বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পাণ্ডবরা পাঞ্চালদেশে যাত্রা করলেন দ্রুপদরাজকন্যা পাঞ্চালীর স্বয়ংবরসভার দর্শক হিসেবে নয়। পিতামহ ব্যাসদেবের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল দ্রুপদস্য কোলে যজ্ঞে সা কন্যা দেবরূপিণী। নির্দিষ্টা ভবতাং পত্নী কৃষ্ণা পার্ষত্যনিন্দিতা।। দ্রুপদকুলে জাতা সেই দেবীতুল্যা কন্যা, পিতামহ পৃষতরাজার পৌত্রী অনিন্দ্যসুন্দরী কৃষ্ণাকে মহাদেব তোমাদের বধূরূপে স্থির করেছেন। তাই মহর্ষির বিশ্বাস, তাঁকে লাভ করে পাণ্ডবরা নিঃসন্দেহে সুখী হবেন। মহর্ষি বিধান দিলেন, এই কারণে পাণ্ডবদের পাঞ্চালনগরে বসবাস করাই শ্রেয়।

যাত্রাপথে বিপত্তি, অপরের উপস্থিতি সহ্য করতে পারেন না এমন, গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণের সঙ্গে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের বিরোধিতার সূত্রে কথোপকথনের সূচনা হল। সেটিও বেশ আকর্ষণীয়। পটভূমি গঙ্গার তীরভূমি। জলকেলিতে ইচ্ছুক গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ। আসন্ন সন্ধ্যায় জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে মা ও ভাইদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন অর্জুন। জনহীন গঙ্গায় নারীদের সঙ্গে জলক্রীড়ায় অংশ নিতে সেদিকেই চলেছেন গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ। প্রবল বিরক্তিতে ধনুক উদ্যত করে বললেন, অস্তমিত সূর্যের রক্তিমরাগে লালিমায় আচ্ছন্ন সন্ধ্যাকাল এই সময়টি অসচ্চরিত্র লোকেদের জন্য নির্দিষ্ট নয়। ওই সময়টিতে স্বেচ্ছায় বিচরণকারী যক্ষ, গন্ধর্ব ও রাক্ষসদের শুধুমাত্র অধিকার। দিনের অবশিষ্ট ক্ষণগুলিতে মানুষের স্বেচ্ছাবিচরণে কোন বাধা নেই। তবে যদি কোনও মানুষ, এমন কি সৈন্যসামন্ত নিয়ে কোন নৃপতিও রাত্রিতে নদীর জল ব্যবহার করেন, ব্রহ্মবিদেরা তাঁরও নিন্দা করে থাকেন। তাই পাণ্ডবদের বরং গঙ্গাজলে ক্রীড়ারত গন্ধর্বরাজের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

দাম্ভিক অঙ্গারপর্ণ নিজের ঔদ্ধত্য জাহির করে বললেন। তিনি অভিমানী, হিংসুক ও কুবেরের প্রিয়সখা। তিনি নিজের শক্তিতে আস্থাশীল। তিনি গন্ধর্ব। তাঁর নাম অঙ্গারপর্ণ। ন কৌণপাঃ শৃঙ্গিণো বা ন দেবা ন চ মানুষাঃ। ইদং সমুপসর্পন্তি তৎ কিং সমুপসর্পথ।। কোন রাক্ষস, গবাদিপশু, দেবতা বা পশু তাঁর জলবিহারের সময়ে নিকটবর্তী হয় না, তোমরা এসেছো কেন? নির্ভীক অর্জুন বললেন, সমুদ্রে,হিমালয়ের পাশে আর গঙ্গায়, কারই বা দিনে বা রাতে জলগ্রহণে বাধা আছে? খেয়ে বা না খেয়ে, দিনে বা রাতে, নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গার জলগ্রহণের কোনও সময়সীমা নেই। ন কালনিয়মো হ্যস্তি গঙ্গাং প্রাপ্য সরিদ্বরাম্।
প্রাচীনকালে গঙ্গা হিমালয় হতে বহির্গত হয়ে সাতটি ধারায় সাগরে মিশেছে। সাতটি প্রবাহের নাম —গঙ্গা, যমুনা, প্লক্ষজাতা, সরস্বতী, সরযূ, গোমতী ও গণ্ডকী। এই সাতটি নদীর জল পান করলে পাপমুক্তি হয়। এই পবিত্র গঙ্গা আকাশকে তটরূপে গ্রহণ করায় আকাশগামিনী হয়। দেবলোকে তাঁর নাম অলকানন্দা। পিতৃলোকে পাপীদের গঙ্গা অতিক্রম করা দুষ্কর। তাই এই নদী বৈতরণী নামে অভিহিত। আচার্য বেদব্যাস এই সব তথ্য বলেছেন। অর্জুনের মতে, যে দেবনদী স্বর্গদায়ক ও মঙ্গল সাধন করে, সেই নদীকে ব্যবহারে কেউ বাধা দিতে পারে না। কথমিচ্ছসি তাং রোদ্ধুং নৈব ধর্ম্মঃ সনাতনঃ। সেই নদীব্যবহারে নিষেধ আরোপ করছেন কেন? এ যে সনাতনধর্ম বিরুদ্ধ আচরণ। যাঁকে কেউ অনুশাসনে বাঁধতে পারে না, যে নদীর জল অবাধ, গন্ধর্বরাজের ইচ্ছানুসারে যথেচ্ছভাবে সেই পবিত্র ভাগীরথীর জল, স্পর্শ করবেন না কেন?
ক্রুদ্ধ অঙ্গারপর্ণ, ধনুকে তীক্ষ্ণ বিষধর সাপের তুল্য শাণিত তীর যুক্ত করে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেন।

অর্জুন গুরুপ্রদত্ত দৈবাস্ত্রের সাহায্যে প্রতিরোধ শুরু করলেন। অর্জুনের আগ্নেয়াস্ত্র গন্ধর্বরাজের রথ ধ্বংস করল। তাঁর পত্নী কুম্ভীনসীর অনুরোধে, যুধিষ্ঠির অচৈতন্য, বিপর্যস্ত, রথহীন অঙ্গারপর্ণকে মুক্তি দিলেন। অর্জুন ও অঙ্গারপর্ণ উপহার বিনিময় করলেন। দু’জনের শত্রুতার অবসান হল। অঙ্গারপর্ণ জানালেন, জ্ঞানী নারদ প্রভৃতি দেবর্ষিদের কথিত পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষদের গুণকীর্তন তিনি শুনেছেন। তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে কৌরবদের সদ্বংশের প্রভাব অবগত হয়েছেন। কীর্তিমান ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণের অস্ত্রবিদ্যাদান বিষয়টিও তিনি জানেন। ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় ও পাণ্ডুর পিতৃত্বের বিষয়টিও তিনি জানেন। তাঁরা পঞ্চপাণ্ডবদের পিতা। পাণ্ডবদের এই পিতৃপরিচয়ও তাঁর অজানা নয়। পাণ্ডবরা ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করেছেন, তাঁরা বিদ্বান, মহাত্মা ও অস্ত্রধারী বীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সুবুদ্ধি ও উদারমনা পাণ্ডবদের আত্মাও পবিত্র।

এ সব জেনেও গন্ধর্বরাজ স্বীকার করলেন, তবুও তিনি পাণ্ডবদের অবমাননার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। কারণ স্ত্রীর সম্মুখে তিনি নিজের অপমান সহ্য করতে পারেননি। সর্বোপরি রাত্রিতে তাঁদের শক্তিবৃদ্ধি হয়। ক্ষত্রিয়রা কামনার বশবর্তী হয়েও পুরোহিতের উপদেশেই নিশাচরদের জয় করতে সমর্থ হয়। তাই একজন পুরোহিতবরণ অবশ্যই প্রয়োজন। তাই অর্জুনকে ‘তাপত্য’ নামে সম্বোধন করে বললেন, অভীষ্টসাধনের লক্ষ্যে একজন সংযতেন্দ্রিয়, বিদ্বান, বেদবিদ, পবিত্রহৃদয়, ধার্মিক, সুশিক্ষিত, পুরোহিতের উপদেশ প্রয়োজন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

হে তাপত্য, কোনও রাজাই কেবলমাত্র শৌর্যবলে ও আভিজাত্যের ফলে একাকী ভূভাগ দখল করতে পারে না। ন হি কেবলশৌর্য্যেন তাপত্যাভিজনেন চ। জয়েদব্রাহ্মণঃ কশ্চিদ্ ভূমিং ভূমিপতিঃ ক্বচিৎ।। সেই কারণেই উপদেষ্টা ব্রাহ্মণ অর্থাৎ পুরোহিতের আবশ্যকতা আছে। কৌতূহলবশে অর্জুন প্রশ্ন করলেন, তপতী নামে কে আছেন যাঁর দরুণ আমরা ‘তাপত্য’ নামে অভিহিত। আমরা যে কুন্তীপুত্র কৌন্তেয়।কী কারণে আমরা ‘তাপত্য?’ তার রহস্য জানতে ইচ্ছা হয়। তপতী নাম কা চৈষা তাপত্যা যৎকৃতে বয়ম্। কৌন্তেয়া হি বয়ং সাধো!তত্ত্বমিচ্ছামি বেদিতুম্।।

গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ ও অর্জুনের আলাপচারিতার সূত্রটি ছিল, রাজাদের জীবনে পুরোহিতের উপস্থিতির গুরুত্ব কেন? এই কথোপকথনপ্রসঙ্গে উঠে এল পাণ্ডবদের আরও এক পূর্বপুরুষের উপাখ্যান। গন্ধর্বরাজ অর্জুনকে শোনালেন ত্রিলোকপ্রসিদ্ধ সেই উপাখ্যান। ঋক্ষবংশীয় অজমীঢ়ের পুত্র রাজা সম্বরণ সূর্যদেবের কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সেই সূর্যকন্যার নাম ছিল তপতী। সূর্যদেবের অপর কন্যা সাবিত্রী। আর কনিষ্ঠা কন্যাটির নাম তপতী। সূর্যদেবের গগনব্যাপী অগ্নিময় তেজের তুল্য তেজস্বিনী ও কঠোর তপস্বিনী তপতী নামে সেই কন্যার দেহটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুষম, সুদীর্ঘ কাজলকালো তাঁর নয়ন দুটি। অপরূপা কন্যাটি অতুলনীয়া রূপবতী শুধু নয়, সুন্দর তাঁর আচরণ, সচ্চরিত্রা, সুবেশা, শৃঙ্গারভাবে ভাবিনী। সূর্যদেবের মনে শান্তি নেই। তাঁর বিবেচনায়, রূপে, চরিত্রে, গুণে, শাস্ত্রজ্ঞানে ত্রিভুবনে কোনও পুরুষই তপতীর উপযুক্ত স্বামী নন। অথচ যৌবনবতী তপতীকে পাত্রস্থ করা প্রয়োজন। সেই সময়ে ঋক্ষবংশীয় রাজা অজমীঢ়ের পুত্র, কুরুবংশের নৃপতিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলশালী,রাজা সম্বরণ সূর্যদেবের আরাধনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।সম্বরণ অহংভাব ত্যাগ করে, পবিত্রমনে, অর্ঘ্য, মালা, উপহার প্রভৃতি দিয়ে এবং প্রতিনিয়ত নিয়মপালন ব্রত উপবাস বিবিধ তপস্যা মাধ্যমে প্রত্যহ সকালে সূর্যের উপাসনা করতেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

কৃতজ্ঞ, ধার্মিক, অনুপম রূপবান সম্বরণকে পছন্দ হল সূর্যদেবের। তিনি তাঁকেই কন্যা তপতীর যোগ্য পাত্র হিসেবে মনোনীত করলেন। সূর্যদেব গগনমণ্ডলে প্রদীপ্ত কিরণচ্ছটায় ও সম্বরণ পৃথিবীতে দীপ্তির উদ্ভাসে, দু’জনেই তেজস্বিতায় পরস্পরের সমকক্ষ। দেবতাদের উপাস্য যেমন উদীয়মান সূর্য তেমনই ক্ষত্রিয়দের পূজনীয় রাজা সম্বরণ। চন্দ্রতুল্য কান্তিময় সম্বরণ নিজের শৌর্যজনিত তেজে শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সকলকে অতিক্রম করলেন। এ হেন কান্তিমান, সুভদ্র কুমারকে কোন কন্যার পিতার পছন্দ না হয়? সূর্যদেব তার ব্যতিক্রম নন। তিনিও সম্বরণকেই কন্যাদান করবেন স্থির করলেন।

একদা মৃগয়াবিহারী সম্বরণরাজার ঘোড়াটি ক্ষুধার্ত অবস্থায় ও পিপাসায় কাতর হয়ে প্রাণত্যাগ করল। পদব্রজে পর্বতে বিচরণকারী রাজা, দিঘলনয়না অপরূপা মূর্তিমতী লক্ষ্মীস্বরূপিণী একাকিনী এক কন্যাকে দেখতে পেলেন। যেন সৌরমণ্ডল থেকে বিচ্যুতা কিরণময়ী কন্যাটি। তাঁর রূপের প্রভা অনলসদৃশ, আবার তাঁর স্বচ্ছ ও নির্মল রূপের আভায় তিনি চন্দ্রলেখা যেন। দেখে, রাজা অনিমেষে চেয়ে রইলেন সেই গিরিপৃষ্ঠে শোভমানা সুবর্ণময়ী প্রতিমার দিকে। তাঁর চোখের পলক পড়ে না। রমণীকুলের মধ্যে সৌন্দর্যে শ্রেষ্ঠা সেই নারীকে দেখে রাজার কাছে, ত্রিলোকের অন্য সব নারীদের রূপ তুচ্ছ মনে হল। রাজা মনে মনে কন্দর্পের প্রণয়শরে বিদ্ধ হলেন। তাঁর মনে শুরু হল কামনার প্রবল নিপীড়ন। কন্যা তাঁর গুণের রজ্জু দিয়ে রাজার মন ও নয়ন বেঁধে ফেললেন এমন করে, যে, রাজা সেই জায়গাটি ছেড়ে যেতেও পারলেন না, এ বিষয়ে কোনও খোঁজখবর নিতেও পারলেন না। কামনার জ্বালায় অস্থির হয়ে,আয়তচক্ষু অতুলনীয়া সরলা সুন্দরীর পরিচয় জানতে চাইলেন রাজা। কাসি কস্যাসি রম্ভোরু! কিমর্থঞ্চেহ তিষ্ঠসি।

হে সুন্দরি, আপনি কে? কার অধীনা আপনি? কী কারণেই বা আপনি এখানে? প্রণয় নিবেদন করলেন অবশেষে। সুন্দরীর রূপের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁর নিজের মানসিক অস্থিরতা ব্যক্ত করলেন। দৃষ্ট্বৈব চারুবদনে!চন্দ্রাৎ কান্ততরং তব। বদনং পদ্মপত্রাক্ষং মাং মথ্নাতীব মন্মথঃ। হে সুমুখী, তোমার পদ্মপাতার সদৃশ নয়নযুক্ত চন্দ্রের থেকেও কমনীয় মুখখানি দেখা অবধি মদনদেব যেন আমায় মথিত করছেন। জনহীন অরণ্যে একাকিনী সেই নারী কোন প্রত্যুত্তর না দিয়ে মেঘের ভিতরে বিদ্যুতের মতো অদৃশ্য হলেন। উন্মাদপ্রায় রাজা বন জুড়ে বিচরণ করতে লাগলেন। কন্যাটিকে খুঁজে না পেয়ে, কামনার পীড়নে, সংজ্ঞা হারিয়ে সেই জায়গাটিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। দেখা দিলেন সেই সুহাসিনী সুতন্বী নারী। হেসে বললেন, উত্তিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভদ্রং তে ন ত্বমর্হস্যরিন্দম!। মোহং নৃপতিশার্দ্দূল!গন্তুমাবিষ্কৃতঃ ক্ষিতৌ।। হে শত্রুদমনকারী নরব্যাঘ্র, আপনি উঠুন, উঠুন। মঙ্গল হোক আপনার। এমন মোহগ্রস্ত হওয়া আপনাকে মানায় না। পৃথিবীতে রাজারূপে আপনার প্রকাশ। রাজা সেই মধুরভাষিণীকে কামমদির অবস্থায় অস্পষ্টভাষায় বললেন, তিনি কামাসক্ত, সুন্দরীকে ছাড়া রাজা বাঁচবেন না। ন হ্যহং ত্বদৃতে ভীরু!শক্ষ্যামি খলু জীবিতুম্। হে কল্যাণি, নিজেকে নিবেদন করে কামনার প্রদাহ শান্ত করুন। উপশাময় কল্যাণি!আত্মদানেন ভাবিনি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

রাজা প্রস্তাব দিলেন, গান্ধর্ববিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক। কারণ তাঁর মতে, সেটিই শ্রেষ্ঠ বিবাহ। তপতী উত্তর দিলেন, নাহমীশাত্মনো রাজন্! কন্যা পিতৃমতী হ্যহম্। ময়ি চেদস্তি তে প্রীতির্যাচস্ব পিতরং মম। আমি স্বাধীন নই, আমার পিতা আছেন। আমার প্রতি আপনার প্রেম। তাই পিতার কাছে আমায় প্রার্থনা করুন। তপতী স্বীকার করলেন, দর্শনমাত্রই রাজা তাঁর হৃদয় হরণ করেছেন। কিন্তু নারীরা স্বাধীন নন। তাই তিনি রাজার কাছে স্বেচ্ছাগমনে অক্ষম। ত্রিলোকখ্যাত অভিজাত প্রণয়াসক্ত রাজাকে কে না কামনা করেন? তাই নত হয়ে, তপস্যাবলে, নিয়মপালনের মাধ্যমে পিতা আদিত্যের কাছে কন্যাকে প্রার্থনা করলে, পিতা যদি রাজাকে কন্যাসম্প্রদানে ইচ্ছুক হন তবে তিনি চিরদিনের জন্য রাজার হবেন। ভবিষ্যাম্যথ তে রাজন্!সততং বশবর্ত্তিনী। আত্মপরিচয় ঘোষণা করলেন তিনিই পৃথিবীর প্রদীপ, সূর্যদেবের, দুহিতা সাবিত্রীর কনিষ্ঠা ভগিনী। তাঁর নাম তপতী। অহং হি তপতী নাম সাবিত্র্যবরজা সুতা। অস্য লোকপ্রদীপস্য সবিতুঃ ক্ষত্রিয়র্ষভ!।।

তপতী ঊর্দ্ধলোকে উধাও হলেন। সসৈন্য জ্ঞানবৃদ্ধ মন্ত্রী, ভূলুণ্ঠিত অসহায় রাজাকে, খুঁজে পেলেন। রাজার আদেশে সৈন্যরা ফিরে গেল রাজধানীতে। রাজা সেই পার্বত্যপ্রদেশে পবিত্র হয়ে, অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে ঊর্দ্ধমুখে সুর্যদেবের আরাধনায় প্রবৃত্ত হলেন। মনে মনে ঋষিশ্রেষ্ঠ পুরোহিত বশিষ্ঠের শরণ নিলেন রাজা। রাত্রিদিন এ ভাবে অতিবাহিত হল। দ্বাদশ দিনে আবির্ভূত হলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ। ধ্যানযোগে তিনি জেনেছেন, তপতী রাজার মন জয় করেছেন। মহর্ষি রাজার সঙ্গে উদ্দেশ্যসাধন বিষয়ে আলোচনা করলেন। রাজা দেখলেন, তপনতুল্য দীপ্ত মহর্ষি বশিষ্ঠ সূর্যদেবের দর্শনেচ্ছায় ঊর্দ্ধলোকে অদৃশ্য হলেন। সূর্যদেবকে আত্মপরিচয় দিলেন বশিষ্ঠ। তাঁকে সম্মান জানিয়ে সূর্যদেব বললেন, অতিদুর্লভ হলেও মহর্ষির অভিপ্রেত বস্তুটি, তিনি প্রদান করবেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ রাজা সম্বরণের জন্য সূর্যদেবের কনিষ্ঠা কন্যাকে প্রার্থনা করলেন। সূর্যদেবের মনোবাসনা পূর্ণ হল। রাজা সম্বরণ মহর্ষি বশিষ্ঠের প্রভাবে সূর্যদেবের কন্যাকে ভার্যারূপে লাভ করলেন। বারো বছর স্ত্রীর সান্নিধ্যে আনন্দে দিন কাটালেন রাজা। ওই সময়ে রাজ্যে অনাবৃষ্টি দেখা দিল।শস্য উৎপন্ন হল না। কর্মহীন ক্ষুধার্ত মৃতপ্রায় প্রজাবৃন্দের অবস্থা দেখে ধার্মিক মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ ব্যবস্থা নিলেন। সস্ত্রীক রাজাকে আনালেন সেখানে। ইন্দ্রদেব বর্ষণ শুরু করলেন আবার।শস্যসমৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দিল। পুলকিত হল রাজ্য ও রাজধানী।রাজা সপত্নী বারো বছর ধরে যজ্ঞ করলেন। তপতীর গর্ভে কুরুরাজার জন্ম হল। গন্ধর্বরাজ তাপত্য সম্বোধনের তাৎপর্য উদ্ঘাটন করে অর্জুনকে বললেন, হে শ্রেষ্ঠ অর্জুন, প্রতাপবলে শত্রুদের সন্তাপ সৃষ্টিকারী সূর্যদেবের কন্যার অপত্য অর্থাৎ সন্তানের বংশধর তুমি, তাই তুমি ‘তাপত্য’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৭: মূর্খকে উপদেশ দিলে সেটা তার রাগের কারণ হয়

মহাভারতের মহাব্যাপ্তিতে ভারতযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যত আখ্যান উপাখ্যান স্থান পেয়েছে, সেগুলিতে আছে সমাজচিত্র, যুগধর্ম, নৈতিকতা, মানবজীবনে গ্রহণযোগ্য চিরন্তন উপদেশাবলী। সেই সঙ্গে শব্দের সূত্র ধরে, বংশগুলির, নদনদীর, নানা স্থানের বিবিধ নামমাহাত্ম্য।

গন্ধর্বরাজ জানিয়েছেন, সন্ধ্যার আঁধারে অশুভ শক্তির পদচারণা শুরু হয়। তাঁর ব্যাখ্যানুসারে অসচ্চরিত্র মানুষের জন্য ওই সময় আদর্শ নয়। হয়তো সচ্চরিত্র মানুষের উপাসনার সময় তখন। অন্য সময়ে সব মানুষের অবাধ গতি। অশুভ শক্তির তৎ পরতায় রাতের কালোর আবরণ দরকার হয়তো। গঙ্গাজল ব্যবহারে নিষেধ আরোপ করেছেন অঙ্গারপর্ণ। অর্জুন ঘোষণা করেছেন, গঙ্গায় অধিকার সকলের, সবসময়ে। হিমালয় থেকে যে নদীটি সাতটি ধারায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হল সমতলে সেগুলি কোথাও বহমান, কোথাও বা অন্য কোনও নামে তার ধারা প্রবহমান। শূন্যে আকাশগামিনী গঙ্গার নাম অলকানন্দা, পাপীদের উত্তরণ অসাধ্য, তাই তার নাম বৈতরণী। এমন নামমাহাত্ম্য যার সে নদী যে ভারতভূমির অন্তরাত্মায় মিশে আছে। তাই তার জল ব্যবহারে কারও বাধা নেই। যুগান্তরের পথ বেয়ে গঙ্গার আবহমান প্রবাহের অধিকার সমগ্র ভরতবংশীয়দের।
রাজাদের রাজধর্মপালনে পুরোহিতের উপস্থিতির গুরুত্ব কেন? গন্ধর্বরাজ, সেটি, সম্বরণ ও তপতীর প্রণয়কাহিনি বর্ণনার মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন। উপাখ্যানবর্ণনাসূত্রে গন্ধর্বরাজ জানিয়েছেন, কৌরবদের পূর্বপুরুষ কুরুর মায়ের নাম তপতী।তপতীর নামানুসারে পাণ্ডপুত্র অর্জুন একজন ‘তাপত্য’।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সূর্যদেবের তেজস্বিতার উত্তরাধিকার পাণ্ডবদের রক্তে। সূর্যকন্যা তপতীর প্রেমে পাগলপরা রাজা সম্বরণের গান্ধর্ববিবাহের প্রস্তাব নস্যাৎ করেছেন তপতী। দৃঢ়কণ্ঠে অথচ মাধুর্য বিস্তার করে জানিয়েছেন, রাজাদের এমন ধারা হৃদয়দৌর্বল্য মানায় না। তিনি পিতার অধীন। এটি হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত নয়,পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাবে হয়তো তাঁর এই সিদ্ধান্ত। তপতী সহজলভ্যা নন, পিতার অনুমতিসাপেক্ষ তাঁদের বিবাহ। সহজলভ্যা হলে হয়তো তাঁর দশা হোত ভরতমাতা শকুন্তলার মতো, বিস্মরণের অন্ধকারে পরিত্যক্তা যে স্ত্রীর কাহিনি পৃথিবীখ্যাত। কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনে যা কিছু লাভ করা যায়, তার মূল্য অন্যান্য।

রাজার উদ্দেশ্যসাধনে রাজপুরোহিত মহর্ষি বশিষ্ঠের সহায়তা ও হস্তক্ষেপের আবশ্যক ছিল। সাধারণ মানুষের এমন পথপ্রদর্শক পুরোহিতের ভূমিকায় থাকেন অভিভাবকরা। তাই তাঁদের গুণগত চরিত্রের মান হয়তো উন্নত হওয়া প্রয়োজন।
যে কোনও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিই যদি কামনার বশবর্তী হন তবে তাঁর পারিপার্শ্বিকের সকলেই তাঁর দায়ভার বহন করে থাকেন। সম্বরণ পত্নীসান্নিধ্যে ভুলে গেলেন তাঁর রাজধর্ম। রাজ্যে নেমে এল অনাবৃষ্টির অভিশাপ। ফলভোগী হলেন প্রজারা। তখনও মহর্ষি বশিষ্ঠের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হল।রাজা তাঁর রাজোচিত মহিমা ফিরে পেলেন। প্রজাদের মনোরঞ্জনেই রাজাপদের সার্থকতা রয়েছে যে।
মহাভারতের এমন কত শত কাহিনি যুগে যুগে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। রূপকের আড়ালে আধুনিক চিন্তা উঁকি দেয়, কালস্রোতে ভাসমান জীবনে বহমান গঙ্গার স্রোত যেন কথা বলে—এর উত্তরাধিকার যে, আমার প্রবাহের মতোই চিরকালীন। সেই পরম্পরাগত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিরন্তর উর্বরতায় সমৃদ্ধ করে চলেছে ভারতীয়দের মন ও মস্তিষ্ক।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content