ছবি: প্রতীকী।
রামের বনবাসের কারণ রাজা দশরথ। দোষারোপের শেষ নেই রামজননী রানি কৈকেয়ীর। মুহুর্মুহু তিরস্কারে বিদ্ধ রাজা দশরথ অচৈতন্য হয়েও চিন্তার থেকে তাঁর নিস্তার নেই। চিন্তান্বিত রাজা আকুল হয়ে আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন হলেন। তাঁর নিজের কী কোন অকাজের ফল ভোগ করছেন রাজা? তাঁর মনে পড়ল, অতীতে নিজের অজান্তে নিক্ষিপ্ত শব্দবেধী বাণ মর্মান্তিক এক মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, সে ঘটনা ভুলবেন কী করে?তার দরুণ অনুশোচনা ও রামের বিয়োগব্যথায়, শোকের দহনজ্বালায় দগ্ধ, অনুতপ্ত রাজা, জোড়হাতে, মাথা নীচু করে, কাঁপতে কাঁপতে রানিকে বললেন। মিনতি করি,তুমি প্রসন্ন হও। তুমিতো কখনও কারও প্রতি নির্দয় নও। স্বামী গুণবান বা নির্গুণ হন, ধার্মিক মহিলাদের স্বামীই প্রত্যক্ষ দেবতা। তাই তোমার মতো ধর্মপরায়ণার, লোকব্যবহারের এই নিন্দিত ও প্রশংসনীয় বিষয়গুলি জেনেও, এমন দুঃসময়ে, দুঃসহ যন্ত্রণায়, আমার উদ্দেশ্যে, বিরূপ মন্তব্য করা উচিত নয়। সা ত্বং ধর্ম্মপরা নিত্যং দৃষ্টলোকপরাবরা।নার্হসে বিপ্রিয়ং বক্তুং দুঃখিতাপি সুদুঃখিতম্।।*
প্রণালীতে বয়ে যাওয়া নতুন জলধারার মতো অঝোরে কেঁদে চললেন রানি কৌশল্যা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্বামীর পাদুটি ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন রানি। ইহলোকে বা পরলোকে এমন কোন নারী স্ত্রীপদের যোগ্য নন, যাঁকে প্রসন্ন করতে হয় সম্মানীয় ও বুদ্ধিমান স্বামীটিকে। ধর্মিক রাজা দশরথ,ধর্মের তত্ত্বকথা জানেন, তিনি সত্যবাদী জেনেও, শোকাতুর রানি এই সব কঠোর কথা বলেছেন। শোক, ধৈর্য নাশ করে,বুদ্ধিনাশের কারণও শোক। শোক সর্বনাশের হেতু, শোকের মতো শত্রু আর নেই। শোকো নাশয়তে ধৈর্য্যং শোকো নাশয়তে শ্রুতম্।শোকো নাশয়তে সর্ব্বং নাস্তি শোকসমো রিপুঃ।।* শত্রুর হাতে প্রহার সহ্য করা যায়,অতি অল্প শোকও কিন্তু অসহনীয়। রামের বনবাসের পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে, শোকাহত নিরানন্দ আমার কাছে এই সময়টি যেন পাঁচটি বছর। বনবাসায় রামস্য পঞ্চরাত্রোঽত্র গণ্যতে। যঃ শোকাহতহর্ষায়াঃ পঞ্চবর্ষোপমো মম।। রাজা জানালেন, রামের চিন্তায় তাঁর শোক এখন বেগবতী নদীর জলে সমুদ্রের বর্ধিত জলস্ফীতির মতো। দেবী কৌশল্যার এই অনুশোচনা জ্ঞাপনের মধ্যে, সূর্যের কিরণ স্তিমিত হয়ে রাত ঘনিয়ে এল। কৌশল্যার কথায় সান্ত্বনা খুঁজে পেলেও, শোকবিধ্বস্ত রাজা, ক্রমে নিদ্রাতুর হলেন।
প্রণালীতে বয়ে যাওয়া নতুন জলধারার মতো অঝোরে কেঁদে চললেন রানি কৌশল্যা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্বামীর পাদুটি ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন রানি। ইহলোকে বা পরলোকে এমন কোন নারী স্ত্রীপদের যোগ্য নন, যাঁকে প্রসন্ন করতে হয় সম্মানীয় ও বুদ্ধিমান স্বামীটিকে। ধর্মিক রাজা দশরথ,ধর্মের তত্ত্বকথা জানেন, তিনি সত্যবাদী জেনেও, শোকাতুর রানি এই সব কঠোর কথা বলেছেন। শোক, ধৈর্য নাশ করে,বুদ্ধিনাশের কারণও শোক। শোক সর্বনাশের হেতু, শোকের মতো শত্রু আর নেই। শোকো নাশয়তে ধৈর্য্যং শোকো নাশয়তে শ্রুতম্।শোকো নাশয়তে সর্ব্বং নাস্তি শোকসমো রিপুঃ।।* শত্রুর হাতে প্রহার সহ্য করা যায়,অতি অল্প শোকও কিন্তু অসহনীয়। রামের বনবাসের পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে, শোকাহত নিরানন্দ আমার কাছে এই সময়টি যেন পাঁচটি বছর। বনবাসায় রামস্য পঞ্চরাত্রোঽত্র গণ্যতে। যঃ শোকাহতহর্ষায়াঃ পঞ্চবর্ষোপমো মম।। রাজা জানালেন, রামের চিন্তায় তাঁর শোক এখন বেগবতী নদীর জলে সমুদ্রের বর্ধিত জলস্ফীতির মতো। দেবী কৌশল্যার এই অনুশোচনা জ্ঞাপনের মধ্যে, সূর্যের কিরণ স্তিমিত হয়ে রাত ঘনিয়ে এল। কৌশল্যার কথায় সান্ত্বনা খুঁজে পেলেও, শোকবিধ্বস্ত রাজা, ক্রমে নিদ্রাতুর হলেন।
শোকাহত রাজা প্রকৃতিস্থ হয়েও রাহুগ্রস্ত সূর্যের মতো আবারও রামলক্ষ্মণের নির্বাসনজনিত বিষাদে আক্রান্ত হলেন। ইতিমধ্যে রামের নির্বাসনের পরে পাঁচ দিন অতিবাহিত হয়েছে। ছ’দিনের দিন অর্দ্ধরাতে অর্থাৎ রাত্রি দ্বিপ্রহরে চিন্তায় উদভ্রান্ত রাজা নিজের একদা কৃত দুষ্কর্মের বৃত্তান্ত স্মরণ করলেন। পুত্রশোকে বিহ্বলা, দেবী কৌশল্যার কাছে নিজের পাপরূপ দুষ্কর্মের কাহিনি ব্যক্ত করলেন। রাজার মতানুসারে, মানুষ সংসারে ভাল বা মন্দ যা কিছু কাজ করেন সেইমতো ফল ভোগ করে থাকেন। কোন কাজের ফলাফল না ভেবে যিনি কাজ করেন তিনি নেহাতই বালকমাত্র। যেমন, যে ব্যক্তি আমের বন কেটে ফেলে ফুলের আশায়, পলাশ গাছ বপন করেন, তিনি ফলাগমের সময়ে নিশ্চিতভাবে হাহুতাশ করে থাকেন। অপরিণামদর্শিতার ফল এমনই। প্রবল অনুশোচনায় রাজা স্বীকার করলেন, একই ভুল করেছেন তিনি। সোঽহমাম্রবনং ছিত্ত্বা পলাশাংশ্চ ন্যষেচয়ম্। রামং ফলাগমে ত্যক্ত্বা পশ্চাচ্ছোচামি দুর্ম্মতিঃ।। রাজার সেই একই দশা। সদ্য ফলাগমের কথা না ভেবে ওই আমের গাছটি কেটে ফেলে পলাশ গাছকেই জল সেচন করে পরিচর্যা করছেন আর পরিণামে অনুশোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন।
এ সবই রাজার নিজের দোষস্বীকারের ভূমিকা। রাজা, প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করে বললেন,কুমার অবস্থায় রাজা শব্দবেধীরূপে শব্দ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন, তার ফলে তিনি এক চরম গর্হিত পাপকাজ করে ফেলেছেন। একটি বালক যেমন নিজের অজ্ঞতার দরুণ মোহগ্রস্ত হয়ে বিষাক্তভোজ্য গ্রহণ করে, তেমনই নিজের কর্মের ফল তিনি ভোগ করছেন এখন।যেমন সাধারণ মানুষ পলাশগাছের কুসুমিত সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে ফলের প্রত্যাশী হয়, তেমনই শব্দবেধীর অদূরদর্শিতার পরিণাম বিষয়ে রাজা অজ্ঞ ছিলেন।
এ সবই রাজার নিজের দোষস্বীকারের ভূমিকা। রাজা, প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করে বললেন,কুমার অবস্থায় রাজা শব্দবেধীরূপে শব্দ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন, তার ফলে তিনি এক চরম গর্হিত পাপকাজ করে ফেলেছেন। একটি বালক যেমন নিজের অজ্ঞতার দরুণ মোহগ্রস্ত হয়ে বিষাক্তভোজ্য গ্রহণ করে, তেমনই নিজের কর্মের ফল তিনি ভোগ করছেন এখন।যেমন সাধারণ মানুষ পলাশগাছের কুসুমিত সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে ফলের প্রত্যাশী হয়, তেমনই শব্দবেধীর অদূরদর্শিতার পরিণাম বিষয়ে রাজা অজ্ঞ ছিলেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৭: যাজ্ঞসেনী স্বয়ংবরা দ্রৌপদী কি শুধুই প্রতিহিংসার বাতাবরণ বিনির্মাণ করেন?
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো
একদা কামনা জাগিয়ে তুলে বর্ষা উপস্থিতি হল। বর্ষা অবিবাহিত যুবক রাজার মনে প্রভাব বিস্তার করল। প্রখর কিরণে জগতে উত্তাপ বিকিরণ করে, নিঃশেষে পৃথিবীর রস শোষণের পরে, সূর্য, ভয়াবহ দক্ষিণ দিকে প্রস্থান করলেন। গ্রীষ্মের উত্তাপ অন্তর্হিত হল। আকাশে স্নিগ্ধ মেঘের ঘনঘটা। মণ্ডূক, হরিণ, ময়ূর সকলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। বর্ষার জলধারায় স্নাত হয়ে, পাখিরা ভেজা ডানা নিয়ে, অতি কষ্টে বৃষ্টি ও বায়ু বেগে কম্পমান গাছের প্রান্তবর্তী শাখায় আশ্রয় নিল।প্রমত্ত হরিণেরা পর্বতনিঃসৃত প্লাবিত জলধারায় সমাচ্ছন্ন হয়ে,যেন অচল জলধারার শোভা ধারণ করল। পার্বত্য ধাতুর সংস্পর্শে পাণ্ডুর,অরুণবর্ণের বিমল স্রোতধারা ভুজঙ্গের আঁকাবাঁকা গতিতে ছুটে চলল। সেই অতি উপভোগ্য বর্ষাকালে ব্যায়াম ও বাসনার বশবর্তী ধনুর্বাণ ও তূণ-সহ রথারূঢ় রাজা সরযূতীরে উপস্থিত হলেন। রাজার লক্ষ্য ছিল, রাত্রিতে জলপানের উদ্দেশ্যে সমাগত হাতি, মহিষ, হরিণ ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণীশিকার।
এমন এক ঘোর আঁধারপূর্ণ রাতে, যেখানে চোখর দৃষ্টিতে ধরা দেয় না কিছু, হাতির গর্জনের মতো শব্দ তুলে কেউ ঘটে জল ভরছিল। সেই শব্দ শুনে রাজার মনে হল কোন হাতি জল পান করছে। সঙ্গে সঙ্গে ঈপ্সিত লক্ষ্যে, দীপ্ত সাপের মতো বিষাক্ত, প্রদীপ্ত শর নিক্ষেপ করলেন রাজা। বাণ মুক্ত করামাত্র তৎক্ষণাৎ রাজা, জলে পড়ে যাওয়া কোনও বনবাসী মানুষের হা হা রবে, হৃদয়বিদারক আর্তনাদ শুনতে পেলেন। সেই শরাহত মানুষটি ব্যথিতকণ্ঠে বলে উঠল, জনহীন এই বনে জল নিতে এসেছিলেন যে নিরীহ তাপস তাঁকে কে শরবিদ্ধ করলেন? বাণাহত তিনি, কার? কী অপকার করেছেন? বন্য ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণকারী হিংসাহীন তপস্বীর এমন আঘাত কী প্রাপ্য? কে জটা ও অজিনধারী নিরপরাধকে হত্যা করতে পারে? এমন ব্যক্তির এই কাজ নিষ্ফল, শুধুই অনিষ্ট হবে তাঁর। গুরুপত্নীগামীর মতোই অসৎ এই ব্যক্তি। নিজের জীবনহানির কারণে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। আমার বধের ফলভোক্তা পিতা মাতা যাঁদের পালন করি আমি, তাঁদের অবস্থা চিন্তা করে, শুধু আমার দুঃখ হচ্ছে। নেমং তথানুশোচামি জীবিতক্ষয়মাত্মনঃ।। মাতরং পিতরঞ্চোভাবনুশোচামি মদ্বধে। তদেতন্মিথুনং বৃদ্ধং চিরকালভৃতং ময়া।।
এমন এক ঘোর আঁধারপূর্ণ রাতে, যেখানে চোখর দৃষ্টিতে ধরা দেয় না কিছু, হাতির গর্জনের মতো শব্দ তুলে কেউ ঘটে জল ভরছিল। সেই শব্দ শুনে রাজার মনে হল কোন হাতি জল পান করছে। সঙ্গে সঙ্গে ঈপ্সিত লক্ষ্যে, দীপ্ত সাপের মতো বিষাক্ত, প্রদীপ্ত শর নিক্ষেপ করলেন রাজা। বাণ মুক্ত করামাত্র তৎক্ষণাৎ রাজা, জলে পড়ে যাওয়া কোনও বনবাসী মানুষের হা হা রবে, হৃদয়বিদারক আর্তনাদ শুনতে পেলেন। সেই শরাহত মানুষটি ব্যথিতকণ্ঠে বলে উঠল, জনহীন এই বনে জল নিতে এসেছিলেন যে নিরীহ তাপস তাঁকে কে শরবিদ্ধ করলেন? বাণাহত তিনি, কার? কী অপকার করেছেন? বন্য ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণকারী হিংসাহীন তপস্বীর এমন আঘাত কী প্রাপ্য? কে জটা ও অজিনধারী নিরপরাধকে হত্যা করতে পারে? এমন ব্যক্তির এই কাজ নিষ্ফল, শুধুই অনিষ্ট হবে তাঁর। গুরুপত্নীগামীর মতোই অসৎ এই ব্যক্তি। নিজের জীবনহানির কারণে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। আমার বধের ফলভোক্তা পিতা মাতা যাঁদের পালন করি আমি, তাঁদের অবস্থা চিন্তা করে, শুধু আমার দুঃখ হচ্ছে। নেমং তথানুশোচামি জীবিতক্ষয়মাত্মনঃ।। মাতরং পিতরঞ্চোভাবনুশোচামি মদ্বধে। তদেতন্মিথুনং বৃদ্ধং চিরকালভৃতং ময়া।।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক
হাহাকার করে উঠলেন কুমার, তাঁর মৃত্যু হলে কীভাবে বাঁচবেন দুই বৃদ্ধবৃদ্ধা? অপরিণতবুদ্ধি পাপিষ্ঠের একটি তীর সকলের প্রাণ কেড়ে নিল। কে এমন কাজ করলেন? কেন স্ম নিহতাঃ সর্ব্বে সুবালেনাকৃতবুদ্ধিনা। রাজা দশরথ, স্ত্রীর কাছে অকপটে এই ঘটনা বর্ণনা করলেন সেইসঙ্গে নিজের কৃতকর্মের স্বীকারোক্তি ব্যক্ত করে চললেন। সেই গভীর রাতে ঋষিকুমারের করুণ বিলাপ শুনে ব্যথিত হলেন ধার্মিক রাজা। শোকবিহ্বল রাজার হাত থেকে খসে পড়ল ধনুর্বাণ। উদভ্রান্ত, শোকের আধিক্যে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজা, নিজের হীনমন্যতাহেতু প্রবল গ্লানিবোধে আচ্ছন্ন হলেন। রাজা সেই জায়গাটিতে হাজির হলেন। দেখলেন, সরযূতীরে পড়ে আছেন, বাণবিদ্ধ কোন ঋষিকুমার। তাঁর জটাভার এলিয়ে পড়েছে মাটিতে, জলপূর্ণ ঘটটি পড়ে আছে পাশে। পাংশুবর্ণ, রক্তাক্ত, বাণবিদ্ধ দেহে শুয়ে আছেন সেই মানুষটি। কুমার চোখ তুলে দেখলেন ভীত, অসুস্থচিত্ত রাজাকে।নিজের তেজে দহনজ্বালা সৃষ্টি করে, কঠোর বাক্য বলতে লাগলেন কুমার।
বনবাসী আমি।কী অপরাধ করেছি যে, জল আহরণ করতে এসে আপনার তীরে বিদ্ধ হলাম? একটিমাত্র বাণ আমার হৃদয় বিদ্ধ করল,সেই সঙ্গে আমার বৃদ্ধ পিতামাতাও নিহত হলেন। একেন খলু বাণেন মর্ম্মণ্যভিহতে ময়ি। দ্বাবন্ধৌ নিহতৌ বৃদ্ধৌ মাতা জনয়িতা চ মে।। সেই দুজনের দুর্বলশরীর এবং তাঁরা অন্ধ।তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পুত্রের প্রতীক্ষায় তাঁরা দীর্ঘক্ষণ তৃষ্ণা সহ্য করে রয়েছেন। তপস্যা ও বেদনিষ্ঠতার ফল নিশ্চয়ই নেই। তা না হলে পিতা এখনও জানেন না যে আমি এখানে ভূমিশয্যায় পড়ে আছি। স নূনং তপসো নাস্তি ফলযোগঃ শ্রুতস্য বা। পিতা যন্মাং ন জানীতে শয়ানং পতিতং ভুবি।।
জানলেও কী করতে পারতেন পিতা? একটি গাছ যেমন ভগ্নপ্রায় অন্য গাছকে রক্ষা করতে পারে না তেমনই চলচ্ছক্তিহীন, তিনি যে অক্ষম। আমার পিতার কাছে সত্বর গিয়ে এই ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত করুন নতুবা বায়ুবেগে বর্দ্ধিত দাবানলসম পিতার ক্রোধ আপনাকে দগ্ধ করবে। ঋষিকুমার একটি সংক্ষিপ্ত পথনির্দেশ দিয়ে বললেন, কাল বিলম্ব না করে সেই পথ ধরে তাঁর পিতার সঙ্গে দেখা করে রাজা তাঁকে প্রসন্ন করুন যাতে ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ না দেন। তং প্রসাদয় গত্বা ত্বং ন ত্বাং সঙ্কুপিতঃ শপেৎ। রাজার নিক্ষিপ্ত মর্মে বিদ্ধ শাণিত তীরটি বড়ই কষ্ট দিচ্ছে। তীরটি থেকে আমায় মুক্ত করুন। বিশল্যং কুরু মাং রাজন্ মর্ম্ম মে নিশিতঃ শরঃ।
বনবাসী আমি।কী অপরাধ করেছি যে, জল আহরণ করতে এসে আপনার তীরে বিদ্ধ হলাম? একটিমাত্র বাণ আমার হৃদয় বিদ্ধ করল,সেই সঙ্গে আমার বৃদ্ধ পিতামাতাও নিহত হলেন। একেন খলু বাণেন মর্ম্মণ্যভিহতে ময়ি। দ্বাবন্ধৌ নিহতৌ বৃদ্ধৌ মাতা জনয়িতা চ মে।। সেই দুজনের দুর্বলশরীর এবং তাঁরা অন্ধ।তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পুত্রের প্রতীক্ষায় তাঁরা দীর্ঘক্ষণ তৃষ্ণা সহ্য করে রয়েছেন। তপস্যা ও বেদনিষ্ঠতার ফল নিশ্চয়ই নেই। তা না হলে পিতা এখনও জানেন না যে আমি এখানে ভূমিশয্যায় পড়ে আছি। স নূনং তপসো নাস্তি ফলযোগঃ শ্রুতস্য বা। পিতা যন্মাং ন জানীতে শয়ানং পতিতং ভুবি।।
জানলেও কী করতে পারতেন পিতা? একটি গাছ যেমন ভগ্নপ্রায় অন্য গাছকে রক্ষা করতে পারে না তেমনই চলচ্ছক্তিহীন, তিনি যে অক্ষম। আমার পিতার কাছে সত্বর গিয়ে এই ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত করুন নতুবা বায়ুবেগে বর্দ্ধিত দাবানলসম পিতার ক্রোধ আপনাকে দগ্ধ করবে। ঋষিকুমার একটি সংক্ষিপ্ত পথনির্দেশ দিয়ে বললেন, কাল বিলম্ব না করে সেই পথ ধরে তাঁর পিতার সঙ্গে দেখা করে রাজা তাঁকে প্রসন্ন করুন যাতে ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ না দেন। তং প্রসাদয় গত্বা ত্বং ন ত্বাং সঙ্কুপিতঃ শপেৎ। রাজার নিক্ষিপ্ত মর্মে বিদ্ধ শাণিত তীরটি বড়ই কষ্ট দিচ্ছে। তীরটি থেকে আমায় মুক্ত করুন। বিশল্যং কুরু মাং রাজন্ মর্ম্ম মে নিশিতঃ শরঃ।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬০: শ্রীমার রামেশ্বরম যাত্রা
সেই অনুরোধ শুনে দোটানায় পড়লেন রাজা। শরবিদ্ধ কুমার অশেষ কষ্ট ভোগ করছেন ঠিকই, কিন্তু বাণটি তুলে নিলেই তিনি মারা যাবেন। এই দোলাচলপূর্ণ চিন্তায়, রাজা দুঃখে, শোকে, দৈন্য অনুভব করলেন। রাজার এই ভাব লক্ষ্য করে, সেই পরমার্থজ্ঞানী, অশক্ত, অবসন্ন, চেষ্টারহিত, বিবশাঙ্গ ঋষিকুমার বললেন, আমি ধৈর্য সহকারে শোক স্তিমিত করে স্থিরচিত্ত হয়েছি। ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপবোধ মন থেকে দূর করুন। ব্রহ্মহত্যাকৃতং তাপং হৃদয়াদপনীয়তাম্।
তিনি রাজাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি নিজে ব্রাহ্মণ নন।বৈশ্য পিতার ঔরসে শূদ্রা মায়ের গর্ভজাত কুমার তিনি। কাজেই মনোবেদনার কোনও কারণ নেই। কষ্টসহকারে এই কথা বলতে বলতে মর্মে বাণবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুণ্ঠিত ঋষিকুমার, নিশ্চেষ্ট হয়ে কাঁপতে থাকলেন। রাজা তাঁর বুক থেকে তীরটি তুলে নিলেন।সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে রাজার দিকে তাকিয়ে প্রাণ ত্যাগ করলেন সেই তপস্বী।জলসিক্ত দেহে, মর্মে গভীর আঘাত নিয়ে, অতিকষ্টে বিলাপরত ঋষিকুমার ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে,সরযূতীরে অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন। এই দৃশ্য দেখে রাজার বিষণ্ণতার যেন শেষ নেই আর।
তিনি রাজাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি নিজে ব্রাহ্মণ নন।বৈশ্য পিতার ঔরসে শূদ্রা মায়ের গর্ভজাত কুমার তিনি। কাজেই মনোবেদনার কোনও কারণ নেই। কষ্টসহকারে এই কথা বলতে বলতে মর্মে বাণবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুণ্ঠিত ঋষিকুমার, নিশ্চেষ্ট হয়ে কাঁপতে থাকলেন। রাজা তাঁর বুক থেকে তীরটি তুলে নিলেন।সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে রাজার দিকে তাকিয়ে প্রাণ ত্যাগ করলেন সেই তপস্বী।জলসিক্ত দেহে, মর্মে গভীর আঘাত নিয়ে, অতিকষ্টে বিলাপরত ঋষিকুমার ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে,সরযূতীরে অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন। এই দৃশ্য দেখে রাজার বিষণ্ণতার যেন শেষ নেই আর।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা
একে প্রিয় পুত্রকে অনৈতিকভাবে বনবাসে পাঠিয়ে রাজা দশরথের অনুশোচনার শেষ নেই। তার ওপরে আছে রানির ভর্ৎসনা। রানি কৌশল্যা ক্রমান্বয়ে রাজা দশরথকে দোষারোপ করেছেন। সেই অনবরত আঘাত, রাজার, অসহনীয় মনে হয়েছে। আঘাতের পর আঘাতে বেদনাতুর রাজার শুরু হল অতীতের কৃত কর্মফলের চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ। প্রিয়জনের কাছে স্বীকারোক্তিতে আছে কিছুটা হলেও দোষমুক্তির নির্মল আভাস। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতায় আছে দাম্পত্য প্রেমের উন্মেষ। ধার্মিক রাজা দশরথ শোকের যাথার্থ্য অনুধাবন করেছেন। সত্যিই শোকের অভিঘাত ধৈর্যের স্থৈর্য নষ্ট করে,বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা হ্রাস করে। শোকের সর্বগ্রাসী পরিণাম রাজার নিজের জীবনের উপলব্ধ সত্য। তিনি অপরাধবোধে ভুগছিলেন। যে দুষ্কর্মের বোঝা অবদমিত ছিল আজ তা প্রকট হল। শোক মানুষকে আত্মশুদ্ধির সুযোগ এনে দেয়। রানির কাছে রাজা দশরথ মনের বদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছেন। প্রাণীভ্রমে নিজের অজান্তে ঋষিকুমারকে বধের বৃত্তান্ত অকপটে বর্ণনা করে, তিনি যেন সুগভীর পুত্রশোকের তীব্রতা লঘু করতে চেয়েছেন।
ছবি: প্রতীকী।
মৃগয়াসক্তিতে রাজাদের শাস্ত্রীয় নিষেধ আছে। বিনোদনের কারণে পশুবধ, চিরকাল নিন্দিত গর্হিত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পিতামাতার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, ঋষিকুমার, ওই অবোধ প্রাণীদের মতোই সরল, নিষ্পাপ।একটি হাতিভ্রমে রাজা তাঁকে তীরবিদ্ধ করলেন। এ যেন ক্রৌঞ্চবধের পুনরাবৃত্তি। শুধু পরিবর্তিত হয়েছে পরিস্থিতি ও শিকারী।নিষাদ, ক্রৌঞ্চকে হত্যা করেছিল জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে।রাজা,বর্ষায় অবসর বিনোদনের মাধ্যমরূপে, পরীক্ষামূলকভাবে শব্দবেধী বাণ নিক্ষেপ করে, অবোধ প্রাণীবধে উদ্যোগী হয়েছেন। এটিও পরিবেশ প্রদূষণের নামান্তর। সেই তপস্বী ঋষিকুমার যেন অবোধ প্রাণীর প্রতীক।মনে হয়,মহর্ষি বাল্মীকি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন রাজার সঙ্গে মিলনোন্মুখ ক্রৌঞ্চের হত্যাকারী নিষাদের কোনও পার্থক্য নেই।বিষাক্ত শাণিত তীর শব্দ অনুসরণ করে লক্ষ্য বিদ্ধ করে।তীক্ষ্ণ শর সন্ধানের লক্ষ্য শুধুমাত্র শব্দ সৃষ্টিকারী প্রাণী। তীরের লক্ষ্য সেই প্রাণী নিজের অজ্ঞাতসারে প্রাণ হারায়, শুধু শিকারীর শিকারমাধ্যমের শব্দসন্ধানের কারণে।এ যেন জীবন নিয়ে ছেলেখেলা। সাধারণেরতো নয়ই শাসকেরও এই নির্মম বিনোদনের অধিকার আছে কী? এ বোধ হয় যুগান্তরেও সমালোচনার বিষয়।
নিরপরাধ যে কোনও প্রাণীবধ গর্হিত সামাজিক অপরাধ, যা সংবেদনশীল শিকারীর মর্মান্তিক প্রাণঘাতী অনুশোচনার কারণ হতে পারে। ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ, বেদনাবিধুর আবহ, ঘিরে রেখেছে রামায়ণের প্রেক্ষিত।তার প্রলম্বিত ছায়া এখনও প্রসারিত হয় ভারতীয়দের জীবন ও যাপনে। অক্ষম, পিপাসার্ত পিতামাতা সন্তানের তৃষ্ণার জলের প্রতীক্ষায় থাকেন, ফিরে আসে তার মৃতদেহ। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয় সংবেদনশীল মন, বিচারক নিজেই অপরাধী হলে এই অপরাধের ন্যায়দণ্ড দেবেন কে? ভুলক্রমে হলেও যে কোনও জীবনহানিই শোকের এবং সামাজিক সুস্থিতির পরিপন্থী। তাই ঘৃণ্য এই প্রাণীবধ—মানুষ বা ইতর প্রাণীর হত্যা, যাই হোক। ক্ষতিকর নয় এমন প্রাণ সর্বদাই মূল্যবান। মুনিকুমারের পরিবর্তে যদি শব্দবেধী বাণে বিদ্ধ হত কোন হাতি, যে ছিল রাজার লক্ষ্যবস্তু, তবে হয়তো রাজা, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতেন না। অবোধ সরল হাতি ও অসহায় মুনিকুমারের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে কী? পাঠকবন্ধুরাই তার বিচার করবেন।—চলবে।
নিরপরাধ যে কোনও প্রাণীবধ গর্হিত সামাজিক অপরাধ, যা সংবেদনশীল শিকারীর মর্মান্তিক প্রাণঘাতী অনুশোচনার কারণ হতে পারে। ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ, বেদনাবিধুর আবহ, ঘিরে রেখেছে রামায়ণের প্রেক্ষিত।তার প্রলম্বিত ছায়া এখনও প্রসারিত হয় ভারতীয়দের জীবন ও যাপনে। অক্ষম, পিপাসার্ত পিতামাতা সন্তানের তৃষ্ণার জলের প্রতীক্ষায় থাকেন, ফিরে আসে তার মৃতদেহ। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয় সংবেদনশীল মন, বিচারক নিজেই অপরাধী হলে এই অপরাধের ন্যায়দণ্ড দেবেন কে? ভুলক্রমে হলেও যে কোনও জীবনহানিই শোকের এবং সামাজিক সুস্থিতির পরিপন্থী। তাই ঘৃণ্য এই প্রাণীবধ—মানুষ বা ইতর প্রাণীর হত্যা, যাই হোক। ক্ষতিকর নয় এমন প্রাণ সর্বদাই মূল্যবান। মুনিকুমারের পরিবর্তে যদি শব্দবেধী বাণে বিদ্ধ হত কোন হাতি, যে ছিল রাজার লক্ষ্যবস্তু, তবে হয়তো রাজা, অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতেন না। অবোধ সরল হাতি ও অসহায় মুনিকুমারের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে কী? পাঠকবন্ধুরাই তার বিচার করবেন।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।