বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পাণ্ডবদের পূর্বসূরী রাজা পুরুর, পিতা যযাতি, অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। রাজা যযাতি প্রথমদর্শনে দেবযানীর প্রতি নয়, আকৃষ্ট হয়েছিলেন দেবযানীর পদসেবারতা অসুররাজ বৃষপর্ব্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার প্রতি। শর্মিষ্ঠার দাসীবৃত্তি মেনে নিতে পারেননি যযাতি। এর কারণটি সম্বন্ধে দেবযানীকে প্রশ্ন করেও সদুত্তর পাননি। দেবযানীর অস্বচ্ছ উত্তর ছিল—সর্ব্ব এব নৃপশ্রেষ্ঠ! বিধানমনুবর্ত্ততে। বিধানবিহিতং মত্বা মা বিচিত্রাঃ কথাঃ কৃথাঃ।। হে নৃপশ্রেষ্ঠ, সব মানুষই বিধির বিধান অনুসরণ করেন। এটিও দৈবের বিধান মনে করে আর বিবিধ প্রশ্ন করবেন না। দেবযানীর প্রণয়প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যযাতি বর্ণাশ্রমধর্মের দোহাই দিয়ে। ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহ করতে অস্বীকার করলেন ক্ষত্রিয় রাজা যযাতি। শেষ পর্যন্ত দেবযানীর পিতার হস্তক্ষেপের ফলে বিবাহ সম্পন্ন হল। দাসী শর্মিষ্ঠা ও তাঁর সহস্র দাসীসহ দেবযানীকে বিবাহ করে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের আশীর্বাদ নিয়ে এবং দৈত্যদের দ্বারা সম্মানিত হয়ে রাজধানীতে ফিরে গেলেন রাজা যযাতি।

রাজপ্রাসাদে রইলেন দেবযানী। দেবযানীর অনুমতি নিয়ে, উদ্যানের অশোকবনের নিকটে শর্মিষ্ঠার বাসগৃহ নির্মিত হল। স্থির হল শর্মিষ্ঠা তাঁর সহস্র দাসী নিয়ে সেখানেই অবস্থান করবেন। কালক্রমে দেবযানী এক পুত্রসন্তানের মা হলেন। এইভাবে বহুকাল অতিক্রান্ত হল। যৌবনবতী শর্মিষ্ঠার ঋতুকাল উপস্থিত হল। তাঁর মনে কষ্ট, তাঁর স্বামী নেই। সখী দেবযানী সন্তান লাভ করেছেন কিন্তু শর্মিষ্ঠার যৌবন বুঝি বৃথা যায়। যা হোক, যেভাবে দেবযানী নিজেই স্বামীকে বরণ করেছেন তেমনভাবে তিনিও সেই পতিকে বরণ করবেন। দেবযানী প্রজাতাসৌ বৃথাহং প্রাপ্তযৌবনা। যথা তথা বৃতো ভর্ত্তা তথৈবাহং বৃণোমি তম্।।
শর্মিষ্ঠার মনোবাসনা হল যযাতির ঔরসে পুত্রলাভ। অশোক বনের কাছে, নিরালায়, রাজার দর্শনের অপেক্ষায় অবস্থানরতা শর্মিষ্ঠাকে দেখতে পেলেন রাজা যযাতি। শর্মিষ্ঠা, রাজার কাছে সন্তান প্রার্থনা করলেন। শর্মিষ্ঠার বংশপরিচয়, চরিত্র ও রূপ,রাজার অজানা নয়। রূপাভিজনশীলৈর্হি ত্বং রাজন্! বেত্থ মাং সদা। সা ত্বাং যাচে প্রসাদ্যহমৃতুং দেহি নরাধিপ!।। রাজা জানালেন, শর্মিষ্ঠার কুল, চরিত্র সম্বন্ধে তিনি অবগত এবং অনিন্দিতরূপের অধিকারিণী শর্মিষ্ঠাকে চেনেন, জানেন। তবে রাজা দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দৈত্যরাজ বৃষপর্ব্বার কন্যাকে কখনও শয্যায় আহ্বান জানানো যাবে না। নেয়মাহ্বয়িতব্যা তে শয়নে বার্ষপর্ব্বণী। শর্মিষ্ঠার অকাট্য যুক্তি হল—ঠাট্টাচ্ছলে, স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জনের সময়ে, বিবাহকালে, প্রাণহানির সম্ভাবনায়, সর্বস্ব অপহরণের সময়ে এই পাঁচটি সময়ে মিথ্যাবচনে, পাপ হয় না। ন নর্ম্মযুক্তং বচনং হিনস্তি ন স্ত্রীষু রাজন্! ন বিবাহকালে। প্রাণাত্যয়ে সর্ব্বধনাপহারে পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি।। শর্মিষ্ঠা রাজাকে বোঝাতে চাইলেন কোনটি মিথ্যাচরণজনিত পাপ। তাঁর মতে, বিচারকের প্রশ্নোত্তরপর্বে সাক্ষী যদি প্রকৃত সত্যের অন্যথা করেন, তবে তিনি মিথ্যাচারের দরুণ পাপী প্রতিপন্ন হন। কোনও একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাদী প্রতিবাদীর বিবাদচলাকালীন দু’জনের মধ্যে কেউ যদি মিথ্যা বলে, তবে সে পাপী।

রাজা তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন এই বলে যে, রাজা প্রজাদের কাছে দৃষ্টান্তরূপ। তিনি মিথ্যাভাষণে যদি বিনষ্ট হন তবে প্রজারাও একই কারণে মিথ্যাচারণে পাপী সাব্যস্ত হবে। তাই রাজা শত কষ্টেও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে পারবেন না। শর্মিষ্ঠার যুক্তি, দুই সখীর পতি একজন, বিবাহেও সমতা আছে। তিনি বললেন, দেবযানী যাঁকে বরণ করেছেন তিনি আমারও স্বামী। সমাবেতৌ মতৌ রাজন্! পতিঃ সখ্যাশ্চ যঃ পতিঃ। সমং বিবাহমিত্যাহুঃ সখ্যা মেঽসি বৃতঃ পতিঃ।। যযাতি জানালেন, অধুনা তিনি যে ব্রত অবলম্বন করেছেন সেই ব্রত হল, দানের মাধ্যমে প্রার্থীর প্রার্থনাপূরণ। শর্মিষ্ঠা প্রার্থী। এখন রাজার কর্তব্য কী? এ বিষয়ে শর্মিষ্ঠার পরামর্শপ্রার্থী হলেন রাজা। ত্বঞ্চ যাচসি মাং কামং ব্রূহি কিং করবাণি তে।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

শর্মিষ্ঠার বক্তব্য একটাই, রাজা তাঁকে সন্তানহীনতাজনিত পাপ হতে মুক্ত করে ধর্মাচরণে সাহায্য করুন। রাজার সন্তানের মা হয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম পালন করতে ইচ্ছুক দানবরাজের কন্যা শর্মিষ্ঠা। তিনি যুক্তি দেখালেন, স্ত্রী, দাস ও পুত্র তিন জনেই স্বোপার্জিত ধন থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন নন অর্থাৎ একপ্রকার নির্ধনই বলা চলে। তাদের উপার্জিত ধনে অধিকার শুধু তাদের প্রভুদের। ত্রয় এবাধনা রাজন্! ভার্য্যা দাসস্তথা সুতঃ। যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্যৈতে তস্য তদ্ধনম্।। দেবযানীর দাসী শর্মিষ্ঠা। দেবযানী যযাতির পত্নী। তাই দেবযানী রাজার অধীনা। দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা, দু’জনেই রাজার অধীন। তাই রাজার কর্তব্য উভয়কেই ভজনা। সুতরাং রাজার শর্মিষ্ঠাকে ভজনা করা কর্তব্য। শর্মিষ্ঠার বক্তব্য রাজার মনে ধরল। শর্মিষ্ঠাকে সম্মানিত করে তাঁর কামনা পূরণ করলেন। শর্মিষ্ঠার সাধ মিটিয়ে রাজা নিজেও যথেষ্ট তৃপ্ত হলেন। দু’জনায় পরস্পরকে সম্মান প্রদর্শন করে নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন।

যথাসময়ে শর্মিষ্ঠা, যযাতির ঔরসে দেবশিশুতুল্য এক পুত্রের জন্ম দিলেন। দেবযানী খবর পেলেন। শর্মিষ্ঠার কাছে পৌঁছলেন চিন্তান্বিতা দেবযানী। কিমিদং বৃজিনং সুভ্রূ! কৃতং বৈ কামলুব্ধয়া। কামের বশে এ কি নীচসংসর্গজনিত পাপকাজ করলে, হে সুন্দরি। শর্মিষ্ঠা জানালেন, ধর্মসঙ্গতভাবেই কোন এক ধার্মিক, বেদবিদ, বরদানে সক্ষম, আগন্তুক ঋষির কামসঙ্গ প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। এই কামাচরণ অন্যায্য নয়। সেই ঋষি হতেই শর্মিষ্ঠার পুত্রলাভ করেছেন। এ তথ্য সম্পূর্ণরূপে সত্য। দেবযানীর প্রশ্ন—যদি তাই হয় তবে সেতো অত্যন্ত শোভন। সেই ঋষির নাম, গোত্র, বংশাবলীর বিবরণ জানতে ইচ্ছুক হলেন দেবযানী। গোত্রনামাভিজনতো বেত্তুমিচ্ছামি তং দ্বিজম্। শর্মিষ্ঠার উত্তর—তপস্যার তেজে সূর্যসম দীপ্তিমান সেই ঋষিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসার সামর্থ্য হয়নি তাঁর। বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের সন্তানের জন্ম দিয়েছেন শর্মিষ্ঠা। তাঁর প্রতি দেবযানীর আর কোন বিদ্বেষ নেই।সহাস্য আলাপচারিতায় কিছু সময় কাটিয়ে, শর্মিষ্ঠার কথা গভীরভাবে বিশ্বাস করে, নিজের বাসভবনে ফিরে এলেন দেবযানী।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: ভৃত্য যদি কোনও অপরাধ করেন, তার দণ্ড প্রভুকেই পেতে হয়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

দেবযানীর দুই পুত্র, যদু ও তুর্বসু। যেন ইন্দ্র ও বিষ্ণুতুল্য দু’জন। শর্মিষ্ঠা, যযাতির ঔরসে দ্রুহ্য, অনু ও পুরুনামে তিনটি পুত্রের জন্ম দিলেন। একদা দেবযানী রাজা যযাতির সঙ্গে নিরালা উদ্যানে গেলেন। সেখানে দেবশিশুর মতো সুলক্ষণযুক্ত বালকরা খেলা করছে। তাদের মধ্যে যযাতির সমতুল্য রূপ ও তেজের প্রকাশ দেখে, মুগ্ধবিস্ময়ে দেবযানী বালকদের পিতৃপরিচয় জানতে আগ্রহী হলেন। প্রথমে রাজাকে, তারপরে বালকদের সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, কিং নামধেয়ং বংশো বঃ পুত্রকাঃ। কশ্চ বঃ পিতা। প্রব্রূত মে যথাতথ্যং শ্রোতুমিচ্ছামি তং হ্যহম্।। কোন বংশের ছেলে গো তোমরা? বাবার নাম কী? ঠিক ঠিক বলো বাছারা, আমি তোমাদের মুখেই শুনতে চাই। বালকেরা আঙ্গুলের নির্দেশে যথাক্রমে পিতামাতা, যযাতি ও শর্মিষ্ঠাকে দেখিয়ে দিল। বালকেরা রাজাকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল। রাজা পড়লেন অস্বস্তিতে। তিনি তাদের আদর করতে পারলেন না। বালকেরা মা শর্মিষ্ঠার কাছে কাঁদতে কাঁদতে উপস্থিত হল। রাজার প্রতি বালকদের ভালবাসা, সেই সঙ্গে লজ্জিত রাজার অভিব্যক্তি দেখে সবটাই বুঝলেন দেবযানী। প্রবল ক্ষোভে শর্মিষ্ঠাকে তিরস্কার করে বললেন, মদধীনা সতী কস্মাদকার্ষীর্বিপ্রিয়ং মম। তমেবাসুরধর্ম্মং ত্বমাস্থিতা ন বিভেষি মে।। আমার অধীনে থেকে আমার বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছো? অসুরের স্বভাব এখনও যায়নি, আমাকে ভয় নেই তোমার?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

শর্মিষ্ঠা বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তিনি অসত্য বলেননি। শর্মিষ্ঠা ‘ঋষি’ পরিচয় দিয়েছিলেন যাঁর তিনি যে সত্যিই রাজর্ষি। তাই ন্যায় ও ধর্মের পথেই তিনি আছেন। দেবযানীকে তিনি ভয় করেন না। দেবযানীর সঙ্গে তিনি নিজেও রাজাকে বরণ করেছিলেন। কারণ ধর্মে আছে, সখীর স্বামী নিজের স্বামী হয়ে থাকেন। জ্যেষ্ঠা এবং ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানী। তিনি শর্মিষ্ঠার পূজনীয়া ও সম্মানীয়া নিশ্চয়ই। কিন্তু শর্মিষ্ঠার কাছে শ্রেষ্ঠ মান্যবর হলেন রাজর্ষি। দেবযানী কি সেটা জানেন না?

দেবযানী শর্মিষ্ঠার কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে, সরাসরি আক্রমণ করলেন রাজাকে। রাজা দেবযানীর অপ্রিয় কাজ করেছেন। তাই তিনি আর সেখানে থাকবেন না। রাজন্! নাদ্যেহ বৎস্যামি বিপ্রিয়ং মে কৃতং ত্বয়া। তিনি সেখান থেকে প্রস্থানে উদ্যত হলেন। তাঁর মুখ বিষাদমলিন, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। দ্রুত পিতা শুক্রাচার্যের কাছে ব্যথিতমনে উপস্থিত হলেন তিনি। দেবযানীকে সান্ত্বনাদানরত সন্ত্রস্ত রাজাও তাঁকে অনুসরণ করলেন। ক্রোধে রক্তচক্ষু দেবযানী ফিরলেন না। দু’জনেই রাক্ষসগুরুর শুক্রাচার্যের মুখোমুখি হলেন। দেবযানী পিতাকে জানালেন, ধর্মকে পরাজিত করেছে অধর্ম। নীচ উত্তমের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। বৃষপর্বার কন্যা আমাকে অতিক্রম করে বিরাজমান। এই অতিক্রম অর্থ—শর্মিষ্ঠার পুত্রসংখ্যার আধিক্য।রাজা যযাতি শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিনটি পুত্রোৎপাদন করেছেন। হতভাগিনী দেবযানীর মাত্র দুইটি পুত্র। পিতাকে বললেন, রাজা ধর্মজ্ঞ বলে খ্যাত অথচ তিনি তাঁর মর্যাদার সীমা লঙ্ঘন করেছেন।আচার্য শুক্র বিধান দিলেন, ধর্ম্মজ্ঞঃ সন্ মহারাজ! যোঽধর্ম্মমকৃথাঃ প্রিয়ম্। তস্মাজ্জরা ত্বামচিরাদ্ধর্ষয়িষ্যতি দুর্জয়া।। ধর্ম্মজ্ঞ হয়েও যেহেতু তুমি অধর্মকে প্রিয়কাজ বলে বরণ করেছ। তাই অচিরেই অপরাজিত জরা দ্বারা আক্রান্ত হবে তুমি। যযাতি সাফাই গাইলেন, তিনি শর্মিষ্ঠার ঋতুরক্ষার প্রার্থনা ফেরাতে পারেননি। তাই তাঁর এই কাজ ধর্মবিরুদ্ধ নয়। অন্য কোনও মতলব ছিল না রাজার। বেদবিদদের মতে, রাজা এ কাজ না করলে ঋতুরক্ষা না করায়, রাজা ভ্রূণহত্যার দায়ে দোষীরূপে চিহ্নিত হতেন। রাজা আরও বললেন,বেদবিদদের মতে, গোপনে প্রার্থিত হয়েও যে পুরুষ সেই নারীতে উপগত না হন, পণ্ডিতগণ তাঁকে ভ্রূণহত্যাকারী বলে থাকেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

বিশেষত রাজার প্রার্থীর কামনাপূরণের ব্রত ছিল। এ ছাড়াও শুক্রাচার্য দেবযানীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠাকেও দান করেছিলেন। এই সমস্ত কারণ পর্যালোচনা করে অধর্মাচরণের ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে রাজা শর্মিষ্ঠার সংসর্গে গিয়েছিলেন।

শুক্রাচার্যের অভিমত, হে রাজন, আমার উপদেশের জন্যে বা আদেশের জন্যে তোমার অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কারণ তুমি আমার অধীন। ওহে নহুষের বংশধর যযাতি, ধর্মের ক্ষেত্রে মিথ্যাচার চৌর্যতুল্য পাপজনক। নন্বহং প্রত্যবেক্ষস্তে মদধীনোঽসি পার্থিব!। মিথ্যাচারস্য ধর্ম্মেষু চৌর্য্যং ভবতি নাহুষ!।। এই বাদানুবাদ চলাকালীন শুক্রাচার্যের অভিশাপের ফলে, তৎক্ষণাৎ যযাতি তাঁর বয়োসোচিত অবয়ব ত্যাগ করে জরাগ্রস্ত হলেন। যযাতি অনুনয় সহকারে বললেন,তাঁর এই যৌবনকালে দেবযানীর সঙ্গে সম্ভোগের ইচ্ছা অতৃপ্ত রয়েছে এখনও। আপনি অনুগ্রহ করুন। জরা যেন আমার শরীরে প্রবেশ না করে। শুক্রাচার্যের অভিশাপ মিথ্যা হবার নয়। রাজা ইতিমধ্যেই জরাক্রান্ত হয়েছেন। তবে রাজা যদি ইচ্ছা করেন এই বার্ধক্য অপরের শরীরে সঞ্চারিত করতে পারবেন। যযাতি স্থির করলেন তাঁর পুত্রদের মধ্যে কেউ যদি এই জরা গ্রহণ করে তার যৌবন দান করেন পিতাকে, সেই হবে রাজ্যাধিকারী, পুণ্যবান ও কীর্তিমান। এ বিষয়ে রাজা যযাতি, শুক্রাচার্যের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। শুক্রাচার্য সম্মতি দিলেন। শুক্রাচার্যকে, একাগ্রচিত্তে স্মরণ করে নহুষপুত্র যযাতি স্বেচ্ছানুসারে বার্দ্ধক্য দান করতে সক্ষম হবেন। এ কাজে পাপকর্মে লিপ্ত হবার সম্ভাবনা নেই কোন।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

শুক্রাচার্যের অভিশাপ ফলপ্রসূ হল। জরাগ্রস্ত যযাতি এখন পুত্রদের অনুগ্রহলাভের অপেক্ষায়, কে দেবে পিতাকে তার যৌবন? পিতৃপ্রদত্ত জরা, গ্রহণ করবে কোন পুত্র?

মহাকাব্যে সত্য ও মিথ্যা এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। শর্মিষ্ঠা তাঁর কার্যোদ্ধারের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মিথ্যাশ্রয়ের যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ ছিল না। রাজা যযাতি যখন রাক্ষসদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীকে বিবাহ করেছিলেন তখন শুক্রাচার্যের অনুরোধ ছিল দেবযানীর দাসী শর্মিষ্ঠাকে কখনও শয্যায় আহ্বান করা যাবে না। এই অনুরোধের কোনও প্রতিক্রিয়া বা রাজার কোন প্রত্যুত্তর মহাভারতে নেই। শর্মিষ্ঠা হয়তো রাজার মৌনতাকে বিবাহকালে মিথ্যাশ্রয়ের পর্যায়ভুক্ত করেছেন।রাজা শুক্রাচার্যের অনুরোধ রক্ষা করতে পারেননি। শর্মিষ্ঠার যুক্তিতে বিচারব্যবস্থায় সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা পাপ। বিবাদমান দুপক্ষের মধ্যে যে কোনও একজন যদি মিথ্যা বলে, তবে তা পাপ। বান্ধবীর কাছে নিজের মিথ্যাচারের সপক্ষে তাঁর যুক্তি কী গ্রাহ্য মনে হয়? বান্ধবীর স্বামী কি কখনও অপর বান্ধবীর স্বামী হতে পারেন? বাস্তবে বোধ হয় তা সম্ভব নয়। রাজর্ষির আপাত আপত্তি ছিল। তাঁর মিথ্যাচার প্রজাদের প্রভাবিত করতে পারে। তাই তিনি শুক্রাচার্যের প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ করে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেন না। ভার্যা, পুত্র ও দাস তিনজন নির্ধন কারণ তাঁরা অন্যের অধীন। অথচ দেবযানীর দাসী শর্মিষ্ঠা সন্তানাকাঙ্খায় রাজাকে পতিত্বে বরণ করলেন। এই সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা বোধ হয় তাঁর ছিল না। তিনি প্রতারণা করেছেন, শরিক হয়েছেন রাজা যযাতি। শর্মিষ্ঠার যুক্তির ফাঁদে তিনি ধরা দিয়েছেন, যুক্তির অসারতা তাঁর মনে ধরা দেয়নি। শর্মিষ্ঠাকে প্রথমদর্শনের মুগ্ধতা হয়তো রাজাকে কামমোহিত করেছিল। কারণ তিনি শর্মিষ্ঠার ইচ্ছা পূরণ করে পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন। শর্মিষ্ঠা, দেবযানীর কাছে রাজা যযাতির সন্তানদের পিতার পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। সত্য প্রকাশিত হবেই। সেটিই হয়েছে। দুই পুত্রের জননী দেবযানীর সঙ্গে তিনপুত্রের মা শর্মিষ্ঠার ইগোর লড়াইয়ে নিঃসন্দেহে পরাজিত হয়েছেন শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর বিরুদ্ধাচরণের সপক্ষে শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন, তত্ত্বোঽপি মে পূজ্যতমো রাজর্ষিঃ কিং ন বেত্থ তৎ। পূজনীয়া জ্যেষ্ঠা গুরুকন্যার থেকেও সম্মানীয় রাজর্ষি যযাতি, সেটা কী দেবযানীর জানা নেই? হয়তো তাঁর মূল অর্থ হল তিনি রাজার অনুরোধেই তাঁর সঙ্গ লাভ করেছিলেন। শর্মিষ্ঠার পরম পূজনীয় রাজা যযাতি, শুক্রাচার্যের অভিশাপে যৌবন হারিয়ে বার্দ্ধক্য বরণ করতে বাধ্য হয়েছেন।

মহাভারতে ধর্ম, সত্য, মিথ্যার বিচিত্র সংজ্ঞা পাওয়া যায়। যেগুলি যুগান্তরে কখনও সদর্থক, কখনও বা নাস্ত্যর্থকভাবে ব্যাখ্যাত হয়। কখনও সেগুলি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হিসেবেও উপস্থাপিত হয়। মহাভারতের অন্তর্লোকে কত প্রবাদবাক্যের উৎস লুকিয়ে আছে, কত ঘটনায় ভরতবংশীয়রা নৈতিকতার রসদ খুঁজে পান, কখনও বা সুযোগসন্ধানীরা তার অপব্যাখ্যায় মেতে ওঠেন—এ সব কিছুই কি মহাকাব্যের আবহমান প্রভাব নয়?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content