রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

রাজা দশরথের শব্দবেধী বাণে, বিদ্ধ হয়েছিলেন মুনিপুত্র। রাজার প্রতি, পুত্রশোকে কাতর পিতার অভিশাপ ছিল —রাজা দশরথ, মুনিপুত্রকে হত্যাজনিত কারণে পুত্রশোকহেতু প্রাণত্যাগ করবেন। মুনির এই অভিশাপ ফলপ্রসূ হল। পুত্রশোকে প্রয়াত হলেন রাজা দশরথ। তখন গভীর রাত। এই শোকসংবাদ তখনও অযোধ্যার জনমানস স্পর্শ করেনি। তাই নেই কোনও প্রত্যহিক রাজকীয় যাপনের ব্যতিক্রম। ভোরবেলা দৈনন্দিন সময়সূচী অনুযায়ী প্রাসাদে কর্মকাণ্ড শুরু হল। বন্দিরা স্তুতিপাঠ করবেন। তাই তারা উপস্থিত হল রাজভবনে। পরিশীলিতরুচির স্তুতিপাঠকেরা, বহুশ্রুত মাগধ, গায়কবৃন্দ প্রত্যেকে রাজার উদ্দেশ্যে যথোচিত বন্দনা গান কীর্তন করতে লাগলেন। সেই স্তুতিগীতির সুর ধ্বনিত হল প্রাসাদের সর্বত্র। সঙ্গতে রইলেন মৃদঙ্গবাদ্যকরেরা।

জেগে উঠল বিহঙ্গকুল। মাঙ্গলিক শব্দ ও বীণার সুরে,সুরে,গানে গানে সৃষ্টি হল এক কল্যাণময় আবহ। উপস্থিত হল শুদ্ধাচারী, সেবায় নিপুণ,নপুংসকপ্রধান সেবকদল। যথানিয়মে, রাজার স্নানের দায়িত্বে রত স্নানে অভিজ্ঞরা, স্নানের উপাদান—জলপূর্ণ সোনার ঘট, চন্দন প্রভৃতি অনুলেপন নিয়ে হাজির হলেন। স্পর্শযোগ্য মাঙ্গলিক দ্রব্য, পরিধেয় বসন, আচমনের জন্যে ব্যবহৃত জল নিয়ে, এলেন যাঁদের মধ্যে কুমারীদের আধিক্য রয়েছে এমন পবিত্র মহিলাগণ। সুলক্ষণান্বিত, বিধিঅনুসারে সুপরীক্ষিত, গুণযুক্ত, সুন্দর লক্ষ্মীশ্রীযুক্ত রাজব্যবহৃত সব দ্রব্যের সমাহার ছিল সেখানে।
ক্রমে সূর্যোদয় পর্যন্ত উদগ্রীব দর্শনার্থীরা রাজদর্শনে ব্যর্থ হলেন। তাঁরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। কী হল? কিং স্বিদিত্যোপশঙ্কিতম্। মনে আশঙ্কা, কেন এমন হল? কোশলরাজের শয়নাগারের নিকটবর্ত্তিনী স্ত্রীরা রাজাকে জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। তাঁরা সে বিষয়ে অভিজ্ঞ। তাই তাঁরা সবিনয়ে, যথারীতি রাজার শয্যা স্পর্শ করলেন কিন্তু কোনও প্রাণের সাড়া পেলেন না। রাজার জ্ঞাতার্থে নাড়ির স্পন্দনের মধ্যে নিদ্রার গতিপ্রকৃতি জ্ঞাতার্থে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু বিপরীত প্রতিক্রিয়া অনুভব করে, রাজার প্রাণের আশঙ্কায় কেঁপে উঠলেন তাঁরা। স্রোতের অভিমুখে তৃণসম কম্পমান মহিলারা ভয়ে শিহরিত হলেন।

রাজাকে দেখে, তাঁদের আশঙ্কা নিশ্চিত সত্যে পরিণত হল। তখনও পুত্রশোকে মৃতপ্রায়, নিদ্রাভিভূতা, রানি কৌশল্যা ও দেবী সুমিত্রাকে মৃত্যুর অভিঘাত স্পর্শ করেনি। রাজার পাশে, কান্তিহীনা, মলিনা, শোকহেতু অবসন্না, দেবী কৌশল্যা, তমসাচ্ছন্ন তারকার মতো নিষ্প্রভা, তাঁর পাশেই রয়েছেন দেবী সুমিত্রা। তাঁর শোকাশ্রুপরিপূর্ণ ম্লান মুখটি আর আগের মতো শ্রীময়ী নয়। দুই নিদ্রাতুর দেবী ও রাজার সেই প্রাণহীন দেহ, দেখে মনে হচ্ছে যেন অন্তঃপুরটিও যেন ঘুমন্ত, নির্জীব। সেই সব দীন শোকাতুরা, সুন্দরী রমণীরা, বনান্তরে গজবিচ্ছিন্না হস্তিনীর মতো উচ্চকণ্ঠে কেঁদে উঠলেন। রানি কৌশল্যা ও সুমিত্রার ঘুম ভাঙ্গল। রাজাকে দেখে ও স্পর্শ করে, হা ভর্ত্তেতি পরিক্রুশ্য পেততুর্ধরণীতলে।

হায় স্বামী বলে চিৎকার করে আছড়ে পড়লেন ভূমিতে। ধূলিমলিন দেহে,দেবী কৌশল্যার দশা যেন গগনচ্যুত নক্ষত্রতুল্য। সেই নারীরা দেখলেন, রাজা প্রাণহীন, হত। নাগবধূসম মাটিতে পড়ে আছেন দেবী কৌশল্যা। কৈকেয়ী প্রভৃতি অন্যান্য প্রধানা মহিষীরা শোকসন্তপ্ত চিত্তে, কাঁদতে কাঁদতে, প্রায় হতচৈতন্য অবস্থায় সেখানে উপস্থিত হলেন। নারীদের পূর্বকৃত আর্তনাদ, তার সঙ্গে মিশ্রিত এই রোদনধ্বনি মিলে মিশে স্ফীত হয়ে, প্রবল হল।ভীত, সন্ত্রস্ত,সম্ভ্রান্ত উদগ্রীব মানুষের ভিড় সর্বত্র। সব দিকে ক্রন্দনরোল। বন্ধুবান্ধব সকলেই পরিতাপরত, আর্ত। সব মিলিয়ে সদ্য প্রয়াত রাজার প্রাসাদ, নিরানন্দ, বিকৃত অর্থাৎ শ্রীহীনরূপে দৃশ্যমান হল। রাজা দশরথের পত্নীরা.স্বামীর মৃত্যুবিষয়ে নিশ্চিত হয়ে মৃতদেহ ঘিরে ধরলেন। দুঃখদীর্ণ পত্নীরা, করুণস্বরে, ভয়ানক রোদন করতে করতে, অনাথার মতো বাহু দিয়ে বুকে আঘাত করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪০: বিশ্বকবির তিন মেয়ে— অকালে ঝরে যাওয়া প্রতিভা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

রাজা দশরথের নিষ্প্রাণ দেহটি যেন নির্বাপিত অগ্নি,যেন জলহীন সমুদ্র। নিষ্প্রভ সূর্যতুল্য রাজা। শোকার্তা রানি কৌশল্যা, মৃত রাজার মাথাটি তুলে নিলেন কোলে। অশ্রুপূর্ণ নয়নে, দেবী কৌশল্যা, রানি কৈকেয়ীর উদ্দেশ্যে বিষোদ্গার শুরু করলেন। নিষ্ঠুর দুরাচারিণী কৈকেয়ীর মনোবাসনা এতদিনে পূর্ণ হয়েছে, রাজাকে পরিত্যাগ করে, এ বার তাঁর একাকিনী নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগের সময়। পুত্র রাম ইতিমধ্যে জননীকে ছেড়ে গিয়েছেন, স্বামীও স্বর্গত। উদ্দেশ্যবিহীন আমি আর বিপদসংকুল জীবনপথে পারি দিতে চাই না। বিহায় মাং গতো রামো ভর্ত্তা চ স্বর্গতো মম। বিপথে সার্থহীনেব নাহং জীবিতুমুৎসহে।।

স্বামীহীন জীবন কোন নারী চায়? ধর্মত্যাগিনী কৈকেয়ী শুধু এর ব্যতিক্রম। লোভী ব্যক্তি কখনও অভক্ষ্য ভোজ্য গ্রহণ করেও সেই ভোজ্যদ্রব্যের কোন দোষ খুঁজে পায় না। হায় সেই কুব্জা এই রঘুবংশ ধ্বংসের কারণ। সীতার পিতা জনক যখন শুনবেন, রাজা দশরথ অযৌক্তিক নিয়োগবিধি আশ্রয় করে সস্ত্রীক রামকে নির্বাসিত করেছেন তখন তিনিও কৌশল্যার মতোই পরিতাপ করবেন। রাম জানলেন না — মা বিধবা হয়েছেন। বিদেহরাজকন্যার কী এমন দুঃখভোগ সাজে? সুখযাপনে অভ্যস্তা সীতা অরণ্যে না জানি কত উদ্বিগ্ন হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। রাতের অন্ধকারে, পশুপাখিদের ভয়ঙ্কর শব্দে, ভীতা সীতা নিশ্চয়ই রামকে আশ্রয় করে আছেন। বৃদ্ধ, অপুত্রক, পিতা, বিদেহরাজ জনক,বৈদেহীর বিষয়ে নিরন্তর চিন্তা করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করবেন। পতিব্রতা স্ত্রীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেবী কৌশল্যাও স্বামীর শব আলিঙ্গন করে আগুনে প্রবশ করবেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

ব্যবহারিক অমাত্যদের নির্দেশানুসারে ক্রন্দনরতা রানিকে সরিয়ে নেওয়া হল। অমাত্যরা রাজার শবদেহ তেলপূর্ণ দ্রোণী বা কাঠের বৃহদাকার পাত্রে রাখলেন এবং অবশিষ্ট কাজগুলি সম্পন্ন করলেন। সব কর্মে বিশারদ অমাত্যরা, পুত্রের অনুপস্থিতিতে রাজার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে ইচ্ছুক নন। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তেলপূর্ণ পাত্রে শায়িত রয়েছে রাজার মৃতদেহ। এ দৃশ্য দেখে মহিলারা আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, হা মৃতোঽয়মিতি হায় ইনি মৃত। শোকাবেগে কেউ বাহু তুলে বিলাপ করছেন, কারও অশ্রুপ্লাবিত মুখমণ্ডল যেন প্রস্রবণের উৎসমুখ,সেখানে নিরন্তর ঝরে পড়ছে জল।তাঁরা অনবরত বলে চলেছেন, হা মহারাজ রামেণ সততং প্রিয়বাদিনা। বিহীনাঃ সত্যসন্ধেন কিমর্থং বিজহাসি নঃ।।

হায় মহারাজ, আমরা সকলে এখন প্রিয়ভাষী সত্যপ্রতিজ্ঞ রামবিহীন। এ অবস্থায় আপনিও আমাদের পরিত্যাগ করলেন কেন? তাঁদের এখন নিত্য বৈধব্যদুঃখভোগ নির্দিষ্ট, তাঁরা কেমন করে দুষ্টা সতীন কৈকেয়ীর সঙ্গে বসবাস করবেন? রাম যে রাজার ও আমাদের প্রভু। এই রাজ্যশ্রী ত্যাগ করে শ্রীমান রাম বনবাসী হয়েছেন। আপনি ও সেই বীরশ্রেষ্ঠ রামকে ছাড়া বিপন্ন আমরা, কীভাবে কৈকেয়ীর দুর্বিষহ শাসনাধীন অবস্থায় এখানে বাস করব? ত্বয়া তেন চ বীরেণ বিনা ব্যসনমোহিতাঃ। কথং বয়ং নিবৎস্যামঃ কৈকেয্যা চ বিদূষিতাঃ।। যিনি রাজা,রাম এবং মহাবলী লক্ষ্মণ,সীতাকে পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন, তিনি যে কোন ব্যক্তিকে কী পরিত্যাগ করতে পারেন না? রাজার সুন্দরী পত্নীরা, বিপুল শোকে, বাষ্পাচ্ছন্ন মুখে, চরম নিরানন্দমনে, শ্বাস প্রশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

মহান রাজা দশরথবিহনে, স্বামীহারা স্ত্রী বা নক্ষত্রহীন রাত্রির মতোই নিষ্প্রভা অযোধ্যা নগরী। অশ্রুভারাক্রান্ত মনে রয়েছেন পুরবাসীরা, হাহাকার করছেন কুলনারীরা। পুরীর গৃহপ্রাঙ্গণে ও শেষভাগে শুধুই শূন্যতার অনুভূতি, অযোধ্যার সেই শোভার ঔজ্জ্বল্য আর নেই। পুত্রশোকহেতু প্রয়াত হয়েছেন রাজা দশরথ। প্রাসাদে রাজবধূরা ভূমিতলে লুণ্ঠিতা, অস্তমিত হলেন রবি, অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন নিশা।

সমবেত সুহৃদ্বর্গ স্থির করেছেন, পুত্ররা কাছে নেই, এই অবস্থায়, রাজার দাহকাজ সম্পন্ন করা, সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। অচিন্ত্যনীয় যাঁর ভাবমূর্তি এমন রাজার শব শায়িত রইল পূর্বপরিকল্পিত সংরক্ষণপাত্রে। রবিহীন অন্তরীক্ষ, তারকাবিহীন রজনীতুল্যা নিষ্প্রভা অযোধ্যানগরীর পথে প্রাঙ্গণে দলে দলে সমবেত নরনারীরা অশ্ররুদ্ধকণ্ঠে, ভরতজননীর অপবাদে সোচ্চার হলেন। নগরীর সেই জনসমাগমে, দুঃখিত মানুষদের ভিড়ে, কোনও শান্তি ছিল না।

রাজা দশরথ পুত্রশোকহেতু মৃত্যু বরণ করলেন। একদা সন্তানহারা পিতার অভিশাপ ফলপ্রসূ হল। রাজার নিজের স্বীকারোক্তিতে, এই অজ্ঞাত কাহিনির সত্যতা প্রকাশিত হয়েছে। পুত্রহীন রাজা হয়তো মুনির অভিশাপের অব্যর্থ, অমোঘ প্রতিক্রিয়ার সাফল্যের কারণেই পিতৃত্ব লাভ করেছিলেন। অভিশাপ হয়তো কখনও আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। রাজার পুত্রলাভ হল, অপর এক সন্তানহারা পিতার পুত্রশোকের কারণে। রাজা দশরথ, পুত্রকামনায় অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। সেখানেও একটি অশ্বকে হত্যার বিবরণ আছে। মৃগয়াবিহারী রাজার শরের লক্ষ্য ছিল একটি হাতি। দুটিই অবোধ প্রাণী। সেই সঙ্গে রাজার নিক্ষিপ্ত শরের দ্বারা বিদ্ধ হয়েছিলেন মুনিকুমার। তিনিও সেবাপরায়ণ নিষ্পাপ এক মুনিকুমার, পিপাসার্ত অসহায় বৃদ্ধ পিতামাতার তৃষ্ণার জল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পাত্রে জল ভরছিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এই তিনটি হত্যার একটিই যোগসূত্র —এরা সকলেই প্রাণী, ঘটনার প্রতিরোধ, তাদের আয়ত্তাধীন ছিল না। মুনিকুমারের পিতার কাছে, রাজা ক্ষমাপ্রার্থী হয়েছেন। অশ্ব মেধ বা হত্যা বৈদিক যজ্ঞের প্রক্রিয়ামাত্র, এ অজুহাত মজুদ আছেই, আর হাতির মৃত্যু হয়েছে শুধু বিনোদনের কারণে। মৃগয়ার মতো রাজাদের বিনোদন আছে কি? যে কোনও প্রাণীর জীবন বলিপ্রদত্ত সে যজ্ঞেই হোক বা বিনোদনের কারণেই হোক। সেখানে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে মরে শুধু। শুধু দৈবের বিধানের মতো কোনও আর্তের বেদনা ছুঁয়ে যায় যে অনুতপ্ত মন, তখন আর তাঁর পরিত্রাণের পথ থাকে না, রাজা দশরথের মতো।

বিশ্বস্তা অনুরক্তা পত্নী পাশে আছেন, আছেন অনুগত বশংবদ, গুণমুগ্ধ প্রজাবৃন্দ, তবু প্রবল মনঃকষ্টে প্রাণ হারালেন রাজা দশরথ। মৃত্যুকালে পাশে রইলেন না প্রাণপ্রিয় পুত্র রাম বা অন্য কোন পুত্র। এ হল সেই অদৃষ্ট আঘাত, মৃত্যুযোগ যা সময় বা পারিপার্শ্বিকের প্রভাবকে অস্বীকার করে, অপ্রতিহত গতিতে প্রবেশ করে জীবনে।

আধুনিক যাপনচিত্রে নতুন সংযোজন হল, প্রবাসীপুত্রের শেষদর্শনের অপেক্ষায় থাকা পিতার শব, নিত্য নৈমিত্তিক দিন আনা দিন খাওয়া প্রাত্যহিকতার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। রামায়ণের রাজকীয় যাপনেও তার ব্যতিক্রম নেই। পুত্রবিচ্ছেদে কাতর পিতার শব সংরক্ষিত হল তৈলপাত্রে। রানি কৈকেয়ীর বরপ্রার্থনা হয়তো উপলক্ষ্যমাত্র। দাসী মন্থরা ও রানি কৈকেয়ীর চক্রান্তের যোগসাযোগে রামের নির্বাসনপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। তাই কুমন্ত্রণাদাতারা আজও মন্থরার আর কুচক্রী দুষ্কর্মসাধকেরা চিরকালীন কৈকেয়ীর ভূমিকাতেই রয়ে গেলেন। রাজা দশরথের অগণিত স্ত্রী, স্বামীর মৃত্যুতে তাঁদের অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিয়েছে, রামমাতা কৈকেয়ী ও লক্ষ্মণজননী সুমিত্রার মতোই।

ছবি: প্রতীকী।

রাজাবিহীন রাজ্যে নিঃসহায় প্রজারাও হয়তো শাসকহীন রাজ্যের অস্তিত্বরক্ষাবিষয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন। ভরতজননী,যাঁর মর্যাদা প্রধানা মহিষীর থেকে কোন অংশে কম ছিল না, রাজা দশরথের প্রিয় রানি কৈকেয়ী, সকলেই জানেন রানি কৈকেয়ী ভাবী প্রশাসক ভরতের জননী, তবু জনকণ্ঠে রানির নিন্দা —এ যেন ছাইচাপা ক্রোধাগ্নির বিস্ফোরণ। এমনটাই ঘটে, জনমতের বিপরীতে যে সিদ্ধান্ত সেটি সর্বদাই সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।রাজার পারলৌকিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ভাবি উত্তরাধিকারের বিষয়টিও। তাই হয়তো বিচক্ষণ, বিশ্বস্ত মন্ত্রীরা রাজপুত্রের প্রত্যাবর্তনের আপেক্ষায় রাজা দশরথের মৃতদেহ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজতন্ত্রে অমীমাংসিত বিষয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন হয়তো কেবলমাত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী।

অনাথা রাজধানী,অনাথ প্রজাকুল,পিতৃহারা পুত্ররা জানলেন না পিতৃবিয়োগবৃত্তান্ত, সম্মুখে ঘোর দুর্দিন রাজশূন্য অযোধ্যানগরীর। পরিবারের মধ্যমণির মৃত্যুতে নিষ্প্রভ নিরানন্দময় হয়ে ওঠে পারিবারিক যাপন তেমনই রাজা দশরথের মৃত্যু এবং প্রিয় কাঙ্খিত ভাবি শাসকের নির্বাসন, বৃহত্তর প্রজাকেন্দ্রিক জীবনে এক অস্থিরতা এনে দিল। নিঃশেষিত হল শান্তির বাতাবরণ। এক প্রশাসকের শাসনকালের মেয়াদ হঠাৎ যদি ফুরিয়ে যায়,সম্মুখে নেই কোনও দক্ষ শাসক, তখন এমনই উদ্বেগ কাজ করে সাধারণের মানসিকতায়। দশরথের প্রয়াণদুঃখ এমনই সাধারণের মানসিতায় শোকের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এর রূপরেখার বিস্তার চিরন্তন,যা আজও হয়তো চলে আসছে।
—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content