ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে।
সত্যজিৎ রায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে মহান গল্পকারেরা সর্বদা যা বলেছেন যে বিনোদন এবং বুদ্ধিমত্তা একে অপরের নেতিবাচক রূপে প্রভাবিত না করে সহাবস্থান করতেই পারে। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সেই বিশ্বাসের নিখুঁত উদাহরণ। সত্যজিৎ রায় মন্তব্য করেছিলেন ছবি করে প্রচুর রোজগার তিনি করতে পারেননি, তবে বই লিখে লেখক হিসেবে যে প্রভূত পরিমাণে অর্থ তিনি রোজগার করেছেন তা তাঁর দৈনন্দিন সংসার খরচ চালাতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
যে কাজটির জন্য সত্যজিৎ রায়কে সত্তর এবং আশির দশকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত করেছিল তা ছিল তাঁর অমর সৃষ্টির রোমাঞ্চের সিরিজ গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্র (ডাকনাম ফেলুদা)। ফেলুদা তরুণ ও বৃদ্ধদের কাছে তো আকর্ষণীয় এমনকি ছোটদের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলেন। সত্যজিৎ রায় সেই ফেলুদাকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবনে দু’ দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সূচনা অবশ্য আগেই ঘটে গিয়েছিল ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির মাধ্যমে। সেখানে তিনি যে রহস্যের জাল বুনে ছিলেন ব্যোমকেশকে কেন্দ্র করে, সেটাকে তিনি ধারাবাহিকভাবে নিয়ে এলেন ফেলুদার মাধ্যমে। সোনার কেল্লায় তার সূত্রপাত।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫১: সেদিন ‘পথে হল দেরি’ ছবির শুটিংয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটেছিল উত্তম-সুচিত্রার মধ্যে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ
মুকুল ধর উত্তর কলকাতার বসবাসকারী ৭ বছরের একটি ছেলে। তার অতীত জীবনের ঘটনা এবং দৃশ্য মনে পড়তে থাকে। সে ছিল রাজস্থানে। সেখানে সোনার তৈরি দুর্গ রয়েছে। মূল্যবান রত্ন পাথর মাটির নিচে পোঁতা রয়েছে। দুই পাকা অপরাধী এই খবর জানতে পেরে তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অপরাধীরা যাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সে প্রকৃত মুকুল নয়, প্রকৃত মুকুল তখন বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট ডক্টর হাজরার সঙ্গে সোনার কেল্লার হদিস নিতে গিয়েছে। মুকুলের বাবা তার পুত্রের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেই জন্য গোয়েন্দা লাগান। সেই গোয়েন্দাই হলেন ফেলুদা। তাঁর সঙ্গ নিল তাঁরই সহকারী তোপসে।
সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে ব্যবসা সফল ছবিগুলোর মধ্যে সোনার কেল্লা অন্যতম। লালমোহন বাবুও রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে। সত্যজিৎ রায় এক অদ্ভুত বৈচিত্র সৃষ্টি করলেন এই ছবিতে। খুনি বা ষড়যন্ত্রকারীর আগেভাগে তাদের পরিচয় জানালেন। হিচককিয়ান স্টাইলে ছবিটি নির্মিত। এবারে কিভাবে তাঁরা ধরা পড়বেন সেই নিয়ে কাহিনির বিস্তার। রাজস্থানের জাঁকজমক, নায়কের বুদ্ধিমত্তা, কমিক রিলিফের দিকেও নজর দিয়েছিলেন পরিচালক।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি
ফেলুদার চরিত্রে তিনি নিয়ে এলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। তোপসের চরিত্রে তিনি নিয়ে এলেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এবং মুকুলের চরিত্রে কুশল চক্রবর্তীকে। আর জটায়ুর চরিত্রে তিনি নিয়ে এলেন সন্তোষ দত্তকে। সন্তোষ দত্ত যখন মারা গেলেন, তখন সত্যজিৎ রায় ঘোষণা করলেন যে তিনি আর কখনো ফেলুদা চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন না। কারণ জটায়ু যে আর বেঁচে নেই। প্রকৃত ডাঃ হাজরার চরিত্রে শৈলেন মুখোপাধ্যায়। নকল ডাঃ হাজরার চরিত্রে অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সহকারী কামু মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
ছবিতে কাঁকড়াবিছের দৃশ্যটা আমাদের মনের মধ্যে দাগ কেটে গিয়েছে। সেই কাঁকড়াবিছেটিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বিছানায় ঠিক সেই সময়ই। ৭০ দশকের গোড়ায় খুব লোডশেডিং হতো সমগ্র কলকাতা জুড়ে। টালিগঞ্জ তার ব্যতিক্রম ছিল না। যখন এই কাঁকড়াবিছেটাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বিছানাতে ঠিক সেই সময় লোডশেডিং হয়ে যায় স্টুডিয়োতে। ভয়ে আর কেউ নাড়াচড়া করতে পারছেন না। ভয়ংকর অবস্থা তখন স্টুডিয়োতে। জেনারেটরও আসেনি। কোথা থেকে একটা টর্চ খুঁজে এনে কাঁকড়াবিছেটাকে বের করা হল।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করা হল, “খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তাই না?” পর্দার ফেলুদা খুব স্পষ্ট করে বললেন “আমার মনে হয়েছিল কামড়ালে কামড়াবে। বড়জোর মরে যাব। আর তো কিছু হবে না”। সেই সোনার কেল্লা মুক্তি পেয়েছিল আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে। কিন্তু এই ছবির জনপ্রিয়তা আজও অম্লান হয়ে আছে। ১৯৭৪ সালের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার হিসেবে এই ছবির জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন সত্যজিৎ রায়। শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের পুরস্কার পেলেন সৌমেন্দু রায়। আর কয়েক দিনের মধ্যেই পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন আসছে (২ মে)। জন্মদিনের প্রাক্কালে এই লেখার মধ্য দিয়ে পরিচালকের উদ্দেশ্যে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।—চলবে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।