মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঠাকুরবাড়ির সকলেই যে ভ্রমণ-প্রিয় ছিলেন, তা নয়। অবনীন্দ্রনাথ তো দূরে কোথাও যানইনি। তবু জীবদ্দশাতেই তাঁর খ্যাতি সাগরপারে পৌঁছে গিয়েছিল। শিল্পগুরুকে ও দেশের শিল্পরসিক মানুষ চিনতেন। অবনীন্দ্রনাথ দেশে, দেশান্তরে যাওয়ার কথা ভাবেননি। ‘দক্ষিণের বারান্দা’য় মগ্ন থেকেছেন সৃষ্টিকর্মে। রবীন্দ্র-অগ্রজদের মধ্যে একমাত্র সত্যেন্দ্রনাথ দেশান্তরে গিয়েছেন। ঘটনাবহুল তাঁর বিলেত-বাস। থেকেছেন মুম্বাইতেও। পত্নীবিয়োগের পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচি-পাহাড়েই থাকতেন। ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ব্যতিক্রমী। ভ্রমণের স্পৃহা তাঁর মধ্যে সব সময় জেগে ছিল। তখন তেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। ভ্রমণযাত্রা যতই ঝকমারির হোক না কেন, তার মধ্যেই কবি আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন।
কবির পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বছরের অনেকখানিই ব্যস্ত থাকতেন পর্যটনে, দেশভ্রমণে। এই ভ্রমণ যে তাঁর জীবনের কতটা জুড়ে ছিল, সে সাক্ষ্য রয়েছে রবীন্দ্র-রচনায়। ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে, ‘আমার জন্মের কয়েক বৎসর পূর্ব হইতেই আমার পিতা দেশভ্রমণেই নিযুক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়; মাঝে মাঝে তিনি কখনো বাড়ি আসিতেন।’ রবীন্দ্রনাথের জীবনে পিতার প্রভাব নিঃসন্দেহে সর্বাধিক। প্রথম স্বীকৃতি পিতৃদেবই দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পিতাকে খুব কাছে, অন্তরঙ্গভাবে পেয়েছিলেন জীবনের প্রথম ভ্রমণে। পুত্রকে সঙ্গী করে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন অমৃতসর হয়ে ডালহৌসি। ভ্রমণের আনন্দে বালক রবীন্দ্রনাথ কতখানি আপ্লুত ও উজ্জীবিত হয়েছিলেন, সে বিবরণ আছে ‘জীবনস্মৃতি’তে। ভ্রমণের আনন্দ বারবার জীবনভর ফিরে পেতে চেয়েছিলেন কবি।
আরও পড়ুন:
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ৩য় খণ্ড, পর্ব-৪২: অরুণাভ অন্তর্ধান
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করার তাগিদেই ঘুরে বেড়িয়েছেন, তা নয়। নিসর্গ তাঁকে টানত। প্রকৃতি-প্রীতি কত গভীর ছিল, তা ভ্রমণকালের দৈনন্দিন ঘটনায় গোপন থাকেনি, স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মহর্ষির মধ্যে দার্শনিকতা ছিল, আবার বৈষয়িকতাও ছিল। পাশাপাশি ছিল ভ্রমণের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ, সেই নিমগ্নতায় কোনো খাদ ছিল না। পত্নী সারদাসুন্দরীর অসুস্থতা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছনোর পরও মাঝপথে ভ্রমণ সাঙ্গ করে দ্রুত তিনি ফিরে আসেননি। মহর্ষিদেব তখন ডালহৌসিতে। টেলিগ্ৰাম পেয়ে সরাসরি কলকাতায় না ফিরে সাধনভূমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। যখন জোড়াসাঁকোয় ফিরেছেন, তখন অবস্থা-পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সারদাসুন্দরী মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় আছে মহর্ষি যেদিন ফিরে এসেছিলেন, সেদিনের কথা। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘একদিন তো কর্তাদিদিমার অবস্থা খুবই খারাপ, বাড়ির সবাই ভাবলে আর বুঝি দেখা হল না কর্তাদাদামশায়ের সঙ্গে। অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, এমন সময় কর্তাদাদামশায় এসে উপস্থিত। খবর শুনে সোজা কর্তাদিদিমার ঘরে গিয়ে পাশে দাঁড়ালেন, কর্তাদিদিমা হাত বাড়িয়ে তাঁর পায়ের ধুলো মাথায় নিলেন। ব্যাস, আস্তে আস্তে সব শেষ।’
কেশবচন্দ্র সেন।
মহর্ষির ভ্রমণপথ নিষ্কণ্টক ছিল না। ঘটনার ঘনঘটায় ভরপুর। ঘটেছে নানা বিপর্যয়। এমনকি প্রিয়জনের মৃত্যুও। শোক-বিপর্যয়ে ভিতরে ভিতরে প্রবল বিচলিত হয়েছেন। সেই বিচলনের বহিঃপ্রকাশ অবশ্য সেভাবে তীব্র হয়ে ওঠেনি। তাঁর ভ্রমণপিপাসুসত্তাই স্পষ্ট ওঠে। তখন তিনি জীবনের অন্তিম কালে। প্রাণশক্তি একটুও কমেনি, ভ্রমণের টানে সব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করেছেন। কখনো সুউচ্চ পাহাড়ে, কখনো সমতলে। ঘর্ঘরা নদী পার হয়ে বাঁকিপুরে পৌঁছেছেন সবে। বজরা নিয়ে নদীপথে ভ্রমণ। যাবেন লখনউ। সহচর প্রিয়নাথ শাস্ত্রী আগে লখনউ পৌঁছে তাঁর জন্য বাড়ি ভাড়া করে রাখবেন, এমনই কথা। এই কাজটা প্রায়শই করে দিতেন সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। মহর্ষিদেবের কাছে আসা চিঠিগুলো সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন প্রিয়নাথ শাস্ত্রী। চিঠিগুলো প্রিয়নাথ দিতেই মহর্ষি হতবাক। একটি চিঠিতে ছিল সারদাপ্রসাদের মৃত্যু-সংবাদ। শোকস্তব্ধ মহর্ষি নিজেকে সামলে নিয়ে পরিস্থিতি হালকা করার জন্যেই সে মুহূর্তে বলেছিলেন,’সারদা আমার আগেই চলিয়া গেলে কেন জানো? তিনি আমার জন্য পরলোকে বাড়ি ঠিক করিতে গিয়াছেন।’
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৮: পালাবার কোনও পথ নেই
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?
শোকযন্ত্রণা হালকা করার তাগিদে এ কথা বললেও পরমুহূর্তে পরিচয় পাওয়া যায় মহর্ষির দায়িত্বসচেতনতার। সব কর্মসূচি তখুনি বাতিল করে দিয়েছিলেন তিনি। মনে মনে পাহাড়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। সেসব ভুলে তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে, ‘বাড়ির সকলে শোকাছন্ন। তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা দিবার জন্য একবার বাড়ি যাইব।’
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
মহর্ষির কন্যা সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদাপ্রসাদ ঠাকুরবাড়ির রীতি মেনে ঘরজামাই থাকতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের খুব বন্ধু ছিলেন তিনি, উৎসাহ ছিল নাটকে। ঠাকুরবাড়িতে নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মহর্ষি তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। চিন ভ্রমণেও নিয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের রাতে আকস্মিক সারদাপ্রসাদের মৃত্যু হয়, শিলাইদহে। জোড়াসাঁকোয় পরের দিন এসে পৌঁছোয় এই মৃত্যু সংবাদ। পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে বিবাহের আনন্দ-অনুষ্ঠান ম্লান হয়ে হয়ে গিয়েছিল।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সারদাপ্রসাদের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে শান্তিনিকেতন হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। তিনদিন পর বজরা নিয়ে তিনি আবারও বেরিয়ে পড়েছিলেন। সুদূরের আহ্বানে নয়, কাছাকাছি গঙ্গার ধারে নিশ্চিন্তে ক-দিন থাকবেন ভেবে নিয়েই ছিল সে জলযাত্রা। চুঁচুড়ায় গঙ্গাতীরে ওলন্দাজ আমলের তৈরি একটা দোতলা বাড়ি আগে থেকেই ঠিক করার ছিল। মহর্ষির সেই চুঁচুড়ায় বাসও ছিল বিঘ্নময়। পুনরায় শোকযন্ত্রণায় জেরবার হতে হয়েছে তাঁকে। ব্রাহ্ম-আন্দোলনের সঙ্গী কেশবচন্দ্র সেনের পরলোকগমনের সংবাদ পেয়েছিলেন। এই সময়ই আসে প্রিয় বন্ধু শ্রীকন্ঠ সিংহের মৃত্যু-সংবাদও। শোকের পর শোক। এরপরে যে শোকবার্তা আসে, তা প্রকতই দুঃসহ। আসে সেজো ছেলে হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যু-সংবাদ। মহর্ষিদেবের জীবনীকার অজিতকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘চুঁচুড়ার বাড়িতে বাস করিবার সময় একদিন খবর আসিল হেমেন্দ্রনাথের কঠিন ব্যামো হইয়াছে। তাঁহার রোগের প্রতিদিনের খবর প্রিয়নাথ শাস্ত্রী দেবেন্দ্রনাথকে শুনাইতেন। একদিন রাত্রে খবর আসিল, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। শাস্ত্রীমহাশয় ভাবিতে লাগিলেন এই নিদারুণ খবর তাঁহাকে কেমন করিয়া দিবেন।’
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত
সকালে উপাসনার পর মহর্ষি বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছিলেন। এ সময় প্রতিদিনই তিনি সহচর প্রিয়নাথকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আজকের খবর কী?’ সেদিনও তেমনই জিজ্ঞাসা করেছিলেন। মহর্ষির সেই প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়নাথ শাস্ত্রী থমথমে গলায় বলেছিলেন, ‘আজকের খবর ভালো নয়, সেজোবাবুর মৃত্যু হইয়াছে।’
মহর্ষির সেজোছেলে হেমেন্দ্রনাথের তখন বয়স হয়েছিল সবে চল্লিশ। এ বয়স তো মরার নয়। অপ্রত্যাশিত অভাবনীয় অকাল-প্রয়াণ। হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর মহর্ষিদেবকে হতবাক করেছিল। পুত্র-বিয়োগের সেই যন্ত্রণার মধ্যেও পরিচয় দিয়েছিলেন দায়িত্বপরায়ণতার।
মহর্ষির সেজোছেলে হেমেন্দ্রনাথের তখন বয়স হয়েছিল সবে চল্লিশ। এ বয়স তো মরার নয়। অপ্রত্যাশিত অভাবনীয় অকাল-প্রয়াণ। হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর মহর্ষিদেবকে হতবাক করেছিল। পুত্র-বিয়োগের সেই যন্ত্রণার মধ্যেও পরিচয় দিয়েছিলেন দায়িত্বপরায়ণতার।
হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
হেমেন্দ্রনাথ ডাক্তারি পড়েছিলেন মেডিকেল কলেজে। ডাক্তারি পড়লেও পরীক্ষা দেননি। চিকিৎসাবিজ্ঞান ছিল তাঁর করায়াত্ত। ছিলেন অত্যন্ত বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারেও অগ্ৰণী নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যু-সংবাদের জন্য মহর্ষি প্রস্তুত ছিলেন না। নিদারুণ এই সংবাদ পাওয়ার পর কোনোরকমে নিজেকে সামলে মৃত্যু-পরবর্তী কার্যক্রম ও নিয়মবিধি-পালন নিয়ে মহর্ষি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। জোড়াসাঁকোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তৎপর হয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির জামাতা, মহর্ষির আস্থাভাজন যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পত্র লেখেন। সে চিঠিতে আছে, ‘হেমেন্দ্রের শ্রাদ্ধ করিতে হইবে …মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করা উচিত।’
চরম শোকের মুহূর্তে এভাবে নিজেকে সামলানো, সংযত রাখা, নিয়মনিষ্ঠ হয়ে ওঠা সহজ কথা নয়।
চরম শোকের মুহূর্তে এভাবে নিজেকে সামলানো, সংযত রাখা, নিয়মনিষ্ঠ হয়ে ওঠা সহজ কথা নয়।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।