মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রাম পিছুটান উপেক্ষা করে চলেছেন বনবাসে। রামের নির্দেশে সারথি সুমন্ত্র রথ ছোটালেন চরম অশ্বগতিতে। তাঁর রথের পিছনে ধাবমান জনস্রোত, স্বজন, স্নেহশীল বৃদ্ধ পিতা। অন্তঃপুরিকাদের আর্ত চিৎকার, অনাথ, দুর্বল, সহায়হীন মানুষের আশ্রয় যিনি, তিনি আজ কোথায় চলেছেন? যিনি শত অভিসম্পাতেও ক্রোধ প্রকাশ করতেন না বরং ক্রোধের বিষয় বর্জন করে ক্রোধীদের রোষ শান্ত করতেন, সেই সমদুঃখভাগী রাম আজ কোথায় যাচ্ছেন? মহাতেজস্বী রামের, জননী কৌশল্যার সঙ্গে যেমন আচরণ আমাদের সঙ্গেও অনুরূপ ব্যবহার। সেই মহানুভব রাম আজ কোথায় গেলেন? কৌসল্যায়াং মহাতেজা যথা মাতরি বর্ত্ততে। তথা যো বর্ত্ততেঽস্মাসু মহাত্মা ক্ব নু গচ্ছতি।।

রাজা দশরথের সমালোচনায় মুখর হলেন তাঁরা। রানি কৈকেয়ীর জোরাজুরিতে, রাজা, যাঁকে বনগমনে বাধ্য করেছেন সেই জগতের পরিত্রাতা রাম, কোন গন্তব্যে উধাও আজ? হায়, রাজা দশরথের কী চৈতন্য লোপ পেয়েছে? বিশ্বচরাচরের আশ্রয়, সত্যব্রত, ধার্মিক রামকে রাজা বনে নির্বাসিত করছেন? বৎসহারা গাভীর তুল্য রাজার মহিষীদের উচ্চস্বরে আকুল রোদন যেন ভারাক্রান্ত করে তুলল পরিবেশ। সেই আর্তস্বর শুনে, পুত্রশোকে কাতর রাজা দশরথের শোক দ্বিগুণ হল।

অকালে আঁধার ঘনাল অযোধ্যায়। যেন অসময়ে, সূর্য অস্তমিত হলেন। যাগকারীরা অগ্নিহোত্রযাগে আহুতিদানে বিরত হলেন। গাভীরা বৎসদের দুধ পান করালো না। হাতি আহার বর্জন করল। ত্রিশঙ্কু, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি এই সব দারুণ গ্রহসমূহ চন্দ্রের নিকটবর্তী হল। নক্ষত্ররা হল প্রভাহীন, গ্রহরা তেজ হারালো, বিশাখা নক্ষত্র ধূমসহ প্রকাশমান হল আকাশে। কালো ঘনঘটা বাতাসে উত্তাল হয়ে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের তুল্য দৃশ্যমান হল। রামের বনগমনেহেতু কেঁপে উঠল অযোধ্যা নগরী। অন্ধকারাচ্ছন্ন দিগ্মণ্ডলে দিকনির্ণয় করা দুষ্কর হয়ে উঠল। আকাশে কোথাও গ্রহ, নক্ষত্রে নেই। অযোধ্যাবাসীরা যেন দৈন্য অনুভব করলেন। আহারে, বিহারে আর তাঁদের রুচি নেই। শোকতপ্ত নাগরিকবৃন্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে রাজার প্রতি ক্রোধ ব্যক্ত করতে লাগলেন। শোকপর্য্যায়সন্তপ্তঃ সততং দীর্ঘমুচ্ছ্বসন্। অযোধ্যায়াং জনঃ সর্ব্বশ্চুকোপ জগতীপতিম্।।
রাজপথে দৃশ্যমান অযোধ্যাবাসীদের চোখে জল, মুখে হাসি নেই, সকলেই শোকার্ত। শীতল বায়ু নিষ্ক্রিয় হল, চন্দ্রের সৌন্দর্য উধাও, সূর্য উত্তাপহীন, সমস্ত পৃথিবী ব্যাকুল হয়ে উঠল। স্বজনদেরকে ভুলে গেলেন প্রত্যেকে, স্বামী স্ত্রীকে, ভাই ভাইকে চিনল না আর। সকলেই সব চিন্তা ছেড়ে, রামের চিন্তায় মগ্ন। রামের শুভাকাঙ্ক্ষীরা হলেন হতবুদ্ধি, শোকাবেগ তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিল। ইন্দ্রের অভাবে, গিরিসমন্বিতা পৃথিবী যেমন বিচলিত হয় তেমনই হাতিঘোড়া ও সেনা পরিবৃতা অযোধ্যানগরী রামের বিরহে ভয়ে, শোকে, বিচলিত হয়ে চিৎকার করে উঠল।

রামের যাত্রাপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন অযোধ্যাপতি দশরথ। ধার্মিক প্রিয় পুত্রের দিকে চেয়ে চেয়ে তাঁর আশ মিটল না, যেন বৃদ্ধি পেল আরও। নয়নপথের বাইরে চলে গেলেন রাম। শোকার্ত, পীড়িত রাজা মূর্চ্ছিত হলেন। লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। রানি কৌশল্যা তাঁর শরীরের ডানদিক, কৈকেয়ী বাম অংশ ধারণ করলেন। ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক রাজা ব্যথিতহৃদয়ে, সবিনয়ে কৈকেয়ীকে বললেন—ওরে পাপিষ্ঠা, আমাকে স্পর্শ করো না। তুমি আর আমার স্ত্রী নও, নও বান্ধবী। তোমার মুখদর্শন করতে চাই না, তোমার অনুজীবীদেরও নয়। তারা আমার নয়, আমিও তাদের নই ন হি ত্বাং দ্রষ্টুমিচ্ছামি ন ভার্য্যা ন চ বান্ধবী। যে চ ত্বামনুজীবন্তি নাহং তেষাং ন তে মম।।

রানি শুধু নিজের স্বার্থরক্ষায় তৎপর, ধর্মবোধ নেই তাঁর। তাই রাজা তাঁকে ত্যাগ করছেন। তাঁর পাণিগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে অগ্নি প্রদক্ষিণ করেছিলেন। ইহলোক ও পরলোকে অবশ্য সেটি অনস্বীকার্য। রাজা জানিয়ে দিলেন, ভরত যদি এই অক্ষয় রাজ্য লাভ করে তুষ্ট হয় তবে সে পিতার উদ্দেশ্যে যা কিছু (পিণ্ড,জলদান প্রভৃতি) দান করবে, সেগুলি অস্বীকার করবেন রাজা। রানি কৌশল্যা, পুত্রশোকে কাতর ধূলিধূসরদেহ রাজাকে নিয়ে ফিরে গেলেন প্রাসাদে। স্বেচ্ছায় অগ্নি স্পর্শ করলে বা ব্রহ্মহত্যায় যে তীব্র অন্তর্জ্বালা হয় রামের চিন্তায় রাজা দশরথের সেই এক দশা। ফিরে ফিরে তাকালেন রামের রথের পথচিহ্নের দিকে,তাঁর রাজোচিত গরিমা যেন রাহুগ্রস্ত মলিন সূর্যতুল্য ম্লান হল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-১০১: নিরোগ ও উচ্চমানে মাছচাষের জন্য অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিতে হবে

রাজার পরিতাপের যেন শেষ নেই। নগর ছাড়িয়ে রথের পথ বনের দিকে প্রসারিত হল। ঘোড়া ছুটছে,পদচিহ্ন এঁকে, সেই চিহ্নগুলি দেখে হাহাকার কর উঠলেন রাজা, পদানি পথি দৃশ্যন্তে স মহাত্মা ন দৃশ্যতে। হায় পদচিহ্ন দৃশ্যমান, কিন্তু মহান পুত্রকে দেখা যাচ্ছে না। যে সুখশয্যায় নরম বালিশে মাথারেখে, চন্দনচর্চিত দেহে সে শয়ন করত, সেরা নারীরা তখন বাতাস করতে তাকে। সে আজ কাঠ বা পাথরে মাথা রেখে শয়ন করবে। সেই রাম ধূলিধূসরদেহে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন পার্বত্য ঝর্ণাতলা থেকে, হস্তিনীদের গজেন্দ্রসম ভূমিশয্যা থেকে দীনভাবে উঠে দাঁড়াবেন,তখন বনবাসীরা দেখবেন, দীর্ঘবাহু অনাথ রাম দীনহীনভাবে পদব্রজে চলেছেন। সুখে লালিতা, জনককন্যা সীতা, কাঁটার ঘায়ে পরিশ্রান্ত হয়ে বনপথে ঘুরে বেড়াবেন যখন, বনবাসে অনভিজ্ঞা সে, হিংস্র বন্য শ্বাপদের রোমহর্ষক গুরুগম্ভীর ধ্বনি শুনে নিশ্চয়ই ভীতত্রস্ত হয়ে উঠবেন।

রাজা যেন অভিসম্পাত দিলেন রানি কৈকেয়ীকে, কৈকেয়ীর মনস্কামনা পূর্ণ হোক। বিধবা হয়ে রাজ্যশাসন করুন তিনি, পুরুষশ্রেষ্ঠ রাম বিনা আমি বাঁচব না। সকামা ভব কৈকেয়ি বিধবা রাজ্যমাবস। ন হি তং পুরুষব্যাঘ্রং বিনা জীবিতুমুৎসহে।। জনতা পরিবৃত, বিলাপরত রাজা যেন অশুচি স্নানান্তে কোন ব্যক্তি। তিনি নিজের উত্তম প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। কী দেখলেন রাজা? প্রাসাদ চত্বর ও গৃহ জনহীন, শূন্য। বিপনিগুলির দ্বার রুদ্ধ। রাজপথে ভিড় করে আছেন দুঃখদীর্ণ পুরবাসীরা। রামের কথা চিন্তা করতে করতে ক্রন্দনরত রাজা মেঘের আড়ালে সূর্যের মতো প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। রাম,লক্ষ্মণ,সীতা নেই সেখানে। যেন গরুড় দ্বারা মহাসর্পহীন সংক্ষোভশূন্য সরোবরতুল্য উচ্ছ্বাসবিহীন সেই প্রাসাদ।

রাজার শান্তি নেই কোথাও। এখন তাঁর একমাত্র আশ্রয় রাম জননী কৌশল্যা। বিষণ্ণ রাজা ভেঙ্গেপড়া মৃদুকণ্ঠে, আদেশ দিলেন, কৌসল্যায়া গৃহং শীঘ্রং রামমাতুর্নয়ন্তুমাম্।ন হ্যন্যত্র মমাশ্বাসো হৃদয়স্য ভবিষ্যতি।। দ্বাররক্ষীরা রাজাকে নিয়ে গেলেন কৌশল্যার কক্ষে। শূন্যতার শেষ নেই। রাম নেই,লক্ষ্মণ নেই,নেই পুত্রবধূ সীতা। চন্দ্রহীন আকাশের মতো নিষ্প্রাণ রাজপুরী। ঊর্ধ্বে হাত তুলে রাজা আর্তস্বরে বলে উঠলেন, রাম বিজহাসি নৌ রাম আমাদের দু’ জনকে তুমি ত্যাগ করলে? তাঁর আক্ষেপের অন্ত নেই। রাম বনবাসান্তে ফিরে আসবেন তখন, তখন যাঁরা জীবিত থেকে তাঁকে দর্শন করবেন, আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরবেন, তাঁরাই প্রকৃত সুখী।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

এলো সেই কালরাত্রি। রাজা, রাত্রির অর্দ্ধভাগে রানি কৌশল্যাকে বললেন, আমায় স্পর্শ করো, আমি তোমায় দেখতে অক্ষম হয়েছি। আমার দৃষ্টিশক্তি হরণ করেছে রাম, আমি তা ফিরে পাইনি। ন ত্বাং পশ্যামি কৌসল্যে সাধু মাং পাণিনা স্পৃশ। রামং মেঽনুগতা দৃষ্টিরদ্যাপি ন নিবর্ত্ততে।। দেবী কৌশল্যা দেখলেন, বিলাপরত রাজা ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে রামকেই চিন্তা করে চলেছেন, তাঁর পাশটিতে বসে রানি অতিদুঃখে কাঁদতে লাগলেন।

রানি কৌশল্যার মনে এতদিন ধরে যে রোষ, অভিমান, বঞ্চিতার ক্ষোভ ধূমায়িত ছিল,রাজাকে কাছে পেয়ে যেন তার বিস্ফোরণ ঘটল। পুত্রশোকাতুর দশরথকে তিনি কোনমতেই ছাড়বেন না। বলে চললেন, রামের প্রতি বিষতীর নিক্ষেপ করে জটিলা কুটিলা রানি কৈকেয়ী এখন খোলসহীন সর্পিণীর মতো বিচরণ করে বেড়াবেন। রামকে কৌশলে বনবাসে পাঠিয়ে নিজের কার্যোদ্ধারে তৎপর সেই গৃহবাসিনী দুষ্টা ভুজঙ্গী হয়ে কৌশল্যার মনে ত্রাস সৃষ্টি করবেন।

দেবী কৌশল্যার অভিমত, এই পরিস্থিতি থেকে বরং রামের ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে নগরে অবস্থান করা ভালো ছিল বা দাসত্বের বরদান বরং ভালো ছিল। কৈকেয়ী যেন স্বেচ্ছায়,সাগ্নিক ব্রাহ্মণের মতো, যজ্ঞের প্রারম্ভে, রাক্ষসের নির্দিষ্ট ভাগ হিসেবে, রামকে স্থানচ্যুত করে, তাদের উদ্দেশ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। এতক্ষণে গজরাজতুল্য গমন যাঁর, সেই বীর্যবান, মহাবাহু, রাম ধনুর্দ্ধারণ করে, সপত্নী, লক্ষ্মণ-সহ অরণ্যে প্রবেশ করেছেন নিশ্চয়ই। কৈকেয়ীর পরামর্শে, বনবাসের কঠোরতা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ, অবুঝ রামকে লক্ষ্মণ ও সীতাসহ অরণ্যে নির্বাসিত করলেন রাজা।

কী অবস্থা হবে তাদের? তাঁদের কাছে রত্নসম্পদ নেই, এখন জীবনোপভোগের সময়। এই তরুণ বয়সে, ফলমূল ভক্ষণ করে কীভাবে দীন জীবন যাপন করবে তারা? গভীর দুঃখের সঙ্গে রানি বললেন, তাঁর কী আর সেই শুভযোগ আসবে? যখন, দুঃখের কাল কেটে যাবে, তিনি আবার অচিরেই লক্ষ্মণসহ সপত্নীক রামকে দেখবেন? এমন সুসময় কী ফিরে আসবে আবার? যখন দুই ভায়ের প্রত্যাবর্তনের সংবাদে,অযোধ্যা নগরী গৌরবান্বিতা হবে, আনন্দে হেসে উঠবে পুরজনেরা?কবেই বা পুনরাগত নরব্যাঘ্রদ্বয়কে দেখে, পর্বকালীন সমুদ্রের মতো আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে অযোধ্যা নগরী? আর কতদূর সেই দিন যখন গাভীকে সামনে রেখে বৃষভ যেমন গৃহে ফিরে আসে তেমনই অগ্রবর্তিনী সীতাসহ রথারূঢ় রাম প্রাসাদে প্রবেশ করবে? দেবী কৌশল্যা যেন মানসদৃষ্টিতে দেখছেন,প্রাসাদে প্রবেশরত দুই বীর পুত্রের ওপরে লাজ বর্ষণ করছেন শতসহস্র জনতা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

আহা, এই নয়নাভিরাম দৃশ্য কবে দৃষ্টিগোচর হবে তাঁর?ব্রাহ্মণকন্যারা কবে পুরীতে প্রবেশোদ্যত পুত্রদের আগমনে হৃষ্টচিত্তে, ফলফুল নিয়ে, প্রাসাদ প্রদক্ষিণ করবেন? কখন সেই ধার্মিক রাম পরিণতবুদ্ধি ও পরিণতবয়স্ক হয়েও বালকের মতো ছুটে আসবেন মায়ের কাছে?নিজেকে দোষারোপ করতে থাকলেন রানি কৌশল্যা।তিনি অবশ্যই কদর্যস্বভাবের মহিলা। তাই হয়তো কোনোদিন দুধপানেচ্ছু বৎস্যদের বঞ্চিত করে তাদের গাভীমায়ের স্তন কেটে ফেলেছিলেন। সেই পাপের ফলেই হয়তো, নিজ বৎসদের প্রতি স্নেহশীলা, সিংহের দ্বারা নিহতবৎসা গাভীটির মতোই কৈকেয়ী দ্বারা পুত্রবিযুক্তা হয়েছি। সাহং গৌরিব সিংহেন বিবৎসা বৎসলা কৃতা। কৈকেয্যা পুরুষব্যাঘ্র বালবৎসেব গৌর্বলাৎ।।

রাম তাঁর একমাত্র পুত্র। গুণী, সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত পুত্রকে ছেড়ে রানির জীবনধারণের উৎসাহ নেই কোন। সেই প্রিয় রাম ও মহাবলী লক্ষ্মণ বিনা তাঁর বেঁচে থাকা নিরর্থক। গ্রীষ্মে প্রখর তপনতাপ তেমন পৃথিবীকে দগ্ধ করে তেমনই পুত্রশোকের নিদারুণ বহ্নিতাপ দগ্ধ করছে আমায়। অয়ং হি মাং দীপয়তে সমুত্থিততনুজশোকপ্রভবো হুতাশনঃ।মহীমিমাং রশ্মিভিরুদ্ধতপ্রভো যথা নিদাঘে ভগবান্ দিবাকরঃ।।

রামের বনবাসগমনে—রাজা দশরথের মানসিক প্রতিক্রিয়ায়,একজন স্নেহাশীল পিতার পুত্রবিচ্ছেদের আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। রাজা দশরথ নয়, ঘরোয়া পারিবারিক পরিবেশে, বিদেশবিভুয়ে প্রস্থানরত পুত্রের বিচ্ছেদবেদনায় কাতর একজন পিতার প্রতিচ্ছবি প্রকট হয়েছে। রাজা দশরথ নিজের রাজ্যের ভবিষ্যতের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেননি। একজন উপযুক্ত এবং যোগ্য রাজকীয় উত্তরাধিকারে বঞ্চিত পুত্রকে দীর্ঘদিনের জন্যে হারাতে চলেছেন সেই কারণে পারিবারিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন তিনি। যোগ্যকে বঞ্চনার অন্তর্দাহ তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

একই মনোবেদনা গ্রাস করেছে রাম জননীকে।সতীন কৈকেয়ীর দ্বারা অপমানিত ও অত্যাচারিত হওয়ার আশঙ্কায় ব্যাকুল হয়েছেন তিনি। গৃহে প্রচ্ছন্ন বিষাক্ত সর্পিণীর ভয়ে ত্রস্ত হয়ে তিনি রামের উপস্থিতির গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুধাবন করেছেন।তারুণ্যে উপনীত রামের ভরা যৌবনে অরণ্যবাসের কঠোর নির্মম জীবনের কষ্ট, মাকে দুঃখ দিয়েছে নিশ্চয়ই। তবে রামের অনুপস্থিতি তাঁকে বিচলিত করেছে বেশি। তিনি দাসত্ব অবলম্বনে পুত্রের প্রাসাদে অবস্থান কামনা করেছেন কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনে নগরে রামের উপস্থিতি হয়তো বেশি কাম্য ছিল তাঁর। প্রবাসী পুত্রের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণে চলেছেন। আশাব্যঞ্জক ছবি এঁকেছেন। কখনও নিজেকে দোষ দিয়েছেন। এ সবই চিরকালীন মায়েদের সন্তানস্নেহের উৎসারণচিত্র।

একজন মানুষের সাময়িক দীর্ঘ অনুপস্থিতি,যখন সার্বিকভাবে জনমানসে বিচ্ছেদবেদনার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তবে তাঁর ব্যক্তিত্বের অবিসংবাদী প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরিকারা, রামের নির্বাসনের প্রতিবাদে রাজা দশরথের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। অন্তঃপুরিকারা রামের মা কৌশল্যার সঙ্গে রামের অভিন্ন মাতৃত্বের দাবিদার। কারণ তাঁদের প্রতি রামের সমদর্শিতা। সেই প্রতিবাদ রাজা দশরথকে আলোড়িত করেছে, শোকে মুহ্যমান রাজার শোক আরও প্রগাঢ় হয়েছে।

একদা প্রিয় স্ত্রী কৈকেয়ীকে পরিত্যাগ করেছেন রাজা। শুধু তাই নয় কৈকেয়ীপুত্র ভরতের পুত্ররূপে পিতার প্রতি কর্তব্যগুলিকেও অস্বীকার করেছেন। রাজা দশরথের শোক, এক অসহায় পুত্রশোকাতুর পিতার পুত্রবিচ্ছেদহেতু মনোবেদনামাত্র, রাজার রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী প্রদানের অক্ষমতাজনিত পরিতাপ নয়। অরণ্যবাসে রামের দৈনন্দিন বৈভবহীন জীবনের ক্লেশ তাঁকে ব্যথাতুর করে তুলেছে অনেক বেশি।

সন্তানস্নেহ অতি বিষম। ভারতীয় রাজনীতিতে এ চিত্র বিরল নয়। অপত্যস্নেহে শাসক দুর্বল হন, জনমতকেও অস্বীকার করেন, স্বাভিমতকে, স্বার্থচিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। রাজা দশরথ, পারিবারিক চক্রান্তের শিকার হয়ে জনমতকে অস্বীকার করেছেন, এ বিষয়ে তাঁর নৈতিক সমর্থন একবারেই ছিল না। কিন্তু জেনে, শুনে, শাসকদের প্রতিনিধি কেউ যদি যোগ্যকে বঞ্চিত করে স্বজন পোষণ করেন তবে তিনি কী রানি কৈকেয়ীর মতোই ধিক্কৃত নন আজও?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content