শুক্রবার ২৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর বিবাহ, মহাসমারোহে, সম্পন্ন হল। মহর্ষি ব্যাসদেব ছিলেন পাণ্ডবদের বল ও ভরসা। এই কারণে, দেবতাদের থেকেও তাঁদের ভয় ছিল না। প্রাসাদে, দ্রুপদরাজের মহিষীরা পর্যন্ত নিজেদের নামোল্লেখ করে, প্রত্যেকে, পাণ্ডবমাতা কুন্তীর পদবন্দনা করতেন। কৃষ্ণা পাঞ্চালী, ক্ষৌম বসন পরিধান করে, মাঙ্গলিক কাজ সম্পন্ন করলেন। শাশুড়িমাতাকে অভিবাদন জানিয়ে জোড় হাতে অপেক্ষা করলেন দ্রুপদকন্যা। শাশুড়ি স্নেহমিশ্রিত প্রীতিসম্ভাষণে, বধূ মাতাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন, যথেন্দ্রাণী হরিহয়ে স্বাহা চৈব বিভাবসৌ। রোহিণী চ যথা সোমে দময়ন্তী যথা নলে।। যথা বৈশ্রবণে ভদ্রা বশিষ্ঠে চাপ্যরুন্ধতী। যথা নারায়ণে লক্ষ্মীস্তথা ত্বং ভব ভর্ত্তৃষু।। ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী, অগ্নির স্বাহা, চন্দ্রের রোহিণী, নলের দময়ন্তী, কুবেরের ভদ্রা, বৈশিষ্ঠের অরুন্ধতী, নারায়ণের লক্ষ্মী যেমন বধূ, তেমনই পতিদের আদরণীয়া, বধূ হও তুমি। দ্রৌপদীকে আরও অনেক শুভেচ্ছা জানালেন দেবী কুন্তী। বধূ যেন চিরজীবী ও বীরপ্রসূ পুত্রের জন্ম দান করেন। বহু সুখ লাভ করে বহু গুণের আধার হন দ্রৌপদী। সৌভাগ্যবতী হয়ে জীবনকে উপভোগ করুন তিনি। দ্রৌপদী, যজ্ঞে, স্বামীদের সহায়তাকারিণী ও পতিব্রতা স্ত্রী হন।

অতিথি, অভ্যাগত, সাধু, বৃদ্ধ,বালক ও গুরুজনদের যথাবিধি সেবাপরায়ণা হয়ে তাঁর চিরকাল অতিবাহিত হোক। কুরুজাঙ্গল দেশে যে সব প্রধান রাজ্য ও নগর আছে, সেখানে, ধর্মানুগতা দ্রৌপদী, নৃপতির সঙ্গে অভিষিক্তা হন। মহাবলশালী স্বামীগণ পরাক্রমসহ পৃথিবী জয় করবেন যখন, দ্রৌপদী সেই সব,যেন অশ্বমেধ মহাযজ্ঞে ব্রাহ্মণদের দান করেন। শাশুড়ির আশীর্বাদ,পৃথিবীতে যা কিছু উত্তম রত্ন আছে সেগুলি কল্যাণী গুণবতী দ্রৌপদী লাভ করুন, শত শরৎ সুখে অতিবাহিত হোক। দেবী কুন্তী, আজ ক্ষৌম বসনা বধূমাতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, পুত্রের জননী হলে পুত্রগরবিনী মাকে আবারও অভিনন্দন জানাবেন। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ পাণ্ডবদের মুক্তা ও বিচিত্র বৈদুর্য্যমণিভূষিত স্বর্ণালঙ্কার প্রেরণ করলেন শ্রীকৃষ্ণ। মাধব, নানা দেশের বহু মূল্যবান বসন,স্পর্শে সুখ আছে এমন কম্বল, চর্ম, সুলক্ষণযুক্ত রত্নসমূহ, বিবিধ মূল্যবান শয্যা, আসন, বাহন, বৈদূর্য্যমণিচিত্রিত বাসন এবং রূপযৌবনবতী ঔদার্যবতী অলঙ্কৃতা নানা দেশীয় শত শত দাসী পাঠালেন। প্রশিক্ষিত হাতি,সুশিক্ষিত মদ্রদেশীয় শোভনাকৃতি সালঙ্কার উত্তম ঘোড়া যাদের বাহন এমন অনেক রথ, কোটি কোটি স্বর্ণমুদ্রা এবং অকৃত্রিম সুবর্ণপিণ্ড পাঠালেন মধুসূদন কৃষ্ণ।কৃষ্ণের সন্তষ্টি বিধান করবার জন্য সবকিছু আনন্দিত চিত্তে,গ্রহণ করলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির।
খবর ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। বিশ্বাসভাজন গুপ্তচরেরা, নিজের নিজের প্রভুদেরকে, পাণ্ডবদের বিবাহবার্তা জানাল। পাণ্ডবৈরুপসম্পন্না দ্রৌপদী পতিভিঃ শুভা। পাণ্ডবরা পরিণয়সূত্রে কল্যাণী দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন। সেই যে মহান পুরুষটি ধনু দিয়ে লক্ষ্য বিদ্ধ করল তিনি হলেন শত্রুবিজয়ীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধনুর্দ্ধর অর্জুন। যিনি, মদ্ররাজ শল্যকে তুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেললেন, সেই সঙ্গে ভীষণ ক্রোধে, মহীরুহ উৎপাটিত করে যুদ্ধে উপস্থিত পুরুষদের ত্রাস সৃষ্টি করলেন, তিনি ভীম। সেখানে কারও প্রতি তাঁর সম্ভ্রমবশত তাড়া ছিল না, তিনি, দৃঢ় দেহধারী শত্রু-উত্তজক ভীম। ব্রাহ্মণবেশী পাণ্ডুপুত্ররা অনুদ্ধতস্বভাব হয়ে বিরাজমান ছিলেন। এমন বৃত্তান্ত শুনে, রাজারা বিস্ময়াবিষ্ট হলেন। রাজারা জানতেন ইতিমধ্যে সপুত্র দেবী কুন্তী জতুগৃহদহনে মৃতা। তাহলে তিনি বোধ হয় পুনরায় জন্ম নিয়েছেন — এটাই ছিল তাঁদের অভিমত।পুরোচনকৃত সেই নিষ্ঠুর কাজের দরুণ ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্রের একদা ধিক্কারদাতা, স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত সেই রাজারা, দ্রৌপদী পাণ্ডবদের বরণ করেছেন, এ বিষয়টি জেনে, স্বস্থানে ফিরে গেলেন।

অতঃপর দ্রৌপদী, শ্বেতবাহন অর্জুনকে বরণ করেছেন, জেনে, দুর্যোধন, বিষণ্ণ মনে, সকল ভাই, গুরুপুত্র অশ্বত্থামা, মাতুল শকুনি ও বন্ধুবর কর্ণ ও অস্ত্রগুরু কৃপাচার্যের সঙ্গে ফিরে চললেন। তখন লজ্জিত, ভাই দুঃশাসন, ধীরে ধীরে বললেন, তিনি নিজে মনে করেন, স্বয়ংবর সভায় যিনি লক্ষ্যভেত্তা, যদি ব্রাহ্মণ না হতেন তবে তিনি দ্রৌপদীকে লাভ করতে পারতেন না। তাঁর যথাযথ স্বরূপ অর্থাৎ অর্জুনরূপ কেউ জানতেন না। দুঃশাসন বললেন, দৈবের প্রভাব অমোঘ, পৌরুষ অর্থহীন। পুরুষাকার ও মন্ত্রণাকে ধিক্কার দিই, যেতেতু পাণ্ডবরা এখনও জীবিত রয়েছেন। দৈবঞ্চ পরমং মন্যে পৌরুষঞ্চাপ্যনর্থকম্। ধিগস্তু পৌরুষং মন্ত্রং যদ্ধরন্তীহ পাণ্ডবাঃ।। এমন পরস্পর আলাপরত, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধবাদী, কৌরবরা,পুরোচনের নিন্দা করতে লাগলেন। তাঁরা, জেনেছেন, অগ্নিদহনমুক্ত মহাতেজস্বী পৃথাপুত্ররা দ্রুপদরাজের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়েছেন। তাঁরা, আরও ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী এবং সর্বযুদ্ধে পারদর্শী অন্যান্য দ্রুপদপুত্রদের বিষয়ে মনে মনে পর্যালোচনা করলেন। নিজেদের সব পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে, দুর্যোধন প্রভৃতি কুরুমুখ্যরা ম্লান মুখে, উদ্বিগ্ন চিত্তে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯o: পিতামাতার অনৈতিক আচরণ কি সন্তানের সমালোচনার ঊর্দ্ধে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ

দ্রৌপদীকে পাণ্ডবরা বরণ করেছেন—শুনে এবং সেই কারণে লজ্জিত ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের গর্ব চূর্ণ হয়েছে, জেনে, সন্তুষ্ট মনে, আশ্চর্যান্বিত ক্ষত্তা বিদুর, কুলপতি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, দিষ্ট্যা কুরবো বর্দ্ধন্ত ইতি সৌভাগ্যক্রমে কৌরবদের অভ্যুদয় বর্ধিত হয়েছে। বিদুরের কথা শুনে বিচিত্রবীর্য্যপুত্র ধৃতরাষ্ট্র পরম প্রীত হয়ে বলে উঠলেন, কি সৌভাগ্য, কি সৌভাগ্য দিষ্ট্যা দিষ্ট্যেতি। জ্ঞানচক্ষুর অন্ধত্বহেতু, রাজা, দুর্যোধনবিষয়ে অজ্ঞতার দরুণ, মনে করলেন, দ্রৌপদী, বুঝি, জ্যেষ্ঠ দুর্যোধনকে বরণ করেছেন। তিনি দুর্যোধনকে আদেশ দিলেন, বহু ভূষণে সজ্জিতা কৃষ্ণা কে আনা হোক। আনীয়তাং বৈ কৃষ্ণেতি। অতঃপর বিদুর জানালেন, দ্রৌপদী, পাণ্ডবদের বরণ করেছেন। দ্রুপদরাজ বীর পাণ্ডুদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছেন। তাঁরা সকলে কুশলে আছেন। সেই স্বয়ংবর সভায় তাঁদের সঙ্গে বলগৌরবে সম্পর্কিত সমবেত বহু জন, পাণ্ডবদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

ধৃতরাষ্ট্র প্রত্যুত্তর দিলেন, পুত্ররা পাণ্ডুর কাছে যেমন আদরণীয় ছিল ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বোধ হয় তার থেকেও বেশি আদরের পাত্র। তাঁর কারণ, ধৃতরাষ্ট্রের মতে, পাণ্ডবরা এখন সবান্ধব, তাঁরা নিপুণ বীর, তাঁদের সঙ্গে বহু মহাবলীদের আত্মীয়তা হয়েছে। আর রাজা দ্রুপদ? সবান্ধব দ্রুপদরাজকে বন্ধুরূপে লাভ করে কোন হতশ্রী রাজা না ধনলাভের আশায়, প্রার্থী হতে চায়? কো হি দ্রুপদমাসাদ্য মিত্রং ক্ষত্তঃ! সবান্ধবম্। ন বুভূষেদ্ভবেনার্থী গতশ্রীরপি পার্থিবঃ।। ধৃতরাষ্ট্রের এমন কথা শুনে, বিদুর বললেন, নিত্যং ভবতু তে বুদ্ধিরেষা রাজন্! শতং সমাঃ। হে রাজন, শত বৎসর যাবৎ, সতত আপনার এমনই মতি হোক।বিদুর প্রস্থান করলেন।তখন দুর্যোধন ও রাধেয় কর্ণ, ধৃতরাষ্ট্রের কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁদের দুজনের বক্তব্য—তাঁরা, বিদুরের উপস্থিতিতে, ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দোষের কথা বলতে পারেননি। এখন জনান্তিকে তাঁরা দুজনে জানতে চাইছেন, বিবিক্তমিতি বক্ষ্যাবঃ কিং তবেদং চিকীর্ষিতম্। এখন আপনার এটাই কী অভীপ্সিত? পিতার কী শত্রুবৃদ্ধিই লক্ষ্য? এতেই কী সমৃদ্ধি? কারণ পিতা, বিদুরের কাছে, পাণ্ডবদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। কর্তব্যের অন্যথা করছেন পিতা। শত্রুদের শক্তি বিনষ্ট করা এখন আশু কর্তব্য।এখন আমাদের কর্তব্যবিষয়ে মন্ত্রণার আদর্শ সময়, যাতে শত্রুরা আমাদের পুত্র, বল, বান্ধবদের গ্রাস করতে না পারে। তে বয়ং প্রাপ্তকালস্য চিকীর্ষাং মন্ত্রয়ামহে। যথা নো ন গ্রসেয়ুস্তে সপুত্রবলবান্ধবান্।।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯১: নুনিয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।তিনি শুধু বিদুরের কাছে তাঁর নিজের কর্তব্য বিষয়টি গোপন রেখেছেন। তিনি বিদুরের কাছে পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করেছেন, বিদুরকে তাঁর নিজের অভিপ্রায় বুঝতে দেননি। দুর্যোধন, যেটি উচিত কর্তব্য মনে করেন সেটি বলুন,কর্ণ যা সময়োচিত বক্তব্য মনে করেন, সেই সম্বন্ধে অবহিত করুন। যচ্চ ত্বং মন্যসে প্রাপ্তং তদ্ ব্রবীহি সুযোধন! রাধেয়! মন্যসে যচ্চ প্রাপ্তকালং বদাশু মে।। দুর্যোধন স্থির করলেন,তিনি সৎকর্মের জন্য প্রশংসিত, বিশ্বস্ত, ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে কুন্তীপুত্র ও মাদ্রীপুত্রদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবেন।বিকল্প প্রস্তাব হল — সমন্ত্রী দ্রুপদ রাজাকে প্রভূত ধন উপহার দিয়ে প্রলুব্ধ করা যাক। যাঁর ফলে দ্রুপদরাজ কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরকে পরিত্যাগ করেন কিংবা সেই ব্যবস্থাই করেন যাতে পাঞ্চালদেশেই পাণ্ডবদের বসবাসের ইচ্ছা জন্মায়।

পাণ্ডবদের প্রত্যেককে, পৃথকভাবে, এই কুরুদেশে বসবাসের ফলে যে ক্ষতি হবে সেগুলি বর্ণনা করা হোক। যাঁর ফলে পাণ্ডবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়, তাঁরা সেখানেই বসবাসে মনোনিবেশ করেন। অথবা বাক্-পটু, উপায় উদ্ভাবনবিষয়ে নিপুণ ব্যক্তি, যেন, পাণ্ডবদের পারস্পরিক ভালবাসাতে ভেদ সৃষ্টি করেন। কিংবা, কৃষ্ণাকে স্বামীদের প্রতি বিরক্ত করে তোলা হোক,বহু স্বামীত্বের দরুণ এটাই সহজসাধ্য। বিপরীতভাবে দ্রৌপদীর প্রতি পাণ্ডবদের যেন বিদ্বেষ জন্মায়। উপায়োদ্ভাবনকাজে দক্ষ ব্যক্তিরা যেন গুপ্ত থেকে ভীমসেনের মৃত্যুর ব্যবস্থা করেন। কারণ পাণ্ডবদের মধ্যে শক্তির আধিক্যহেতু তিনিই মধ্যমণি। ভীমকে অবলম্বন করে, কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির, ইতিপূর্বে দুর্যোধনকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। কারণ ভীমসেন, রুক্ষতায় শাণিত, বীর ও পাণ্ডবদের একান্তভাবে নির্ভরযোগ্য পাত্র। ভীম নিহত হলে,হতোদ্যম পাণ্ডবরা, তেজোহীন হয়ে পড়বেন। প্রধান আশ্রয় হারিয়ে, তাঁদের আর রাজ্যলাভের চেষ্টাই থাকবে না। যুদ্ধে পৃষ্ঠবল,বৃকোদর ভীমের অভাবহেতু, অর্জুন কর্ণের এক চতুর্থাংশের সমানও নয়। ভীমসেনহীন দুর্বল পাণ্ডবরা নিজেদের গভীর বলহীনতা সম্বন্ধে অবহিত হয়ে এবং দুর্যোধনদের অধিক শক্তিমান জেনে নিশ্চেষ্ট থাকবেন। দুর্যোধনের অনুমান হল,এই দেশে এসে আমাদের আজ্ঞাবহ হলে, তাঁদের যথারীতি নিগ্রহ করতে প্রবৃত্ত হবে আমরা। ইহাগতেষু বা তেষু নিদেশবশবর্ত্তিষু। প্রবর্ত্তিষ্যামহে রাজন্! যথাশাস্ত্রং নিবর্হণে।।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

আর একটি বিকল্প প্রস্তাব হল,প্রিয়দর্শিনী সুন্দরী মহিলারা যেন পাণ্ডবদের লোভাতুর করে তোলে, এ ভাবে একে একে পাণ্ডবদের দ্রৌপদীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেতে পারে।তাই রাধেয় কর্ণকে যেন পাণ্ডবদের এখানে আনয়নের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের এখানে এনে, বিশ্বাসভাজনরা সেই সেই উদ্ভাবিত উপায়ের সাহায্যে তাঁদের নিকেশ করুন। ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি দুর্যোধনের অনুরোধ, এই উপায়গুলির মধ্যে যেটি ,আপনার পক্ষে নির্দোষ বলে মনে হয় সেটি প্রয়োগ করুন। সম্মুখে সময় যে অতিক্রান্তপ্রায়। এতেষামপ্যুপায়ানাং যস্তে নির্দ্দোষ আত্মনঃ।তস্য প্রয়োগমাতিষ্ঠ পুরা কালোঽতিবর্ত্ততে।। যত দিন পর্যন্ত দ্রুপদরাজ, পাণ্ডবদের বিশ্বাসভাজন না হন তত দিন তাঁদের হেনস্থা করা যেতে পারে, এর পরে কিন্তু আর নয়।এভাবেই পাণ্ডবদের নিগ্রহ করা সম্ভব, এটাই দুর্যোধনের অভিমত। এ বার এটা সম্ভব না অসম্ভব? এ বিষয়ে রাধেয় কী মনে করেন?— দুর্যোধন কর্ণের কাছে জানতে চাইলেন।

দ্রুপদকন্যার সঙ্গে পাণ্ডবদের বিবাহ সম্পন্ন হল। শাশুড়ি মা স্নেহভরে আশীর্বাদ করলেন পুত্রবধূকে, একজন সাধ্বী স্ত্রী-রূপে দ্রৌপদী যেন পতিদের প্রিয়া ভার্যা হয়ে ওঠেন। কেমন সেই পুত্রবধূ? রূপলক্ষণসম্পন্নাং শীলাচারসমন্বিতাম্। দ্রৌপদী ভবাদ্যঃ প্রেম্ণা পৃথাশীর্বচনং স্নুষাম্। রূপবতী, গুণবতী, সচ্চরিত্রা, সদাচারে অভ্যস্তা এমন কন্যা হয়তো প্রত্যেক ভারতীয়, পুত্রবতী শাশুড়ি মায়ের কাঙ্খিতা বধূ। দেবী কুন্তী, বিখ্যাত দেবদেবী বা দূরবর্তী অপার্থিব লোকের স্বামীস্ত্রীর সার্থক দাম্পত্য প্রেমের দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। মহাভারতের কাঠামোটি কল্পলোকের বা দৈব আধারের, যেখানে লৌকিক মানব সম্পর্কের রূপারোপ করেছেন মহর্ষি বেদব্যাস। শাশুড়ির আশীর্বাদে ছিল, দ্রৌপদী যেন প্রাত্যহিক জীবনের ভোগ্য সুখ লাভ করেন। তিনি পতিব্রতা,স্বামীর সহযোগিনী,সেবাপরায়ণা, প্রধানা মহিষীর পদে অভিষিক্তা ও দানশীলা হয়ে উত্তম ধনাধিকার, দীর্ঘজীবন লাভ করেন। সর্বোপরি দ্রৌপদী, দীর্ঘজীবী বীর পুত্রের জননীরূপে সৌভাগ্যবতী হন। এ সব কিছুই পার্থিব চাওয়া পাওয়ার হিসেবের ছকে বাঁধা আশীর্বাদ। কিন্তু বিবাহের সিলমোহর পাওয়া,একাধিক পতির সঙ্গে সহবাসের ফলে, প্রাত্যহিক দাম্পত্য প্রেম টেকসই হবে কি না, এ সন্দেহ হয়তো ছিল, সেই কারণেই কী প্রথমে দাম্পত্যের সাফল্য কামনা করেছেন দেবী কুন্তী? দাম্পত্যের সাফল্যের দায়ভার চিরকালই ভারতীয় নারীদেরই বহন করতে হয় যে।

এই বিবাহ আনন্দের,তাই প্রথমেই স্বাগত অভিনন্দন জানালেন মধুসূদন মাধব কৃষ্ণ। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজবৃন্দ, গুপ্তচরের মাধ্যমে জানলেন, ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে লক্ষ্যভেদকারী এবং যুদ্ধে তাঁর সহায়ক অসাধারণ দক্ষ যোদ্ধা, এনারা দু’ জন আর কেউ নন,স্বয়ং অর্জুন ও ভীম। তখন তাঁরা বিস্ময়াবিষ্ট হলেন। পাণ্ডবদের জতুগৃহে দহনবৃত্তান্ত স্মরণ করে, ধিক্কার দিতে লাগলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। কৌরবদের পিতামহ ভীষ্মও এই নিন্দা থেকে রেহাই পেলেন না। নিন্দনীয় প্রাণঘাতী দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, তাঁরা এবং তাঁদের পরিমণ্ডলের সকলেই নিন্দার পাত্র। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বিখ্যাত অখ্যাত সকলেই জীবনহানিকর দুষ্কর্মের বোঝা বয়ে বেড়ান জীবনভর।মহাকাব্যে তার প্রতিফলন, যুগে যুগে মানুষের মনে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৫: টাকা না থাকলে নির্ধন ব্যক্তির বন্ধুও শত্রু হয়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা

দুর্বৃত্তরা কিন্তু অপরিবর্তনীয় মানসিকতা নিয়ে বেঁচে থাকেন চিরকাল, তাঁরা পুরুষকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন, অবশেষে দৈবের দোহাই দিয়ে পরাজয়কে ভবিতব্য বলে মেনে নেন, যেমন ভেবেছেন দুঃশাসন। সহায়সম্পদহীন হয়েও পাণ্ডবরা জীবিত, অগ্নিদহনেও অপ্রতিরোধ্য তাঁদের জয়যাত্রা, এখন তাঁদের পৃষ্ঠবল হয়েছেন দ্রুপদরাজশক্তি এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, যুদ্ধবিশারদ দ্রুপদপুত্ররা—এই ঘোর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে, আশঙ্কিত, ভীত, হতোদ্যম হয়েছেন পারিপার্শ্বিকসহ দুর্যোধন। শত্রুকে নিরাপত্তার বেষ্টনীতে দেখতে কে পছন্দ করেন? দুর্যোধনের পিতার নিজ পুত্র দুর্যোধনের সঙ্গে দ্রৌপদীর পরিণয় অভীপ্সিত ছিল। তিনি অন্ধ, তাঁর জ্ঞানদৃষ্টিও রুদ্ধ, তাই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতি অগাধ আস্থা রেখে মনে করেছেন, মন্যতে স বৃতং পুত্রং জ্যেষ্ঠং দ্রুপদকন্যয়া।দ্রুপদকন্যা বোধ হয় সেই জ্যেষ্ঠকেই বরণ করেছেন। পাণ্ডবদের বিবাহ ও সেই সূত্রে বলবৃদ্ধির হৃদয়বিদারক সংবাদ শুনে ছদ্ম আনন্দের ভাণ করেছেন, যথৈব পাণ্ডোঃ পুত্রাস্তে তথৈবাভ্যধিকা মম।

পাণ্ডবরা যত না পাণ্ডুর পুত্র,আমার কাছে কিন্তু তার থেকেও অধিক(গুরুত্বপূর্ণ)। সহায় সম্বলহীন পাণ্ডবরা, সবান্ধব দ্রুপদরাজকে পৃষ্ঠপোষকরূপে পেয়েছেন, তাই তাঁরা দ্রুপদরাজের কাছে ভাগ্যবান প্রার্থী। ভাই বিদুর, ধৃতরাষ্ট্রের মুখে, এই ছদ্ম স্বীকারোক্তি শুনে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুভ চিন্তা সজ্জনমাত্রই গ্রহণ করে থাকেন। বিদুর তার অন্যতম উদাহরণ।এসবই কিন্ত ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা। সপত্নবৃদ্ধিং যত্তাত! মন্যসে বৃদ্ধিমাত্মনঃ।

শত্রুর সমৃদ্ধি, নিজের অভ্যুদয় মনে করছেন? পুত্রের এই ভর্ৎসনার প্রত্যুত্তরে তিনি ছদ্ম ঔদার্যের আবরণ ভেদ করে স্বরূপ প্রকাশ করেছেন। “স্নেহ অতি বিষম বস্তু” প্রমাণ করলেন মাননীয় ধৃতরাষ্ট্র। একজন রাজপদে আসীন, বিখ্যাত বংশের ধারক ও বাহক, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কী ইতিবাচক বার্তা রেখে গেলেন?তিনি চতুর প্রতারকের মতো পুত্রের কাছে স্বীকার করলেন, ততস্তেষাং গুণানেব কীর্ত্তয়ামি বিশেষতঃ। নাববুধ্যেত বিদুরো মমাভিপ্রায়মিঙ্গিতৈঃ।।

আমি বিশেষভাবে পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করেছি। যাতে বিদুর আমার মনোগত অভিপ্রায়, প্রকাশভঙ্গী দেখে বুঝতে না পারে। তিনি, দুর্যোধন-উদ্ভাবিত পাণ্ডবনিধনের বিভিন্ন পরিকল্পনা, সঙ্গত মনে করে, শুনেছেন অর্থাৎ প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন।একজন বিখ্যাত পিতা সন্তানকৃত দুষ্কর্মের পরিকল্পনাগুলিতে যখন সায় দেন, তার কুপ্রভাব যে সুদূরপ্রসারী ও আত্মঘাতী হতে পারে,এ চিন্তা তাঁর মনে স্থান পায়নি। এ যুগের পিতারা, ধৃতরাষ্ট্রকে মনে রাখবেন, পুত্রের অন্যায়কাজের প্রশ্রয়দাতারূপে, না, তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাভরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবেন, সময় তা বলে দেবে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content