শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

দ্রুপদরাজ, যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মণোচিত আতিথ্য ও সৌজন্য প্রদর্শন করে, প্রফুল্ল মনে, সুদর্শন কৌন্তেয়র কাছে জানতে চাইলেন, কী ভাবে জানব? আপনারা ক্ষত্রিয়? না ব্রাহ্মণ? কিংবা গুণবান কোন বৈশ্য অথবা শূদ্র? আপনারা মায়ার আশ্রয় নিয়ে সর্বত্র বিচরণ করছেন যে। এমনও হতে পারে, আপনারা দেবতা, ছদ্মবেশে কৃষ্ণার দর্শনার্থী হয়ে এসেছেন। আপনি সত্য বলুন, কারণ এই বিষয়টিতে আমার গভীর সংশয় রয়েছে। ব্রবীতু নো ভবান্ সত্যং সন্দেহো হ্যত্র নো মহান্। সংশয় দূর হলে দ্রুপদরাজ সন্তুষ্ট হবেন তো? তাঁদের সৌভাগ্য ফিরবে তো? রাজার অনুরোধ, স্বেচ্ছায় সত্য প্রকাশ করুন। কারণ সত্যবচন রাজাদের শোভা পায়, ইচ্ছয়া ব্রূহি তৎ সত্যং সত্যং রাজসু শোভতে। যেমন ইষ্টকর্ম যজ্ঞ এবং পূর্তকর্ম জলাশয়, কূপ প্রভৃতির প্রতিষ্ঠাবিষয়ে মিথ্যা বলা উচিত নয়।

যুধিষ্ঠিরের উত্তর শুনে রাজা নিশ্চয়ই যথাবিধি বিবাহের আয়োজন করবেন। ধ্রুবং বিবাহকরণমাস্থাস্যামি বিধানতঃ। যুধিষ্ঠির আশ্বস্ত করলেন রাজাকে, হে পাঞ্চালরাজ সংশয়হেতু মনের আনন্দ হারাবেন না। মনে আনন্দ বজায় রাখুন। নিঃসন্দেহে আপনার এই চিরকালীন মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। মা রাজন্! বিমনা ভূস্ত্বং পাঞ্চাল্য!প্রীতিরস্তু তে। ঈপ্সিতস্তে ধ্রুবঃ কামঃ সংবৃত্তো২য়মসংশয়ম্।। নিজেদের প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটন করলেন যুধিষ্ঠির। তাঁরা ক্ষত্রিয় এবং মহান পাণ্ডুর সন্তান। তিনি জ্যেষ্ঠ, কুন্তীপুত্র। অপর দুজন, যাঁরা রাজসভায় রাজকন্যাকে জয় করেছেন, তাঁরা ভীম ও অর্জুন। যমজ দু’জন, নকুল ও সহদেব, সেখানেই ছিলেন যেখানে কৃষ্ণা ও দেবী কুন্তীর বসবাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। যুধিষ্ঠির সান্ত্বনা দিলেন,রাজার মনের বিষাদ দূর হোক। আমরা ক্ষত্রিয়। কমলিনীর যাতায়াত যেমন এক হ্রদ থেকে হ্রদান্তরে তেমনই আপনার কন্যা এক রাজগৃহ থেকে অন্য এক রাজগৃহে গিয়েছেন। ব্যেতু তে মানসং দুঃখং ক্ষত্রিয়াঃ স্মো নরর্ষভ!। পদ্মীনীব সুতেয়ং তে হ্রদাদন্যং হ্রদং গতা।

যুধিষ্ঠির সত্য তথ্য নিবেদন করলেন, দ্রুপদরাজ তাঁর গুরুজন এবং পরম আশ্রয়। রাজা দ্রুপদ, আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিস্ফোরিত নয়নে, যুধিষ্ঠিরের কথার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে অক্ষম হলেন। তিনি নিরুত্তর রইলেন। তার পরে আনন্দজনিত উচ্ছ্বাস সংযত করে যুধিষ্ঠিরের কাছে পূর্ব বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন। যুধিষ্ঠির অনুপুঙ্খরূপে অতীতের ঘটনা বর্ণনা করলেন। সব শুনে দ্রুপদরাজ, নৃপতি ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক্কার দিলেন। রাজা দ্রুপদ, যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যদান করবেন, এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিলেন। রাজার নির্দেশানুসারে, এক বিশাল প্রাসাদে কুন্তী, কৃষ্ণা, পঞ্চপাণ্ডবের বসবাসের স্থান নির্দিষ্ট হল। সেখানে সসম্মানে অবস্থানকালীন সপুত্র পাঞ্চালরাজ যজ্ঞসেন, পরম নিশ্চিন্ত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে প্রস্তাব দিলেন, গৃহ্ণাতু বিধিবৎ পাণিমদ্যায়ং কুরুনন্দনঃ। পুণ্যেঽহনি মহাবাহুরর্জ্জুনঃ কুরুতাং ক্ষণম্।। আজ পুণ্য লগ্ন উপস্থিত। আপনার অনুমতিক্রমে, মহাবীর অর্জুন বিধিমতে কন্যার পাণি গ্রহণ করুন। যুধিষ্ঠির স্বাভিমত ব্যক্ত করলেন। যুধিষ্ঠিরেরও যে বিবাহকরা কর্তব্য। মমাপি দারসম্বন্ধঃ কার্য্যস্তাবদ্বিশাংপতে। দ্রুপদরাজ বললেন, তাহলে যুধিষ্ঠির বিধিমতে পাণি গ্রহণ করুন বা কৃষ্ণাকে যাঁর উপযুক্ত মনে করেন তাঁকে যুধিষ্ঠির মনোনীত করুন।
যুধিষ্ঠির তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন, সর্ব্বেষাং মহিষী রাজন্! দ্রৌপদী নো ভবিষ্যতি। এবং প্রব্যাহৃতং পূর্ব্বং মম মাত্রা বিশাংপতে!।। দ্রৌপদী আমাদের সকলের ভার্যা হবেন। আমার মা এমনটাই বলেছেন। তিনি আরও বললন, যুধিষ্ঠির ও ভীম পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হননি। পৃথাতনয় অর্জুন, ইতিমধ্যে এই রত্নস্বরূপ দ্রুপদকন্যাকে জয় করেছেন। পাণ্ডবদের নিয়ম হল আমাদের সকলে মিলে রত্ন ভোগ করে থাকি। সেই নিয়ম পরিত্যাগ করতে পারি না। এষ ন সময়ো রাজন্!র ত্নস্য সহ ভোজনম্। ন চ তং হাতুমিচ্ছামঃ সময়ং রাজসত্তম!।। ধর্মসঙ্গতভাবে কৃষ্ণা আমাদের সকলের পত্নী হবেন। জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ এই ক্রম অনুসারে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে, দ্রৌপদী সকলের পাণি গ্রহণ করুন। আনুপূর্ব্বেণ সর্ব্বেষাং গৃহ্ণাতু জ্বলনে করান্।

রাজা আশ্চর্য হলেন। এক পুরুষের বহু স্ত্রীর বিধান আছে, কিন্তু এক স্ত্রীর বহু স্বামী,এমন তো শোনা যায় না। নৈকস্যা বহবস্তাত! শ্রূয়ন্তে পতয়ঃ ক্বচিৎ। হে পবিত্র ধর্মজ্ঞ কুন্তীপুত্র, আপনি, বেদবিরুদ্ধ ও লোকবিরুদ্ধ এমন কাজ করতে পারেন না। কেন এমন মতি হল আপনার? যু ধিষ্ঠিরের মতে, ধর্মের গতি সূক্ষ্ম। আমাদের (স্থূলবুদ্ধিদের) কাছে ধর্ম দুর্জ্ঞেয়। বরং আমরা পূর্ববর্তীদের অনুস‍ৃত পথই অনুসরণ করি। সূক্ষ্মো ধর্ম্মো মহারাজ! নাস্য বিদ্মো বয়ং গতিম্। পূর্ব্বেষামানুপূর্ব্বেণ যাতং বর্ত্মানুযামহে।। যুধিষ্ঠির অসত্য কথা বলেন না। ধর্মবিরুদ্ধ কাজেও তাঁর মতি নেই। জননীও এমন কথাই বলেছেন, যুধিষ্ঠিরও তাঁর সঙ্গে সহমত। তাই তাঁর বিশ্বাস এটিই ধর্ম।কোন বিচার না করেই রাজা এটি গ্রহণ করুন। এ বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ যেন না থাকে। দ্রুপদরাজ প্রস্তাব দিলেন, যুধিষ্ঠির, দেবী কুন্তী ও রাজার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, এই কজন মিলে ইতিকর্তব্য বিষয়ে জানিয়ে দিন। পরের দিন সেটাই করা হবে। তাঁরা সমবেত আলোচনা শুরু করলেন। এমন সময়ে, সেখানে স্বেচ্ছায় উপস্থিত হলেন, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস।

পাঞ্চাল এবং পাণ্ডবরা সকলেই উঠে দাঁড়ালেন, তাঁরা সকলেই মহর্ষি বেদব্যাসকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানালেন। সম্মানীয় বেদব্যাস সকলের কুশল, প্রশ্ন করে প্রত্যভিবাদন জানালেন। স্বর্ণময় আসন গ্রহণ করলেন মহাত্মা বেদব্যাস। তাঁর অনুমতিক্রমে উভয় পক্ষ আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। দ্রুপদরাজ মধুর কণ্ঠে দ্রৌপদীর বিবাহবিষয়ে প্রশ্ন করলেন। কেন এক নারী বহুজনের হলেও ধর্মে পাপের মিশ্রণ হবে না? এ বিষয়ে ঠিক ঠিক যথাযথ সদুত্তর দিন আপনি। কথমেকা বহূনাং স্যান্ন চ স্যাদ্ধর্ম্মসঙ্করঃ। এতন্মে ভগবান্ সর্ব্বং প্রব্রবীতু যথাতথম্।। বেদব্যাস বললেন, লৌকিক ও বৈদিক আচারের এই পরস্পর বিরোধিতার বিষয়ে, যিনি যে মত পোষণ করেন, তিনি সেগুলি শুনতে ইচ্ছুক।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ

প্রথমে দ্রুপদরাজ শুরু করলেন। তাঁর মতে লোকবিরুদ্ধ ও বেদবিরুদ্ধ এই বিষয়টি ধর্মের পরিপন্থী। হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ,বহু মানুষের এক পত্নী থাকতে পারে না। প্রাচীন মহাত্মারা এই আচরণ করেননি। এ বিষয়ে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও কখনই এ অধর্মাচরণ সঙ্গত নয়। সেই কারণেই তিনি বিবাহকার্যে উদ্যোগী হননি। রাজা দ্রুপদ জানালেন, ধর্মবিষয়ে তাঁর সর্বদাই সন্দেহ রয়েই গিয়েছে। ধর্ম্মঃ সদৈব সন্দিগ্ধঃ প্রতিভাতি হি মে ত্বয়ম্। ধৃষ্টদ্যুম্নের মতে, কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীকে, কী করে পত্নীরূপে গ্রহণ করবেন সদাচারী জ্যেষ্ঠ? ধর্মের সূক্ষ্ম গতি, সব দিক থেকে ধর্ম আমাদের কাছে দুর্জ্ঞেয়। তাই এটি ধর্ম না অধর্ম? এমন সন্দেহ থাকায় এ বিষয়ে কিছুই করার চেষ্টা বৃথা। তাহলে কৃষ্ণা পাঁচ জনের মহিষী হবেন।

এবার যুধিষ্ঠিরের মতামত প্রকাশের পালা। তিনি মিথ্যা বলেন না। অধর্মেও তাঁর মতি নেই। তাঁর এ বিষয়ে পূর্ণ সম্মতি আছে, তাই এটি কোনভাবেই অধর্ম নয়। যুধিষ্ঠির লৌকিক দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করলেন। পুরাণে শোনা যায়, জটিলা নামে ধর্মবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এক গৌতমবংশীয়া, পতিরূপে, সাতজন ঋষির শরণ নিয়েছিলেন। বার্ক্ষী নামে এক মুনিতনয়া, প্রচেতস নামধারী সিদ্ধ তপস্বী দশজন ভাই-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। শ্রেষ্ঠ ধর্মজ্ঞরা গুরুবাক্যই ধর্মসঙ্গত বলে মনে করেন। অথচ মা হলেন সকল গুরুদের মধ্যে একমাত্র পরম গুরু। তিনি বলেছিলেন, ভিক্ষালব্ধ অন্নবৎ তাঁকে ভোগ কর। তাই, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আমি এই বিধানকে পরম ধর্ম বলে মনে করি। গুরূণাঞ্চৈব সর্ব্বেষাং মাতা পরমেকো গুরুঃ।। সা চাপ্যুক্তবতী বাচং ভৈক্ষ্যতদ্ভুজ্যতামিতি। তস্মাদেতহং মন্যে পরং ধ্রম্মং দ্বিজোত্তম!।। দেবী কুন্তী তাঁর মত প্রকাশ করলেন, ধার্মিক যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তা সঠিক। মিথ্যাকে তিনি তীব্র ভয় পান। তিনি, মিথ্যা হতে মুক্ত হবেন কী করে?

মহর্ষি ব্যাস সান্ত্বনা দিলেন কুন্তীকে, কুন্তীর মিথ্যাবচন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। কারণ এটিই সনাতন ধর্ম। কুন্তীপুত্র কথিত ধর্ম প্রকৃত ধর্ম। মহর্ষি এ বিষয়ে সংশয়হীন। পাঞ্চালরাজ, আমার থেকে শুনুন এ বার। ন তু বক্ষ্যামি সর্ব্বেষাং পাঞ্চাল! শৃণু মে স্বয়ম্।
এরপরে আসন ত্যাগ করে, ভগবান কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রাজার হাত ধরে, অন্য কোন গৃহে প্রবেশ করলেন। সেখানে, পাণ্ডবগণ, দেবী কুন্তী, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁদের দু’জনের জন্য প্রতীক্ষায় রইলেন। মহর্ষি বেদব্যাস, বহু জনের এক পত্নীত্বও যে ধর্ম, সে বিষয়ে বলতে লাগলেন। ততো দ্বৈপায়নস্তস্মৈ নরেন্দ্রায় মহাত্মনে। আচখ্যৌ তদ্ যথা ধর্ম্মো বহূনামেকপত্নিতা।।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

পরণে ব্রাহ্মণদের ছদ্মবেশ, পাণ্ডবদের পরিচয় তখনও অজ্ঞাত। দ্রুপদরাজ কৌশলে তাঁদের প্রকৃত সামাজিক পরিচিতি জানতে চেয়েছেন। দ্রুপদরাজপ্রাসাদে চতুর্বর্ণের ব্যবহারোপযোগী উপহারসামগ্রীর মধ্যে পাণ্ডবরা নিজ বর্ণের উপযোগী যুদ্ধোপকরণ বেছে নিয়েছেন। তাঁদের ক্ষত্রিয়ত্ব প্রকট হয়েছে। তবু দ্রুপদরাজের মনে ধন্ধ, অজ্ঞাতকুলশীল, সহায়সম্বলহীন আগন্তুক, এরা কারা? তবু রাজা, ছদ্মবেশী পাণ্ডবদের প্রতি ব্রাহ্মণদের প্রাপ্য সৌজন্যবোধ বজায় রেখেছেন। সে কী শুধু ব্রাহ্মণবর্ণের আধিপত্যের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য? দোলাচলচিত্ত পাঞ্চালরাজ, নিজকন্যার অপরিমিত সুখ্যাতির প্রতি এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুপুত্রের কাছে,অক্লেশে প্রশ্ন রেখেছেন, তবে কী তাঁর অনন্যা কন্যাটির দর্শনার্থী হয়ে এসেছেন ছদ্মবেশী দেবতারা?

রাজার প্রশ্নে, বিবাহযোগ্যা কন্যার পিতার দীনতা নয়, বরং আত্মপ্রত্যয়ের সুরে ও প্রার্থী পাণ্ডবদের প্রতি দেবত্ব আরোপের প্রয়াসে নিঃসন্দেহে রাজোচিত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় রেখেছেন তিনি। যুধিষ্ঠিরদের ক্ষত্রিয়ত্ব সম্বন্ধে স্থিরনিশ্চিত হতে চেয়েছেন দ্রুপদরাজ। পাণ্ডবদের রাজকীয় পরম্পরা সম্বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছেন, অসত্যভাষণ রাজাদের শোভনীয় নয়। রাজপদের অগ্রাধিকার যে শুধু ক্ষত্রিয়দের। সমান ঘর সমান বর হোক কন্যার—এ যে কন্যার পিতার একান্ত মনের ইচ্ছা। নিজেদের অপরিচয়ের আবরণ উন্মোচিত হল যখন, আনন্দিত দ্রুপদরাজ সানন্দে কন্যাদানে আগ্রহী হলেন। পাত্র স্বয়বরসভায় লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী অর্জুন। রাজার এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ দেখা দেয়নি। এটাই তো স্বাভাবিক, বিজয়ীর গলাতেই বরমাল্য শোভা পায়। রাজার উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে যুধিষ্ঠির ঘোষণা করেছেন, তিনি নিজে অবিবাহিত,তাই তাঁর নিজের ব‍িবাহের আবশ্যকতা আছে। রাজার এ বিষয় কোন আপত্তি ছিল না। ভবান্ বা বিধিবৎ পাণিং গৃহ্ণাতু দুহিতুর্মম। কেন? কুলমর্যাদার প্রভাব, অর্জুনের বীরত্বের গরিমা নস্যাৎ করে দিতে পারে? ব্যক্তিগত কৃতিত্বের মর্যাদা সেখানে তুচ্ছ হয়ে ওঠে। এমন বংশ, জাতপাত,বর্ণবৈষম্যের প্রভাব এখনও ক্রিয়াশীল ভারতীয় মানসিকতায়। তবে ধনগৌরব নয় কুলগৌরব প্রাধান্য পেয়েছে অতীতে। এখন চলছে দুয়ের যুগলবন্দি।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

ক্ষত্রিয় রাজা পাণ্ডুপুত্রকে জানিয়েছেন স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের অনুমোদিত, যে কোনও একজন, কন্যার উপযুক্ত পাত্র হলে বিবাহে বাধা নেই কোনও। যস্য বা মন্যসে বীর! তস্য কৃষ্ণামুপাদিশ। স্বয়ংবর সভার মাধুর্য্য, উদ্দেশ্য, নিজের স্বামী নির্বাচনবিষয়ে কন্যার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সব কিছুই ধূলিসাত হল। রাজা দ্রুপদ যখন জানালেন দ্রৌপদী পাঁচ ভায়ের পত্নী হবেন, তখন তাঁর কাছে সেই প্রস্তাব গ্রাহ্য হল না। কারণ স্ত্রীলোকের বহুস্বামিত্বের দৃষ্টান্ত বেদবিরুদ্ধ ও লোকবিরুদ্ধ।

কারণ সেটিই বৈদিক ও লৌকিক পরম্পরা। একজন নারীর এক পতি। পুরুষের কিন্তু বহুস্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে কোনও বাধা নেই। একস্য বহ্ব্যো বিহিতা মহিষ্যঃ কুরুনন্দন!। নৈকস্যা বহবস্তাত! শ্রূয়ন্তে পতয়ঃ ক্বচিৎ।।

নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির ঔরসজাত সন্তানের জন্ম দিয়ে, সমাজবন্ধন ধরে রাখে নারী। অথচ ব্যক্তিপরিচয়ে পিতৃত্বের দাবী আগে। মহাকাব্যে, পাণ্ডবরা কিন্তু কৌন্তেয়ও, পাণ্ডুপুত্ররা কুন্তীপুত্রও বটে, এই স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং মহর্ষি বেদব্যাস। যুগান্তরে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রাধান্যহেতু, ব্যক্তির পরিচয় শুধু পিতার পদবি দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে, মাতৃত্বের অবমাননা হয়তো নয়, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতার চোরা স্রোত বয়ে চলেছে সামাজিক পরিমণ্ডলে, সেটি অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

যুধিষ্ঠির ধর্মের সূক্ষ্ম গতি অনুধাবনে অক্ষমতা জানিয়েছেন। তিনি পৌরাণিক ধ্যানধারণার বিশ্বাসী। এ ছাড়াও তিনি চেয়েছেন তাঁর মায়ের আজ্ঞা যেন সফল হয়। এবঞ্চৈব বদত্যম্বা মম চৈতন্মনোগতম্। মা, যেমন বলেছেন, আমারও সেটিতেই অভিমত। জননী তাঁদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন, শৈশবে পিতৃহীন পঞ্চ পাণ্ডবদের সুখে দুঃখে আগলে রেখেছেন মা কুন্তী। যুধিষ্ঠির জানেন গুরূণাঞ্চৈব সর্ব্বেষাং মাতা পরমেকো গুরুঃ। সকল গুরুদের মধ্যে মা হলেন একজন শ্রেষ্ঠ গুরু। তাই তাঁর বাক্য শিরোধার্য। সেখানে বিচার বিবেচনার অবকাশ নেই কোনও। নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছেন, এষ ধর্মো ধ্রুবো রাজন্! চরৈনমবিচারয়ন্। মায়ের কথায় অবিচল আস্থা,নিজের সত্যরক্ষায় অনন্য নিষ্ঠা, প্রভৃতি ব্যক্তিগত বিবেকচেতনায় প্রতিষ্ঠিত যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধ। তাঁর ধর্মচিন্তায় বিবেকের সায় আছে। তিনি জানেন মনোগত এ সিদ্ধান্ত কোনও মতেই ধর্মবিরোধী নয়। বর্ত্ততে হি মনো মে২ত্র নৈষো২ধর্ম্মঃ কথঞ্চন। সবসময়ে ব্যক্তিগত ধর্মবোধ, পরম্পরাগত ধার্মিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে কী? হয়তো সম্ভব, যুগধর্মের ক্ষেত্রে কালান্তরেও ব্যক্তিগত বিবেকবোধের প্রভাব দৃশ্যমান।

জননী কুন্তী, অকপটে ধার্মিক পুত্রকে সমর্থন করেছেন। সত্য মিথ্যার ধর্মসঙ্কটে পুত্রের শরণাপন্ন হয়েছিলেন জননী কুন্তী। ভিক্ষালব্ধ কৃষ্ণা সকল পুত্রের ভোগ্য হবেন কী?এই সিদ্ধান্তের ফলে পাপের ক্লেদ পরিণীতা দ্রৌপদীকে স্পর্শ করবে না তো?এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছেন সমবণ্টনে বিশ্বাসী যুধিষ্ঠির। সর্ব্বেষাং ধর্ম্মতঃ কৃষ্ণা মহিষী নো ভবিষ্যতি। পারিবারিক ঐক্যরক্ষার্থে মনে করেছেন, তস্মাদেতদহং মন্যে পরং ধর্ম্মং দ্বিজোত্তম। পিতামহ ব্যাসদেবকে তাঁর পরম ধর্মসঙ্গত মতামত গভীর প্রত্যের সঙ্গেই জানিয়েছেন।

ছবি: প্রতীকী।

রাজা দ্রুপদের যুক্তি হল বেদে যার দৃষ্টান্ত বিরল সেটি ধর্ম নয়। কথমেকা বহূনাং স্যান্ন চ স্যাদ্ধর্ম্মসঙ্করঃ। একনারী বহু পতির হলে ধর্মে পাপ মিশ্রিত হবে কিনা, এই বিতর্কের নিশ্চিত সিদ্ধান্ত কী হবে? আচার্য বেদব্যাসের কাছে জানতে চেয়েছেন দ্রুপদরাজ। মহর্ষি, বিবেকচেতনার ওপরে শ্রদ্ধামিশ্রিত আস্থা রেখে বিধান দিয়েছেন, যথায়ং বিহিতো ধর্ম্মো যতশ্চায়ং সনাতনঃ। যথা চ প্রাহ কৌন্তেয়স্তথা ধর্ম্মো ন শংসয়ঃ।।

নারীর বহুগামিতার বিষয়টি যদিও বিতর্কিত সমাজতত্ত্বের বিষয়। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে পরম্পরাগত যুগধর্মের ঊর্দ্ধে মানুষের বিবেকবোধ সমর্থিত ধর্মসিদ্ধান্ত হতে পারে কি না, সে বিষয়ে যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। এই কারণেই আচারনিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ সামাজিক নিয়ম অগ্রাহ্য করতে পারে মানবিকবোধ, চৈতন্যের আলোয় উজ্জ্বল ধর্মচিন্তা। সেখানেই বিশিষ্টতা মানুষের। মহাভারতের যুগেও ধর্মের বিজয়ঘোষণায়, বিবেকেবোধের বজ্রকঠিন স্থির প্রত্যয়ের সুরটি স্পষ্ট শোনা যায় কী?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content