভিজাত পুরুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর স্ত্রী বাঙালি নারীদের আদর্শ হয়ে উঠবেন। সেই পুরুষ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর! তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী নিজের জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে সেই সত্যেন্দ্রনাথের এই স্বপ্নকে সত্যি করে তুলেছিলেন।

তথ্যসূত্র:
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী রচনা সংকলন, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (সম্পা), দেজ পাবলিকেশন।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content