নিশান্ত।
His guidance was gentle, firm and caring, his craft at his fingertips and his knowledge of the milieu impeccable, but what affected me most was the trust he reposed in the actors, the assurance in dealing with them and his compassion for every character. —Naseeruddin Shah
সাল ১৯৪০-৫০, তেলেঙ্গানার এক গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীকে অপহরণ করেন সেই গ্রামেরই জায়গিরদারের দুই ভাই অঞ্জৈয়া ও প্রসাদ। তাদের ছোট ভাই বিশ্বমের নজর ছিল সেই পরস্ত্রীর প্রতি। বাড়িতে আটক করে শুরু হয় ধর্ষণ এবং নির্যাতন। বাড়িতে নতুন বউ (ছোটভাইয়ের) ও পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও তারা সেই অসহায় মহিলার সাহায্যে এগিয়ে আসে না, নারীর ভবিতব্য বলতে তারা পুরুষদের দখলদারিকেই বোঝে। সকলের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের সাক্ষ্য, প্রমাণ জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যায় মাস্টারমশাইয়ের।
সাল ১৯৪০-৫০, তেলেঙ্গানার এক গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীকে অপহরণ করেন সেই গ্রামেরই জায়গিরদারের দুই ভাই অঞ্জৈয়া ও প্রসাদ। তাদের ছোট ভাই বিশ্বমের নজর ছিল সেই পরস্ত্রীর প্রতি। বাড়িতে আটক করে শুরু হয় ধর্ষণ এবং নির্যাতন। বাড়িতে নতুন বউ (ছোটভাইয়ের) ও পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও তারা সেই অসহায় মহিলার সাহায্যে এগিয়ে আসে না, নারীর ভবিতব্য বলতে তারা পুরুষদের দখলদারিকেই বোঝে। সকলের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের সাক্ষ্য, প্রমাণ জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যায় মাস্টারমশাইয়ের।
গ্রামের পুলিশ থেকে প্রশাসনিক প্রধান হয়ে বড় উকিল সবাই জ্ঞানের বুলি আওড়াতে থাকেন— “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”। সত্তরের দশকে আরব সাগরের তীরে স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা জনমানসে সিনেমার যে জাল বিছিয়ে ছিলেন তা কেটে ‘নিশান্তে’র মতো ভয়ঙ্কর অথচ প্রত্যক্ষ কষাঘাতে ভারতীয় দর্শকদের অভ্যস্ত করিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম পরিচালক শ্যাম বেনেগল। ছবির পর ছবিতে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, অমরীশ পুরী, নাসিরুদ্দিন শাহ, অনন্ত নাগ, মোহন আগাসে, কুলভূষণ খরবন্দা, ফরিদা জালাল, দীপ্তি নাভাল এবং রজিত কাপুরের মতো অভিনেতারা।
আরও পড়ুন:
পাঠে-অনুবাদে পেলাম অমূল্য রতন: অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্/২
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি
উপমহাদেশের জাগ্রত বিবেক থেকে সমাজের জটিলতা ও বৈপরীত্য যাঁর ছবিতে সব থেকে বেশি উঠে এসেছে সেই নবতিপর প্রবাদপ্রতিম পরিচালক শ্যাম বেনেগল গত ২৩ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ১৯৭৪ থেকে ২০২৩ সালের দীর্ঘ উনপঞ্চাশ বছরের সিনেমা জীবনে যাঁর বিবিধ নির্মাণ তাঁকে ঈর্ষান্বিত করত তিনি অবশ্যই ‘কাগজ কে ফুলে’র নির্মাতা গুরু দত্ত। তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রতি। সারল্য ও সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে নির্মিত ‘মন্থনে’র (১৯৭৬) শুরুতেই জীবনের আদর্শ, আদর্শবাদের গলা টিপে শেষ করে দেওয়া একটা সমাজ, পরিপার্শ্ব ও দেশের স্বাধীনতার প্রায় তিরিশ বছরের মাথায় সেই নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি তাঁর প্রায় সব ছবির অন্যতম চরিত্রাভিনেতা অমরীশ পুরী (মিশ্রাজি)। অথচ সেই ছবি জুড়ে দেখা যায় শহুরে যুবা মানস পুরোপুরি মরে যায়নি।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪২: রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক
গুজরাতের অখ্যাত গ্রামে সমবায় সমিতির মাধ্যমে গ্রামের মানুষের হকের পয়সা তাদের হাতে তুলে দেওয়া, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৎপর ডাঃ রাও (গিরিশ কারনাড) যেন হার না মানা এক বিপ্লবের সাক্ষী। এই কাজটি তিনি করেছিলেন গুজরাতের ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের জন্য, এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে ‘আরোহণ’, হ্যান্ডলুম কো-অপারেটিভসের হয়ে ‘সুসমান’, ভারতীয় রেলওয়ের জন্য ‘যাত্রা’ এবং মহাত্মা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে সত্যজিৎ রায় হয়ে সুভাষচন্দ্র বসু ও বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের জীবনের ওপর তাঁর প্রামাণ্য ডকুমেন্টারি ও ছবির বিষয় বিস্ময়াবিষ্ট করে দর্শকদের।
আরোহণ।
শ্যামের নির্মিত ছবিগুলির মধ্যে অঙ্কুর, নিশান্ত, মন্থন, ভূমিকা, জুনুন, কলযুগ, মন্ডি, সুরজ কা সাতয়াঁ ঘোড়া, মাম্মো এবং সরদারি বেগম ‘ক্ল্যাসিকস’ পর্যায়ে উন্নীত। দেখানোর স্বাভাবিকতা ও ক্যামেরার অসাধারণ কাজ সহজেই দর্শককে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যায়। পিতা শ্রীধর বি বেনেগল একজন আলোকচিত্রী হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই শ্যামের ক্যামেরার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তাঁর নির্মিত ছবিগুলির বয়স পঞ্চাশ থেকে তিরিশ বছর হলেও সমকালের প্রেক্ষিত থেকে সেগুলির পুনর্মূল্যায়ন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার বাড়বাড়ন্তের উদগ্র প্রকাশ না দেখিয়েও এর উপস্থিতি বুঝিয়ে এসেছেন বরাবর, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অধিকার, নারীমুক্তির দিকগুলি তুলে ধরেছেন অনায়াসে।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
সাদাকে সাদা, আর কালোকে কালো বলতে অভ্যস্ত শ্যামসুন্দর বেনেগল নিজেকে লেখক এবং চিত্রকল্পের নির্মাতা বলে মনে করতেন। ছবির নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশজ ভাব বজায় রেখে তিনি এমন ভাবে বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে জানতেন যে, জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ অবলম্বনে নির্মিত ৫৩ পর্বের টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘ভারত এক খোঁজ’ উপমহাদেশের প্রারম্ভ থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসকে ফ্রেমের পর ফ্রেমে অবিস্মরণীয় সংবেদনশীল অভিনয়ের মাধ্যমে সাজিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৪: দশরথপুত্র ভরত, এক ব্যতিক্রমী চরিত্র, বর্তমানের নিরিখে এক বিরলতম প্রজাতি
মুলো খেতে আপত্তি নেই, তা হলে তার পাতার কী দোষ করল? এই শাকের কত পুষ্টিগুণ জানেন?
সামাজিক সমস্যাগুলির চিহ্নিতকরণ এবং শিল্প, সাহিত্য ও সিনেমার মাধ্যমে তার প্রকাশ, প্রতিবাদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে করতেন সমান্তরাল ছবির বর্ষীয়ান সেই পরিচালক। মাঙ্গলিক মেয়ের প্রথম বিবাহ কুকুরের সঙ্গে দিতে গিয়ে গোটা পরিবারের হয়রানি হাস্যরসের উদ্রেক করলেও কুসংস্কারের গভীরতা এবং নানান সংলাপের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসহীনতা বোঝাতে শ্যাম বেনেগলের হাতিয়ার হয়েছিল ‘ওয়েলকাম টু সজ্জনপুরে’র মতো ছবি। ২০০৮ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল।
অঙ্কুর।
দেশে সমান্তরাল ছবির যে ঢেউ সত্যজিৎ, ঋত্বিক ও মৃণাল সেনের ছবির মাধ্যমে উঠেছিল তা যথার্থ গতি পেয়েছিল ‘শ্যামবাবু’র কাজের মধ্য দিয়ে (১৯৭০-৯০)। তাঁর ছবিতে প্রভাবহীন, সাধারণ ভারতীয়দের প্রভাব নাচ-গান-মারপিট ছাড়াই বিয়োগান্তক পরিণতিতে রেশ রেখে যেত। বেশির ভাগ ছবির সহযোদ্ধারা ছিলেন সত্যদেব দুবে, গিরিশ কারনাড, শমা জাইদি, অতুল তিওয়ারি এবং গোবিন্দ নিহালানি। ১৯৭৪ সালে তাঁর প্রথম ছবি ‘অঙ্কুর’ মুক্তির আগে তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন তার মধ্যে ‘চাইল্ড অব দ্য স্ট্রিট'(১৯৬২) উল্লেখযোগ্য। হায়দ্রাবাদের নিজাম কলেজে অর্থনীতির ছাত্র থাকাকালীন শ্যাম বেনেগল ‘অঙ্কুরে’র গল্প লেখেন। অবিস্মরণীয় তাঁর এই সৃষ্টি সম্পর্কে সমালোচক, শিক্ষাবিদরা যাই বলুন এই ছবি প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে দর্শক মানসে এমন ভাবনার অঙ্কুরোদগম করেছিল যা তাদের বিবেকের দীর্ঘস্থায়ী নির্মলতা দিয়েছিল।
* ড. বিদিশা মিশ্র, অধ্যাপিকা, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, কলকাতা।