বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামের বনবাসজনিত অনুপস্থিতিহেতু রানি কৌশল্যার মনে আশঙ্কার মেঘ, দেবী কৈকেয়ী উদ্দেশ্যসিদ্ধির আনন্দে আরও হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন, রাম যৌবনে অরণ্যবাসে দীনহীনের জীবন যাপন করছেন —এমন হওয়ার কথা নয়। মনে আশাব্যঞ্জক চিন্তা — রাম, লক্ষ্মণ, সীতা একদিন ফিরে আসবেন যখন পরিণত রাম নিশ্চয়ই মায়ের কাছে ছুটে আসবেন শিশুর মতো। কখনও নিজেকে দোষারোপ করলেন, রামের নির্বাসন তাঁর নিজের পাপের ফল। উদ্বেগ ও শোকে দিশাহারা রানি, রাজা দশরথকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে লাগলেন, সেই সঙ্গে শোকে, দুঃখে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা বিনা জীবনের অসারতা অনুভব করলেন। ন হি মে জীবিতে কিঞ্চিৎ সামর্থ্যমিহ কল্প্যতে।

দেবী কৌশল্যার ক্ষোভ, দুঃখ, দোলাচলচিত্ততা দূর করতে এগিয়ে এলেন লক্ষ্মণজননী দেবী সুমিত্রা। প্রকৃত অর্থে ধার্মিক রাম, সৎ ও পুরুষশ্রষ্ঠ। পিতাকে সত্যবাদীরূপে প্রমাণ করেছে সে। এই কারণে সে রাজ্য ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছে। ধার্মিক সৎ ছেলের জন্যে শোক কেন? রামের ছায়াসঙ্গী লক্ষ্মণ তাঁর প্রতি সদয়। প্রাণীদের প্রতি দয়াশীল সেই মহান, যে কোনও বস্তুলাভেই সক্ষম। রামের অনুগামিনী বৈদেহী সীতা, অরণ্যবাসের কষ্ট জানেন। তাই তো তিনি রামের সঙ্গিনী হয়েছেন।
জ্যেষ্ঠা কৌশল্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সংযতেন্দ্রিয় সত্যরূপ ব্রতে নিরত রাম কীর্তির পতাকা ওড়াবেন পৃথিবীতে। তাঁর প্রাপ্তির কী কিছু বাকী আছে আর? রামের পবিত্রতা ও মাহাত্ম্যে বিশেষভাবে অবহিত হয়ে, সূর্যকিরণ তাঁকে সন্তপ্ত করবে না। রামের প্রয়োজনে অরণ্যবায়ু হবে কখনও উষ্ণ ও কখনও শীতল, কল্যাণকর ও সুখপ্রদ, সতত সেবাপরায়ণ। রাতে চন্দ্র,তার কিরণ দিয়ে, পিতৃতুল্য আলিঙ্গনে শয্যায় শায়িত রাঘবের অঙ্গ স্পর্শ করে আহ্লাদে আটখানা হবে। পুরুষোত্তম রামের আছে ব্রহ্মাদত্ত দিব্যাস্ত্র। তাই তার বনবাসযাপন হবে গৃহবাসের মতোই নির্ভয়। রামের তীরের লক্ষ্যপথের নিশানার অধীন শত্রুর, বিনাশ নিশ্চিত।তাই এই পৃথিবী কেন তার শাসনাধীন হবে না? রামের যেমন সৌন্দর্য, তেমনই বিক্রম, যেমন শুভবোধ তার, সে অরণ্যবাসান্তে দ্রুত সিংহাসন অধিগ্রহণ করবেই।

দেবী সুমিত্রা রামের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখে, সূর্য, অগ্নি, প্রভু, শ্রী,কীর্তি, পৃথিবী,দেবতা এবং প্রাণীদের মধ্যে একের থেকে অন্যটি উত্তম হতে পারে, নগরে কিংবা বনে রামের তুলনীয় কে? তস্য কে হ্যগুণা দেবি বনে বাপ্যথবা পুরে। পুরুষশ্রেষ্ঠ রাম অচিরেই পৃথিবী, বৈদেহী সীতা ও শ্রী এই তিন স্ত্রী-সহ অভিষিক্ত হবেন। অযোধ্যা থেকে নিষ্ক্রমণরত রামদর্শনে দুঃখে আকুল হয়ে চোখের জলে ভেসেছিল অযোধ্যাবাসীরা।সেই রাম অচিরেই রাজ হবেন। বনগমনে অপরাজিত রামের সঙ্গ নিয়েছিল কুশচীর পরিধানে দেবী সীতার বেশে লক্ষ্মী, তাই সেখানে রামের যে কোনও দ্রব্যের অভাববোধ দুর্লভ। ধনুর্বাণধারী লক্ষ্মণ, খড়্গ ও অস্ত্র ধারণ করে যাঁর অগ্রবর্তী তাঁর আর কিছু প্রয়োজন হতে পারে কী? জ্যেষ্ঠাকে উজ্জীবিত করলেন কনিষ্ঠা রানি সুমিত্রা,আপনাকে সত্যি বলছি, বনবাস শেষে পুনরাগত রামকে দেখবেন। তাই শোক ও মোহ ত্যাগ করুন। নিব‍ৃত্তবনবাসং তং দ্রষ্টাসি পুনরাগতম্। জহি শোকঞ্চ মোহঞ্চ দেবি সত্যং ব্রবীমি তে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

নবোদিত চন্দ্রদর্শনের আনন্দে পাদবন্দনারত পুত্রকে আবারও দেখবেন।কল্যাণী দেবী কৌশল্যা পুনরায় প্রত্যাগত, অভিষিক্ত রামের সেই মহান দৃশ্য দেখে আনন্দাশ্রু মোচন করবেন। তাই শোক ও দুঃখ কেন? রামের ক্ষেত্রে অশুভ কিছু ঘটবে, এমনটা বোধ হয় নয়। লক্ষ্মণ-সহ, সীতার সঙ্গে রামকে শীঘ্র দেখবেন। নিষ্পাপ কৌশল্যাদেবীর কর্তব্য হল জনগণকে আশ্বস্ত করা। মনের ব্যাকুলতার প্রকাশ কী তাঁকে মানায়? না আর শোক নয়। রামের তুল্য সৎপথাশ্রিত লোক জগতে বিরল।

মায়ের চরণে অভিবাদনরত সুহৃদসহ রামকে দেখে, বর্ষণরত মেঘের মতো কৌশল্যা আনন্দাশ্রু বর্ষণ করবেন অদূরবর্তী সময়ে। সে দিন আর বেশি দূরে নেই যখন, অযোধ্যায় পুনরাগত সেই বরদানকারী কৌশল্যাপুত্র তাঁর কোমল, কঠিন করদুটি দিয়ে জননীর চরণ স্পর্শ করবেন। সেই মহামিলনদৃশ্যের সুখপ্রদ, আন্তরিক ছবি আঁকলেন রানি সুমিত্রা। জননী কৌশল্যা, অভিবাদনরত পুত্রের মা যেন সেই পর্বতের মেঘমালা, যা পর্বতকে বারিবর্ষণে আর্দ্র করে তোলে, তেমনই আনন্দাশ্রুপাতে সিক্ত করবেন আত্মজকে। এই ভাবে বিবিধ বাক্যবিন্যাসে অনন্যা, দেবী সুমিত্রা, নানা সান্ত্বনাবাক্যে দেবী কৌশল্যাকে আশ্বস্ত করে নীরব হলেন।লক্ষ্মণজননীর আশাপ্রদ কথায়, শরৎকালীন স্বল্পজলবাহী মেঘের মতো রানি কৌশল্যার শোকও উধাও হল।

যাঁকে ঘিরে শোক, বিলাপ, বিষাদ সেই সত্যপথের পথিক মহান রামচন্দ্র এগিয়ে চলেছেন অরণ্যবাসের উদ্দেশ্যে। তাঁকে অনুসরণ করে চলেছেন অনুগত মানুষজন। অমাত্যরা সরিয়ে দিয়েছেন রাজা ও রাজপরিবারের শুভাকাঙ্খীদের। কিন্তু রামের রথের অনুগমনরত পুরবাসীদের নিবৃত্ত করতে পারেননি তাঁরা। অযোধ্যাবাসীদের কাছে পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী রামচন্দ্র, বারবার ফিরে যাওয়ার অনুরোধ অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চললেন রাম। লক্ষ্য একটাই —পিতার সত্যনিষ্ঠতা বজায় রাখা। স যাচ্যমানঃ কাকুৎস্থস্তাভিঃ প্রকৃতিভিস্তদা। কুর্ব্বাণঃ পিতরং সত্যং বনমেবান্বপদ্যত।। সন্তানসম প্রজাদের সস্নেহে নিরীক্ষণ করে বললেন, অযোধ্যাবাসীরা তাঁর প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল তেমনই সম্মান ও ভালবাসা অনুজ ভরতেরও প্রাপ্য।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

ভরতের প্রতি প্রজাদের সেই সম্মানপ্রদর্শন রামের সবথেকে প্রিয় হবে। যা প্রীতির্বর্তমানশ্চ ময্যযোধ্যানিবাসিনাম্। মৎপ্রিয়ার্থং বিশেষেণ ভরতে সা বিধীয়তাম্।। সেই কল্যাণকামী কৈকেয়ীর আনন্দবর্দ্ধক পুত্র ভরত, প্রজাদের জন্যে যথাযথ প্রিয় ও হিতকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। ভরতের গুণবর্ণনা করলেন রাম। ভরত বয়সে নবীন হলেও জ্ঞানে প্রবীণ। শৌর্যশালী কিন্তু কোমল। তাই তিনি হবেন, যথার্থ প্রজাপালক এবং পরিত্রাতা। অনুরূপঃ স বো ভর্ত্তা ভবিষ্যতি ভয়াপহঃ। রাজোচিত গুণান্বিত ভরত, যুবরাজপদের তাঁর যোগ্যতা, রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। তাই সজ্জন প্রজাবৃন্দ যেন তাঁর শাসন মেনে চলেন। রাম বনবাসী হলেও, তাঁর প্রিয়কাজ সাধন করেন যেন প্রজারা।মহারাজ দশরথ যেন কোনওভাবেই মনে মনে উত্তেজিত না হন।

রামের এই উপদেশের ফল হল বিপরীত। যতই তিনি ধর্মসম্মত উপদেশ দান করলেন ততই প্রজাদের রামকে শাসকরূপে প্রাপ্তির প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিলেন। রাম ও সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণ যেন অশ্রুভারাক্রান্ত, দীন প্রজাদের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে বেঁধে রাখলেন। সমবেত পুরবাসীদের মধ্যে ছিলেন জ্ঞানব‍ৃদ্ধ, বয়সে প্রবীণ,তপোবলে বরিষ্ঠ ব্রাহ্মণ, বার্দ্ধক্যজনিত কারণে তাঁদের মাথা সর্বদাই কম্পমান, এমন দ্বিজরা রামের অশ্বগুলির উদ্দেশ্যে বললেন, রামের বাহক,বেগবান অশ্বরা যেন প্রভুর মঙ্গলকামনায় আর অগ্রগামী না হয়। তাদের ফিরে আসা কর্তব্য। নিবর্ত্তধ্বং ন গন্তব্যং হিতা ভবত ভর্ত্তরি। প্রাণীমাত্রের শ্রবণশক্তি আছে। ঘোড়াদের বিশেষ কান আছে। তাই এই বৃদ্ধদের প্রার্থনা শুনে তারা যেন ফিরে আসে। প্রৌঢ়দের অনরোধ —অশ্বদের প্রভু, রাম, ধর্মানুসারে পূতচরিত্র, বীর। তাঁর মঙ্গলব্রতে আছে দৃঢ়তা। ধর্মসঙ্গত কাজ হল — তাঁকে নগরের বাইরে বনে নয়, পুরাভিমুখে বহন করে আনাই কর্তব্য। আর্তস্বরে বিলাপরত ব্রাহ্মণদের প্রলাপ শুনে, রাম হঠাৎ রথ থেকে অবতরণ করলেন।সীতা ও লক্ষ্মণসহ রাম পদব্রজে অরণ্যের অভিমুখে যাত্রা করলেন। কারণ পায়ে হেঁটে চলেছেন ব্রাহ্মণরা,রথারূঢ় অবস্থায় তাঁদের অতিক্রম করা —চরিত্রবান রামের, সঙ্গত বলে মনে হল না।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

দ্বিজাতীন্ হি পদাতীংস্তান্ রামশ্চারিত্রবৎসলঃ। ন শশাক ঘৃণাশ্চক্ষুঃ পরিমোক্তুং রথেন সঃ।। রামের যাত্রার অভিমুখ কিন্তু সেই অরণ্য। উত্তেজিত ব্রাহ্মণরা সসম্ভ্রমে বললেন রামকে, ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণরা তাঁকে অনুসরণ করছেন। অগ্নিরা দ্বিজদের স্কন্ধারূঢ় হয়ে রামের অনুগামী হয়েছেন। শরৎকালীন মেঘের মতো বাজপেয়যাগলব্ধ ছাতাগুলিও পেছনে অনুসরণরত অবস্থায় দৃশ্যমান। স্নেহভরা কণ্ঠে যেন বলে উঠলেন তাঁরা, তোমার (রাজছত্র) ছত্র নেই, আমাদের বাজপেয়যাগলব্ধ ছত্রগুলি দিয়ে, রৌদ্রতাপিত তোমার জন্যে ছায়া সৃষ্টি করব।। অনবাপ্তাতপত্রস্য রশ্মিসন্তাপিতস্য তে। এভিশ্ছায়াং করিষ্যামঃ স্বচ্ছত্রৈর্বাজপেয়কৈঃ।। দ্বিজগণ জানালেন তাঁদের বুদ্ধি, বেদমন্ত্রের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, রামের কারণেই এখন সে বুদ্ধি বনবাসে উন্মুখ হয়েছে। তাঁদের পরম সম্পদ বেদ, হৃদয়ের গহনেই সঞ্চিত থাক। স্ত্রীরা, চরিত্রের বলে নিজ নিজ সুরক্ষাবন্ধনে গৃহেই বসবাস করুন। বিপ্রগণ রামের সহযাত্রী হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ বিষয়ে চিন্তার কিছু নেই। ব্রাহ্মণদের একটিই চিন্তার বিষয়, ত্বয়ি ধর্ম্মব্যপেক্ষে তু কিং স্যাদ্ধর্ম্মপথে স্থিতম্। তুমি যদি ধর্মের অপেক্ষা না করো তবে ধর্মপথে থাকবে কে? তাঁরা হংসতুল্য শুক্লকেশপূর্ণ ভূলণ্ঠিত,ধূলিধূসর মস্তকে কাতরোক্তিতে প্রার্থনা জানালেন, নিবর্ত্তস্ব ফিরে এস। যজ্ঞ অসমাপ্ত রেখে বহু ব্রাহ্মণ সমাগত হয়েছেন। বাছা, তোমার প্রত্যাগমনে তাঁদের যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। তেষাং সমাপ্তিরায়ত্তা তব বৎস নিবর্ত্তনে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ

রামের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল চলমান প্রাণীরা, তেমনই অচর প্রাণীরাও (উদ্ভিদকুল)। তাদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে রাম ফিরে আসে যেন। ভক্তদের ভক্তির মান রাখ। ব্রাহ্মণদের কণ্ঠে যেন আবেগের ঢেউ। সমুন্নত তরুদের মূল ভূতলে প্রোথিত। তাই তারা গতিশক্তিহীন হয়ে অনুগমনে অক্ষম। বায়ুবেগে কাঁপতে কাঁপতে যেন ক্ষোভ প্রকাশ করছে ওই বৃক্ষরা। পাখিরা আহার বিহার ত্যাগ করে এক স্থানে নিশ্চল হয়ে বসে, রামের অনুকম্পার প্রার্থনারত তারা। ব্রাহ্মণরা রামকে প্রত্যাবর্তনের জন্যে নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকলেন যখন, তখন অদূরে দৃশ্যমান হল তমসা নদী, তারও একই বনগমন নিষেধের অনুরোধ।

সারথি সুমন্ত্র তখন ক্লান্ত অশ্বগুলিকে রথ হতে মুক্ত করে তমসানদীতে জলপান করালেন। তাদের সর্বাঙ্গে জল প্রবাহিত হল। তাদেরকে নদীতীরে বিচরণ করতে দিলেন, সারথি।

রামায়ণ পারিবারিক বন্ধনের কাব্য। রাজপ্রাসাদের নিয়মতান্ত্রিক বাতাবরণের মধ্যেও প্রকট হয়েছে সেখানে যৌথপরিবারের সহমর্মিতা, স্নেহ ও শ্রদ্ধার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সেখানে আছে কৈকেয়ীর অন্তর্ঘাত, তার ফলস্বরূপ ভাবি ক্ষমতাসীন পুত্রের মায়ের অসহায়তা, জ্যেষ্ঠার দুঃখে দেবী সুমিত্রার সহানুভূতির প্রলেপ, নিজের পুত্রের বনবাসের দুঃখ ভুলে ধার্মিক রামের সত্যপরায়ণতার গুণগান, এ সব কিছ রাজপরিবারের প্রাসাদের প্রাচীরের আড়ালে সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে ভারবর্ষের যৌথ পারিবারিক পরিমণ্ডলের নিত্যদিনের গল্প। যোগ্য দায়িত্বশীল পুত্রকে কে না সমাদর করে? পারিবারিক গণ্ডীর পরিব্যাপ্ত হয়েছে বৃহত্তর রাজ্যের পরিসরে। সুমিত্রা, শোকাকুলা কৌশল্যার সামনে রামের সঙ্গে পুনর্মিলনের আশার ছবি এঁকেছেন। দীর্ঘ প্রবাসী পুত্রের আগমনপ্রতীক্ষায় দিন গোণে প্রিয়জনেরা, রামজননী কৌশল্যাকে সেই আশার বাণী শুনিয়েছেন সুমিত্রা। নিজের দুঃখ ভুলে প্রিয়জনের শোকনিবৃত্তি যে ভারতীয় পারিবারিক জীবনের ঐতিহ্য। এ ভাবেই স্নেহ,মায়া,মমতার বাঁধন ঘিরে রাখে আবহমান সামাজিক ভারতীয় জীবন।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রামচন্দ্রের বনবাসগমনে প্রজাপুঞ্জের উত্তাল আবেগের প্রকাশে পিছুটান অনুভব করেছেন কী ভাবি অযোধ্যাপতি? কোথাও একটা আঁচরেও সেই লৌহকঠিন মানুষটির দুর্বলতা ফুটিয়ে তোলেননি মহর্ষি বাল্মীকি। অদম্য তাঁর মনোবল,তাঁর সম্মুখে নিজের আসন্ন অরণ্যবাসের অনিশ্চিত জীবন। সে চিন্তা তাঁর মনে কোনও উদ্বেগ সৃষ্টি করে না। ফেলে আসা রাজ্যপাটের অধীশ্বর ভরতের প্রতি প্রজাদের আনুগত্য ও সম্মান উদ্ধার করবার লক্ষ্যে ভরতের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে চলেন সমান আগ্রহ নিয়ে। প্রজাদের মনে রাম তাঁর উজ্জ্বলতা নিয়ে বিরাজমান তখনও।ভরতপ্রশংসায় রামের প্রতি প্রজাদের প্রত্যাশা বৃদ্ধি পেল আরও। যুগে যুগে, ভারতবাসীদের একজন উদারমনা শাসকের চিরন্তন প্রতীক্ষা চলে আসছে।

বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণরা নিজেদের মনোবেদনা জানিয়েছেন, বর্ণনা করেছেন,রামের বিচ্ছেদে ব্যথাতুর বিশ্বচরাচরের বিষাদ। ক্রৌঞ্চের শোকে বিষণ্ণ মহাকবির কণ্ঠ হতে উৎসারিত হয়েছিল প্রথম ছন্দোবদ্ধ অভিশাপবাণী। শান্ত,সমাহিত পরিবেশ নষ্ট হয়েছিল ক্রৌঞ্চবধের ফলে ক্রৌঞ্চীর আকুল বিলাপে।সেই সূচনা। রাজ্যাভিষেকের আনন্দকে বিদ্ধ করল রানির আকস্মিক অযৌক্তিক প্রস্তাবের বিষময় তীর। অযোধ্যার পারিবারিক পরিমণ্ডলের শান্তি বিঘ্নিত হল,নষ্ট হল প্রজাদের প্রত্যাশা,দোলাচলে রইল অযোধ্যার প্রশাসন।আদিকবির কাব্যে বার বার প্রমাণিত হয়েছে, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, প্রাকৃতিক, পরিবেশ প্রদূষণের স্রষ্টা মানুষ। আজ সেটি প্রমাণিত সত্য।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content