ছবি: প্রতীকী।
মহাভারতের নামমাহাত্ম্য বিচিত্র। গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণের নাম নিয়ে ভারি গর্ব ছিল। কারণ তাঁর রথটি ছিল, অঙ্গারবৎ ভাস্বরং দুস্পর্শঞ্চ পর্ণং বাহনং রথো যস্য সোঽঙ্গারপর্ণঃ। অঙ্গারের ন্যায় ভাস্বর, যাকে স্পর্শ করা যায় না এমন বাহন যাঁর তিনি অঙ্গারপর্ণ। রথ নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল,এর মূলে ছিল প্রবল আত্মগৌরববোধ। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন সেই রথটি দগ্ধ করলেন। অঙ্গারপর্ণের দর্প চূর্ণ হল। তিনি ঘোষণা করলেন, আমি পরাজিত। অঙ্গারপর্ণ নামটি ত্যাগ কললাম। জনসমক্ষে সামর্থ্য ও নাম নিয়ে আর গর্বিত হব না। জিতোঽহং পূর্ব্বকং নাম মুঞ্চাম্যঙ্গারপর্ণতাম্। ন চ শ্লাঘে বলেনাঙ্গ! ন নাম্না জনসংসদি।। অঙ্গারপর্ণ এরপরে চিত্ররথ নামে অভিহিত হলেন।
অঙ্গারপর্ণ আরও একজন বিখ্যাত গুরুর কাহিনি শোনালেন। পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষদের এবং ইক্ষ্বাকুবংশের পুরোহিত বশিষ্ঠ, যাঁর তপস্যার প্রভাবে রাজা সম্বরণ সূর্যকন্যা তপতীকে স্ত্রীরূপে লাভ করেছিলেন, সেই মহর্ষি বশিষ্ঠের তপঃশক্তি ছিল অপরিসীম। তপস্যার শক্তিতে তিনি জয় করেছিলেন কাম ও ক্রোধ। কাম ও ক্রোধ ছিল যেন তাঁর ভৃত্যতুল্য, পদানত। অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করায়, তাঁর নাম হয়েছিল বশিষ্ঠ। ইন্দ্রিয়াণাং বশকরো বশিষ্ঠ ইতি চোচ্যতে।
বশিষ্ঠ জয় করেছিলেন দেবতা ও মানুষের অজেয় দুঃসাধ্য কাম ও ক্রোধ, এই দুয়ের বিস্তারে সহায়ক লোভ প্রভৃতি আন্তরশত্রু, সমস্ত লোক এবং সমস্ত দিক। তিনি এমন একজন, যিনি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যে তাঁর প্রধান শত্রু এবং তাঁর নিজের শতপুত্রহন্তা বিশ্বামিত্রের বংশ ধ্বংস করবার জন্যে ভয়ানক কোন কাজ করেননি। সংযম ছিল মহর্ষি বশিষ্ঠের মহত্বের ভূষণ। তিনি মৃত পুত্রদের পুনর্জীবনপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে যমের বিধান অমান্য করেননি। ইক্ষ্বাকুবংশের রাজাদের জিতেন্দ্রিয়, সংযমী মহর্ষি বশিষ্ঠকে পুরোহিতরূপে প্রাপ্তি ছিল পৃথিবীলাভের মতোই মহার্ঘ। মহর্ষি বশিষ্ঠ ছিলেন সূর্যবংশের রাজাদের যাজক, মহর্ষি সেই রাজাদের কল্যাণকামনায় যজ্ঞ করতেন।
অঙ্গারপর্ণ আরও একজন বিখ্যাত গুরুর কাহিনি শোনালেন। পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষদের এবং ইক্ষ্বাকুবংশের পুরোহিত বশিষ্ঠ, যাঁর তপস্যার প্রভাবে রাজা সম্বরণ সূর্যকন্যা তপতীকে স্ত্রীরূপে লাভ করেছিলেন, সেই মহর্ষি বশিষ্ঠের তপঃশক্তি ছিল অপরিসীম। তপস্যার শক্তিতে তিনি জয় করেছিলেন কাম ও ক্রোধ। কাম ও ক্রোধ ছিল যেন তাঁর ভৃত্যতুল্য, পদানত। অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করায়, তাঁর নাম হয়েছিল বশিষ্ঠ। ইন্দ্রিয়াণাং বশকরো বশিষ্ঠ ইতি চোচ্যতে।
বশিষ্ঠ জয় করেছিলেন দেবতা ও মানুষের অজেয় দুঃসাধ্য কাম ও ক্রোধ, এই দুয়ের বিস্তারে সহায়ক লোভ প্রভৃতি আন্তরশত্রু, সমস্ত লোক এবং সমস্ত দিক। তিনি এমন একজন, যিনি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যে তাঁর প্রধান শত্রু এবং তাঁর নিজের শতপুত্রহন্তা বিশ্বামিত্রের বংশ ধ্বংস করবার জন্যে ভয়ানক কোন কাজ করেননি। সংযম ছিল মহর্ষি বশিষ্ঠের মহত্বের ভূষণ। তিনি মৃত পুত্রদের পুনর্জীবনপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে যমের বিধান অমান্য করেননি। ইক্ষ্বাকুবংশের রাজাদের জিতেন্দ্রিয়, সংযমী মহর্ষি বশিষ্ঠকে পুরোহিতরূপে প্রাপ্তি ছিল পৃথিবীলাভের মতোই মহার্ঘ। মহর্ষি বশিষ্ঠ ছিলেন সূর্যবংশের রাজাদের যাজক, মহর্ষি সেই রাজাদের কল্যাণকামনায় যজ্ঞ করতেন।
ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ ছিলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র। তিনি ব্রহ্মর্ষি। তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী। সমসাময়িক রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে তাঁর শত্রুতার প্রাচীন কাহিনি সকলেই অবগত আছেন। মহাভারতে,অর্জুনের অনুরোধে, গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ কথিত এই জয়পরাজয়ের আখ্যানটিতে বশিষ্ঠের ঔদার্য এক নতুন মাত্রা যোগ করল।
কান্যকুব্জে ধার্মিক গাধিরাজার পুত্র বিশ্বামিত্র প্রচুর সৈন্যবলে বলী ছিলেন। শত্রুদমনকারীরূপে তাঁর খ্যাতি ছিল। একদা মন্ত্রীগণ পরিবৃত, মৃগয়াবিহারী রাজা বিশ্বামিত্র, শ্রান্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। সম্মানীয় রাজার যথাযথ অতিথিসৎকারের ব্যবস্থা করলেন মহর্ষি। মহর্ষি বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনী ছিল কামধুগ্ ধেনুঃ অর্থাৎ প্রার্থিত বস্তুর প্রদাত্রী। সে অতিথিসৎকারের জন্য মহর্ষির অভীষ্ট যা কিছু সব প্রদান করল। উপাদেয় ভোজ্যবস্তু ছাড়াও তালিকায় চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় যাবতীয়তো ছিলই, সপারিষদ রাজার সন্তুষ্টিবিধানের জন্য ছিল মহার্ঘ বিবিধ পরিধেয় বস্ত্র, রত্নসম্ভার প্রভৃতি।
পরিতৃপ্ত হলেন রাজা, মন্ত্রীগণ ও সৈন্যরা। পরম বিস্ময়ে বিশ্বামিত্র সেই অপরূপা কামধেনুকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কি তার রূপের জৌলুস। মাথা, কপাল, কানদুটি ও চোখদুটি নিয়ে প্রশস্ত পাঁচটি অঙ্গ। মাথা, গলা, গলকম্বল, লেজ, স্তন প্রভৃতি উন্নত অঙ্গ, ব্যাঙের নয়নের মতো চোখদুটি স্ফীত, সুগঠিত দেহ, অনিন্দ্য স্তনগুলি স্থূল, লেজ ও শিংদুটি সুচারু ও মনোহর, শঙ্কু আকৃতির দুটি। মাথা ও গলা পুষ্ট ও চওড়া, এমনই দৃষ্টিনন্দন আকৃতি নন্দিনীর। সপ্রশংস রাজা বিশ্বামিত্র, অর্বুদ অর্থাৎ দশ কোটি ধেনু ও তাঁর রাজ্যের বিনিময়ে মহর্ষির কাছে, নন্দিনীকে প্রার্থনা করলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন।
শুরু হল ক্ষত্রিয়ের বাহুবল এবং তপস্বী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের তেজের সংঘাত। প্রত্যাখ্যানে ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র জ্বলে উঠলেন, ক্ষত্রিয়ো২হং ভবান্ বিপ্রস্তপঃস্বাধ্যায়সাধনঃ।ব্রাহ্মণেষু কুতো বীর্য্যং প্রশান্তেষু ধৃতাত্মসু।। আমি ক্ষত্রিয়,আপনি ব্রাহ্মণ, তপস্যা ও বেদপাঠই আপনার কাজ।শমগুণান্বিত সংযতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণের শৌর্য কোথায়? এত সবের বিনিময়েও যখন অভীষ্ট সিদ্ধ হল না,তাহলে উপায়? স্বধর্ম্মং ন প্রহাস্যামি নেষ্যামি চ বলেন গাম্। নিজের ক্ষাত্রধর্মতো ত্যাগ করতে পারি না। বলপ্রয়োগ করেই গাভীটিকে হরণ করি।
কান্যকুব্জে ধার্মিক গাধিরাজার পুত্র বিশ্বামিত্র প্রচুর সৈন্যবলে বলী ছিলেন। শত্রুদমনকারীরূপে তাঁর খ্যাতি ছিল। একদা মন্ত্রীগণ পরিবৃত, মৃগয়াবিহারী রাজা বিশ্বামিত্র, শ্রান্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। সম্মানীয় রাজার যথাযথ অতিথিসৎকারের ব্যবস্থা করলেন মহর্ষি। মহর্ষি বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনী ছিল কামধুগ্ ধেনুঃ অর্থাৎ প্রার্থিত বস্তুর প্রদাত্রী। সে অতিথিসৎকারের জন্য মহর্ষির অভীষ্ট যা কিছু সব প্রদান করল। উপাদেয় ভোজ্যবস্তু ছাড়াও তালিকায় চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় যাবতীয়তো ছিলই, সপারিষদ রাজার সন্তুষ্টিবিধানের জন্য ছিল মহার্ঘ বিবিধ পরিধেয় বস্ত্র, রত্নসম্ভার প্রভৃতি।
পরিতৃপ্ত হলেন রাজা, মন্ত্রীগণ ও সৈন্যরা। পরম বিস্ময়ে বিশ্বামিত্র সেই অপরূপা কামধেনুকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কি তার রূপের জৌলুস। মাথা, কপাল, কানদুটি ও চোখদুটি নিয়ে প্রশস্ত পাঁচটি অঙ্গ। মাথা, গলা, গলকম্বল, লেজ, স্তন প্রভৃতি উন্নত অঙ্গ, ব্যাঙের নয়নের মতো চোখদুটি স্ফীত, সুগঠিত দেহ, অনিন্দ্য স্তনগুলি স্থূল, লেজ ও শিংদুটি সুচারু ও মনোহর, শঙ্কু আকৃতির দুটি। মাথা ও গলা পুষ্ট ও চওড়া, এমনই দৃষ্টিনন্দন আকৃতি নন্দিনীর। সপ্রশংস রাজা বিশ্বামিত্র, অর্বুদ অর্থাৎ দশ কোটি ধেনু ও তাঁর রাজ্যের বিনিময়ে মহর্ষির কাছে, নন্দিনীকে প্রার্থনা করলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন।
শুরু হল ক্ষত্রিয়ের বাহুবল এবং তপস্বী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের তেজের সংঘাত। প্রত্যাখ্যানে ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র জ্বলে উঠলেন, ক্ষত্রিয়ো২হং ভবান্ বিপ্রস্তপঃস্বাধ্যায়সাধনঃ।ব্রাহ্মণেষু কুতো বীর্য্যং প্রশান্তেষু ধৃতাত্মসু।। আমি ক্ষত্রিয়,আপনি ব্রাহ্মণ, তপস্যা ও বেদপাঠই আপনার কাজ।শমগুণান্বিত সংযতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণের শৌর্য কোথায়? এত সবের বিনিময়েও যখন অভীষ্ট সিদ্ধ হল না,তাহলে উপায়? স্বধর্ম্মং ন প্রহাস্যামি নেষ্যামি চ বলেন গাম্। নিজের ক্ষাত্রধর্মতো ত্যাগ করতে পারি না। বলপ্রয়োগ করেই গাভীটিকে হরণ করি।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা
বশিষ্ঠ জানেন, রাজা বিশ্বামিত্র সৈন্যপরিবৃত এবং বাহুবলে বলী ক্ষত্রিয়। তাই যথেচ্ছসি তথা ক্ষিপ্রং কুরু মা ত্বং বিচারয়। আপনার যা ইচ্ছে, সেটাই দ্রুত করুন, বেশি বিচারবিবেচনা করবেন না।রাজা বিশ্বামিত্র তৎক্ষণাৎ যেমনটি ভেবেছেন সেটাই কাজে পরিণত করতে উঠে পড়ে লাগলেন। হংস এবং চন্দ্রতুল্য শুভ্র সবল নন্দিনীকে হরণ করতে তৎপর হলেন। তিনি কশাঘাতে অবাধ্য নন্দিনীকে ইতস্ততঃ চালনা করলেন। লাঠির আঘাতের তাড়নায় অতিষ্ঠ নন্দিনী হাম্বারবে চিৎকার করতে করতে সোজা মহর্ষির কাছে উপস্থিত হয়ে মুনির দিকে চেয়ে রইল।
বশিষ্ঠ অত্যাচারিতা নন্দিনীর ব্যথিত চিৎকার শুনেছেন কিন্তু সেই বিষয়ে কিছুই করার নেই তাঁর, কারণ তিনি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ। কিং কর্ত্তব্যং ময়া তত্র ক্ষমাবান্ ব্রাহ্মণো হ্যহম্। সৈন্যদের অত্যাচারে উদ্বিগ্ন নন্দিনী গভীর দুঃখে জানাল, সে অনাথা তাই তাকে বিশ্বামিত্রের সৈন্যরা চাবুক দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করছে। সে দুঃখে কাঁদছে। এই সব কিছুকে উপেক্ষা করছেন কেন? কিমুপেক্ষসে। এই ব্যাকুল কাতরোক্তিতে ক্ষমাশীল মহর্ষি কিন্তু একটুও ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হলেন না। তাঁর উপলব্ধিতে, ক্ষত্রিয়ের বল তাঁর তেজস্বিতা, আর ব্রাহ্মণের বল তাঁর ক্ষমাগুণ। যেহেতু ক্ষমা এখন তাঁর নিজের আয়ত্তাধীন তাই নন্দিনী যেথায় খুশী যেতে পারে।
নন্দিনী অভিমানভরে বলল,এমন কথা বলছেন,আপনি কী আমায় ত্যাগ করলেন? যদি তা না হয়, তবে কেউ আমাকে বল প্রয়োগ করে নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্নু ত্যক্তাস্মি ভগবন্!যদেবং ত্বং প্রভাষসে। অত্যক্তাহং ত্বয়া ব্রহ্মন্! নেতুং শক্যা ন বৈ বলাৎ।। বশিষ্ঠ নন্দিনীকে ত্যাগ করেননি। বললেন, পারলে থেকে যাও স্থীয়তাং যদি শক্যতে কিন্তু নন্দিনীর বাছুরটিকে যে সজোরে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওরা।এবার মহর্ষি বশিষ্ঠের সম্মতি পেয়ে, নন্দিনী মাথা ও গলা বাঁকিয়ে, ভয়ঙ্করাকৃতি ধারণ করল। ক্রোধরক্তিম নয়নে, ঘন ঘন হাম্বারবে, নন্দিনী, বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়া করল। সৈন্যদের চাবুকের আঘাতে আরও রেগে লেজ থেকে অবিরাম জ্বলন্ত কাঠের আগুন বর্ষণ করতে থাকল। তার ক্রোধদীপ্ত আকৃতি হল মধ্যাহ্নকালীন সূর্যতুল্য।
বশিষ্ঠ অত্যাচারিতা নন্দিনীর ব্যথিত চিৎকার শুনেছেন কিন্তু সেই বিষয়ে কিছুই করার নেই তাঁর, কারণ তিনি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ। কিং কর্ত্তব্যং ময়া তত্র ক্ষমাবান্ ব্রাহ্মণো হ্যহম্। সৈন্যদের অত্যাচারে উদ্বিগ্ন নন্দিনী গভীর দুঃখে জানাল, সে অনাথা তাই তাকে বিশ্বামিত্রের সৈন্যরা চাবুক দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করছে। সে দুঃখে কাঁদছে। এই সব কিছুকে উপেক্ষা করছেন কেন? কিমুপেক্ষসে। এই ব্যাকুল কাতরোক্তিতে ক্ষমাশীল মহর্ষি কিন্তু একটুও ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হলেন না। তাঁর উপলব্ধিতে, ক্ষত্রিয়ের বল তাঁর তেজস্বিতা, আর ব্রাহ্মণের বল তাঁর ক্ষমাগুণ। যেহেতু ক্ষমা এখন তাঁর নিজের আয়ত্তাধীন তাই নন্দিনী যেথায় খুশী যেতে পারে।
নন্দিনী অভিমানভরে বলল,এমন কথা বলছেন,আপনি কী আমায় ত্যাগ করলেন? যদি তা না হয়, তবে কেউ আমাকে বল প্রয়োগ করে নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্নু ত্যক্তাস্মি ভগবন্!যদেবং ত্বং প্রভাষসে। অত্যক্তাহং ত্বয়া ব্রহ্মন্! নেতুং শক্যা ন বৈ বলাৎ।। বশিষ্ঠ নন্দিনীকে ত্যাগ করেননি। বললেন, পারলে থেকে যাও স্থীয়তাং যদি শক্যতে কিন্তু নন্দিনীর বাছুরটিকে যে সজোরে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওরা।এবার মহর্ষি বশিষ্ঠের সম্মতি পেয়ে, নন্দিনী মাথা ও গলা বাঁকিয়ে, ভয়ঙ্করাকৃতি ধারণ করল। ক্রোধরক্তিম নয়নে, ঘন ঘন হাম্বারবে, নন্দিনী, বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের তাড়া করল। সৈন্যদের চাবুকের আঘাতে আরও রেগে লেজ থেকে অবিরাম জ্বলন্ত কাঠের আগুন বর্ষণ করতে থাকল। তার ক্রোধদীপ্ত আকৃতি হল মধ্যাহ্নকালীন সূর্যতুল্য।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
নন্দিনীর লেজ থেকে পহ্নব জাতির, ঘাম হতে দ্রাবিড় ও শক, যোনি থেকে যবন, শকৃত অর্থাৎ বিষ্ঠা থেকে শবর জাতির উদ্ভব হল।দুই পাশের শরীর থেকে পৌণ্ড্র, কিরাত, যবন, সিংহল, বর্বর, খশদের সৃষ্টি হল। মুখের ফেনা ও দুধের ফেনা থেকে চিবুক, পুলিন্দ, চিন, হূন, কেরল ও বহু ম্লেচ্ছদের উদ্ভব হল। নানাবর্ণের আবরণে সজ্জিত, অস্ত্রধারী পাঁচ সাতজন ম্লেচ্ছ সৈন্য, একেকজন বিশ্বামিত্রের সৈন্যকে ঘিরে ধরল। বিশ্বামিত্রের সম্মুখেই এসব ঘটে গেল। সেই অস্ত্রবর্ষণের ফলে, আহত বিশ্বামিত্রের সৈন্যরা বিশ্বামিত্রের সম্মুখেই পরাজয় বরণ করল। মহর্ষি বশিষ্ঠের সৈন্যরা কিন্তু বিশ্বামিত্রের কোনও সৈন্যের প্রাণ হরণ করল না। দূরে অবস্থান করে, নন্দিনী বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের দমন করল।
সৈন্যদের পরাজয় সহ্য করতে পারলেন না বিশ্বামিত্র। পরিত্রাতা কাউকে না পেয়ে ভীত, উদ্বিগ্ন সৈন্যদের আর্ত চিৎকারে ক্রুদ্ধ, বিশ্বামিত্র স্বয়ং বশিষ্ঠের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করলেন। আকাশ পৃথিবী পরিব্যাপ্ত করে বশিষ্ঠের প্রতি শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ একখানি বাঁশের লাঠির সাহায্যে বিশ্বামিত্রের নিক্ষিপ্ত ভয়ঙ্কর নারাচ, ক্ষুর, ভল্ল প্রভৃতি অস্ত্র ব্যর্থ করলেন। যুদ্ধে বশিষ্ঠের এই অস্ত্র প্রতিহত করবার কর্মকুশলতা দেখে, বিশ্বামিত্র ক্রোধে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠের উদ্দেশ্যে আগ্নেয়, বারুণ, ঐন্দ্র, যাম্য, বায়ব্য প্রভৃতি অস্ত্র বর্ষণ করতে লাগলেন। যেন যুগান্তরের প্রলয়কালীন সূর্যের আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সেই অস্ত্রগুলি। মৃদু হেসে, মহর্ষি বশিষ্ঠ ব্রহ্মতেজোময় যষ্টির মাধ্যমে সেই সব অস্ত্র প্রতিহত করলেন। বিশ্বামিত্র প্রযুক্ত সমস্ত অস্ত্র ভস্মীভূত হল।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অস্ত্র ধ্বংস করে, যেন তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, নির্জ্জিতোঽসি মহারাজ!দুরাত্মন্! গাধিনন্দন!। যদি তেঽস্তি পরং শৌর্য্যং তদ্দর্শয় ময়ি স্থিতে।। হে দুরাত্মা, গাধিপুত্র, আপনি পরাজিত হয়েছেন। আর কোন পরাক্রম অবশিষ্ট আছে কী? সেটি দেখান। আশ্চর্য ব্রহ্মতেজের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে, বিশ্বামিত্র প্রবল আত্মগ্লানি বোধ করলেন। নিজের ক্ষাত্রতেজকে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠলেন, ধিগ্বলং ক্ষত্রিয়বলং ব্রহ্মতেজোবলং বলম্। বলাবলং বিনিশ্চিত্য তপ এব পরং বলম্।। ধিক্কার দিই এই ক্ষত্রিয়বলকে।
ব্রহ্মতেজোময় বলই একমাত্র বল। মনে হয়, কোনটি বল এবং কোনটিই বা অবল, বলাবলের এই তুলনায় নিশ্চিতরূপে তপস্যার শক্তিই শ্রেষ্ঠ বল। এরপর রাজা বিশ্বামিত্র সেই বিস্তৃত রাজ্য, দীপ্ত রাজ্যশ্রী, ভোগসর্বস্ব রাজোচিত জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে তপস্যায় মনোনিবেশ করলেন। অবশেষে রজর্ষি বিশ্বামিত্র তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করলেন। সমস্ত লোককে বিস্ময়াবিষ্ট করে, সকলকে তেজের দ্বারা অভিভূত করে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করলেন বিশ্বামিত্র। দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে একাসনে বসে সোমরস পান করলেন। এভাবেই নিজের অর্জিত শক্তিতে, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র হলেন ব্রহ্মর্ষি।
সৈন্যদের পরাজয় সহ্য করতে পারলেন না বিশ্বামিত্র। পরিত্রাতা কাউকে না পেয়ে ভীত, উদ্বিগ্ন সৈন্যদের আর্ত চিৎকারে ক্রুদ্ধ, বিশ্বামিত্র স্বয়ং বশিষ্ঠের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করলেন। আকাশ পৃথিবী পরিব্যাপ্ত করে বশিষ্ঠের প্রতি শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ একখানি বাঁশের লাঠির সাহায্যে বিশ্বামিত্রের নিক্ষিপ্ত ভয়ঙ্কর নারাচ, ক্ষুর, ভল্ল প্রভৃতি অস্ত্র ব্যর্থ করলেন। যুদ্ধে বশিষ্ঠের এই অস্ত্র প্রতিহত করবার কর্মকুশলতা দেখে, বিশ্বামিত্র ক্রোধে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠের উদ্দেশ্যে আগ্নেয়, বারুণ, ঐন্দ্র, যাম্য, বায়ব্য প্রভৃতি অস্ত্র বর্ষণ করতে লাগলেন। যেন যুগান্তরের প্রলয়কালীন সূর্যের আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সেই অস্ত্রগুলি। মৃদু হেসে, মহর্ষি বশিষ্ঠ ব্রহ্মতেজোময় যষ্টির মাধ্যমে সেই সব অস্ত্র প্রতিহত করলেন। বিশ্বামিত্র প্রযুক্ত সমস্ত অস্ত্র ভস্মীভূত হল।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অস্ত্র ধ্বংস করে, যেন তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, নির্জ্জিতোঽসি মহারাজ!দুরাত্মন্! গাধিনন্দন!। যদি তেঽস্তি পরং শৌর্য্যং তদ্দর্শয় ময়ি স্থিতে।। হে দুরাত্মা, গাধিপুত্র, আপনি পরাজিত হয়েছেন। আর কোন পরাক্রম অবশিষ্ট আছে কী? সেটি দেখান। আশ্চর্য ব্রহ্মতেজের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে, বিশ্বামিত্র প্রবল আত্মগ্লানি বোধ করলেন। নিজের ক্ষাত্রতেজকে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠলেন, ধিগ্বলং ক্ষত্রিয়বলং ব্রহ্মতেজোবলং বলম্। বলাবলং বিনিশ্চিত্য তপ এব পরং বলম্।। ধিক্কার দিই এই ক্ষত্রিয়বলকে।
ব্রহ্মতেজোময় বলই একমাত্র বল। মনে হয়, কোনটি বল এবং কোনটিই বা অবল, বলাবলের এই তুলনায় নিশ্চিতরূপে তপস্যার শক্তিই শ্রেষ্ঠ বল। এরপর রাজা বিশ্বামিত্র সেই বিস্তৃত রাজ্য, দীপ্ত রাজ্যশ্রী, ভোগসর্বস্ব রাজোচিত জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে তপস্যায় মনোনিবেশ করলেন। অবশেষে রজর্ষি বিশ্বামিত্র তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করলেন। সমস্ত লোককে বিস্ময়াবিষ্ট করে, সকলকে তেজের দ্বারা অভিভূত করে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করলেন বিশ্বামিত্র। দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে একাসনে বসে সোমরস পান করলেন। এভাবেই নিজের অর্জিত শক্তিতে, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র হলেন ব্রহ্মর্ষি।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না
মহর্ষি বশিষ্ঠ ও রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের দ্বৈরথের মূলে ছিল মহর্ষির পালিতা গাভী নন্দিনী। একটি বাড়িতে গৃহপালিত প্রাণীকে কেন্দ্র করে সুখদুঃখের আবর্তন চলতেই থাক। পালিত প্রাণী, সন্তানতুল্য। পরিবারের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সে।তাকে হারাবার ভয়ে,শঙ্কা জন্মায়। সেই প্রাণীটির অনুপস্থিতি,এতটাই শোকাবহ,সন্তান হারানোর শোক থেকে কোন অংশে কম নয় সেই বিচ্ছেদবেদনা। নন্দিনী কামধেনু,যথেচ্ছ আনন্দদান, পার্থিব কামনাপূরণের সঙ্গে তুলনায়, এক নিক্তিতে বোধ হয় সমতুল্য। বশিষ্ঠের পালিতা কন্যাসমা নন্দিনীকে প্রার্থনা করেছেন একজন রাজা, তাঁর আছে রাজোচিত ক্ষাত্রতেজ ও সৈন্যবল।
প্রত্যাখ্যাত রাজা ভেবেছিলেন, যে কোনও মূল্যেই তিনি নন্দিনীকে অধিকার করবেন। কিন্তু রাজার আশায় জল ঢেলেছে নন্দিনী নিজে।একটি অনুগত প্রাণী, নিজের জীবন পণ করে, স্নেহের ঋণ পরিশোধ করে। সাধারণ জীবনে এ দৃষ্টান্ত বিরল নয়। নন্দিনীর আনুগত্য তার অনন্য দৃষ্টান্ত। এখন আধুনিক দ্বন্দ্বময় সামাজিক জীবনে গৃহকোণে একটি স্নেহপালিত প্রাণীর উপস্থিতি অনেক মানসিক ক্লেদ দূর করে। বিশ্বামিত্র ও তাঁর সৈন্যদের, নন্দিনীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, ক্ষমার অযোগ্য এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ভুক্ত, বলা যেতে পারে। একজন রাজার ক্ষমতার দম্ভ,একটি সংবেদনশীল প্রাণীর মনের দুঃখবোধকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রভু মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রিত নন্দিনী সকৃতজ্ঞ মনে এমনভাবে নিজের সুরক্ষায় বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে যেন কে আশ্রিত? ও কে আশ্রয়দাতা? এ বিষয়ে সংশয় দেখা দেয়।
ক্ষমাশীল মহর্ষি শত্রুতার প্রতিরোধে যখন নিষ্ক্রিয় তখন যেন পালিতা নন্দিনী আশ্রয়দাতা প্রভুর আশ্রয় হয়ে উঠেছে।সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার ভয়ানক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ প্রাথমিকভাবে শত্রুর প্রতি সজোরে আঘাত হেনেছে। রাজসিক অহমিকায় আঘাত লেগেছে। শেষ পর্যন্ত বশিষ্ঠের জয় যেন পালিতা নন্দিনীর বিজয় বলেই মনে হয়। এ বিজয় সকল প্রাণীদের প্রতি সমদর্শিতার নিরিখে সহানুভূতিশীল মনুষ্যত্বের জয়, যুগে যুগে মানুষের ‘জীবে প্রেম’ ও জীবের মানুষের প্রতি ভালবাসার একটি অনন্য উদাহরণ।
প্রত্যাখ্যাত রাজা ভেবেছিলেন, যে কোনও মূল্যেই তিনি নন্দিনীকে অধিকার করবেন। কিন্তু রাজার আশায় জল ঢেলেছে নন্দিনী নিজে।একটি অনুগত প্রাণী, নিজের জীবন পণ করে, স্নেহের ঋণ পরিশোধ করে। সাধারণ জীবনে এ দৃষ্টান্ত বিরল নয়। নন্দিনীর আনুগত্য তার অনন্য দৃষ্টান্ত। এখন আধুনিক দ্বন্দ্বময় সামাজিক জীবনে গৃহকোণে একটি স্নেহপালিত প্রাণীর উপস্থিতি অনেক মানসিক ক্লেদ দূর করে। বিশ্বামিত্র ও তাঁর সৈন্যদের, নন্দিনীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, ক্ষমার অযোগ্য এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ভুক্ত, বলা যেতে পারে। একজন রাজার ক্ষমতার দম্ভ,একটি সংবেদনশীল প্রাণীর মনের দুঃখবোধকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রভু মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রিত নন্দিনী সকৃতজ্ঞ মনে এমনভাবে নিজের সুরক্ষায় বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে যেন কে আশ্রিত? ও কে আশ্রয়দাতা? এ বিষয়ে সংশয় দেখা দেয়।
ক্ষমাশীল মহর্ষি শত্রুতার প্রতিরোধে যখন নিষ্ক্রিয় তখন যেন পালিতা নন্দিনী আশ্রয়দাতা প্রভুর আশ্রয় হয়ে উঠেছে।সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার ভয়ানক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ প্রাথমিকভাবে শত্রুর প্রতি সজোরে আঘাত হেনেছে। রাজসিক অহমিকায় আঘাত লেগেছে। শেষ পর্যন্ত বশিষ্ঠের জয় যেন পালিতা নন্দিনীর বিজয় বলেই মনে হয়। এ বিজয় সকল প্রাণীদের প্রতি সমদর্শিতার নিরিখে সহানুভূতিশীল মনুষ্যত্বের জয়, যুগে যুগে মানুষের ‘জীবে প্রেম’ ও জীবের মানুষের প্রতি ভালবাসার একটি অনন্য উদাহরণ।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও
মহাভারতের অনেক অধ্যায়েই, ক্ষমার অসীম গুণমহিমা কীর্তিত হয়েছে। বশিষ্ঠ তাঁর ব্যবহারিক জীবনে,কাজে ও জীবনাদর্শে ক্ষমাগুণকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বশিষ্ঠ সার্থকনামা মহর্ষি। ইন্দ্রিয়সংযম ছিল বলেই, অনায়াসে প্রবল প্রতিপক্ষের সামনেও নির্মোহ, উদাসীন থাকতে পেরেছেন। কন্যাসমা প্রিয় পালিতাকে অত্যাচারিতা হতে দেখেও ক্ষমাশীল ঔদাসীন্যে নিষ্ক্রিয় থেকেছেন। শত প্রলোভন জয় করে প্রিয় প্রাণীটিকে ক্ষমতাসীন শাসকের হাতে তুলে দেননি। এমন দৃষ্টান্ত হয়তো লৌকিক জীবনে বিরল নয়। বশিষ্ঠের বৈশিষ্ট হল রক্তচক্ষু শাসকের দম্ভময় চ্যালেঞ্জের প্রতি নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি। তিনি হয়তো জানতেন, ভালোবাসার শক্তি ও বলপ্রয়োগে ভালবাসাকে ছিনিয়ে নেওয়ার টানাপোড়েনের ফলাফল হল শর্তহীন প্রেমের জয়।
মননশীল মনে সংবেদনশীলতার অবাধ প্রবেশাধিকার। সেখানে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। অত্যাচারিতা নন্দিনীর চোখের জল মহর্ষির মনে রেখাপাত করেনি। মহর্ষি বশিষ্ঠের ন চুক্ষুভে তদা ধৈর্য্যান্ন চচাল ধৃতব্রতঃ। মনে ক্ষোভ নেই। এক মুহূর্তের জন্যেও বিচলিত নন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি মহর্ষি। আশ্রিতকে রক্ষা করতে না পারলে আত্মরক্ষার অধিকার যে তার আছে, এই সত্য মহাভারতের যুগেও সমাদৃত হোত নিশ্চয়ই। তাই বশিষ্ঠ, সেই অধিকার তুলে দিয়েছেন নন্দিনীর হাতে।
ক্ষমার গুণমাহাত্ম্য সব যুগে ও কালে প্রসঙ্গিক ও আলোচ্য বিষয়। যে যুদ্ধে প্রাণহানি নেই অথচ বিজেতা ও পরাজিত আছেন, বোধ হয়, এমন যুদ্ধজয় সম্ভব, যদি বিজয়ীর মনে ক্ষমার প্রাধান্য বিরাজ করে।
রামায়ণে মহর্ষি বশিষ্ঠ ও রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের কাহিনি হল উত্তরণের কাহিনি।রামায়ণে,রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের শত প্রতিকূলতা জয়ের মাধ্যমে ব্রহ্মর্ষির শিরোপালাভ, প্রাধান্য পেয়েছে।মহাভারতে বিশ্বামিত্রের তপঃশক্তির গরিমাকে ক্ষুণ্ণ করে মহর্ষি বশিষ্ঠ ও তাঁর অতি আদরের নন্দিনীর জয় যেন একসাথে কঠোর ও কোমল আঙ্গিকে, প্রবল মানসিক শক্তি ও সুকুমারবৃত্তির প্রতি চিরন্তন আস্থার প্রকাশ। অসি ও মসীর যুদ্ধে চিরকাল মসীই জয়ের অক্ষর লেখে।একজন প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, সংবেদনশীল গুরুর সামর্থ্য কতদূর —মহর্ষি বশিষ্ঠ সেটি প্রমাণ করেছেন। সাধারণ কাঠের লাঠি যেন অলৌকিক মানসিক শক্তির আধার হয়ে শত্রুর অস্ত্রবিনাশের হাতিয়ার হয়েছে।সেখানে প্রয়োগকর্তার উদ্দেশ্য কিন্তু জীবনহানি নয়, অশুভশক্তিকে দমনমাত্র।
এখন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারবিষয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের অস্ত্রপ্রয়োগনীতি কী শুভবোধ ও সুবুদ্ধির মানুষের অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত? পোষ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন একটি সামাজিক অঙ্গীকার – বশিষ্ঠ ও নন্দিনীর সম্পর্ক, জীবজগতের পারস্পরিক সংবেদনশীলতা ও নির্ভরতার অনবদ্য নিদর্শন,এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।—চলবে।
মননশীল মনে সংবেদনশীলতার অবাধ প্রবেশাধিকার। সেখানে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। অত্যাচারিতা নন্দিনীর চোখের জল মহর্ষির মনে রেখাপাত করেনি। মহর্ষি বশিষ্ঠের ন চুক্ষুভে তদা ধৈর্য্যান্ন চচাল ধৃতব্রতঃ। মনে ক্ষোভ নেই। এক মুহূর্তের জন্যেও বিচলিত নন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি মহর্ষি। আশ্রিতকে রক্ষা করতে না পারলে আত্মরক্ষার অধিকার যে তার আছে, এই সত্য মহাভারতের যুগেও সমাদৃত হোত নিশ্চয়ই। তাই বশিষ্ঠ, সেই অধিকার তুলে দিয়েছেন নন্দিনীর হাতে।
ক্ষমার গুণমাহাত্ম্য সব যুগে ও কালে প্রসঙ্গিক ও আলোচ্য বিষয়। যে যুদ্ধে প্রাণহানি নেই অথচ বিজেতা ও পরাজিত আছেন, বোধ হয়, এমন যুদ্ধজয় সম্ভব, যদি বিজয়ীর মনে ক্ষমার প্রাধান্য বিরাজ করে।
রামায়ণে মহর্ষি বশিষ্ঠ ও রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের কাহিনি হল উত্তরণের কাহিনি।রামায়ণে,রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের শত প্রতিকূলতা জয়ের মাধ্যমে ব্রহ্মর্ষির শিরোপালাভ, প্রাধান্য পেয়েছে।মহাভারতে বিশ্বামিত্রের তপঃশক্তির গরিমাকে ক্ষুণ্ণ করে মহর্ষি বশিষ্ঠ ও তাঁর অতি আদরের নন্দিনীর জয় যেন একসাথে কঠোর ও কোমল আঙ্গিকে, প্রবল মানসিক শক্তি ও সুকুমারবৃত্তির প্রতি চিরন্তন আস্থার প্রকাশ। অসি ও মসীর যুদ্ধে চিরকাল মসীই জয়ের অক্ষর লেখে।একজন প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, সংবেদনশীল গুরুর সামর্থ্য কতদূর —মহর্ষি বশিষ্ঠ সেটি প্রমাণ করেছেন। সাধারণ কাঠের লাঠি যেন অলৌকিক মানসিক শক্তির আধার হয়ে শত্রুর অস্ত্রবিনাশের হাতিয়ার হয়েছে।সেখানে প্রয়োগকর্তার উদ্দেশ্য কিন্তু জীবনহানি নয়, অশুভশক্তিকে দমনমাত্র।
এখন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারবিষয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের অস্ত্রপ্রয়োগনীতি কী শুভবোধ ও সুবুদ্ধির মানুষের অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত? পোষ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন একটি সামাজিক অঙ্গীকার – বশিষ্ঠ ও নন্দিনীর সম্পর্ক, জীবজগতের পারস্পরিক সংবেদনশীলতা ও নির্ভরতার অনবদ্য নিদর্শন,এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।