বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


চিত্র সৌজন্যে: সত্রাগ্নি।

মাইতিবাবুদের সংসারে আরও এক সদস্য একটি ছোট্ট কুকুরছানা। তার নাম নিনজা। এমন ফুটফুটে লোমওয়ালা পমেরিয়ান যার মধ্যে যুদ্ধের লেশমাত্র নেই। মেয়ে তার নাম দিয়েছিল নিনজা। নিনজা হলো জাপানের সেই যোদ্ধা যারা জাপানি মার্শাল আর্ট নিঞ্জুৎসু জানে। যাইহোক সেই থেকে নিনজা এ বাড়িতে একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এ বাড়ির যারা ব্যাঙ্গালোর বা বম্বের থানেতে থাকে তাদের সকলকে নিনজা চেনে। তাদের দেখলে সে খুশিতে ডগমগ। চলে যাবার পর দুতিনদিন একটু খোঁজে আবার আগের মতোই রোজকার জীবনে মানিয়ে নেয়।
এই নিনজাকে একা রেখে কোথায় বেশিক্ষণের জন্যে যাওয়া যায় না। মাইতিবাবুদের না দেখলে সে খাবার না খেয়ে চুপ করে মুখগুঁজে বসে থাকে। তবে অনেকের অসভ্য পোষ্যের মতো নিনজা চিৎকার করে না। খুব অপছন্দ হলে ক্বচিৎ কখনও এক-দুবার চাপা ভৌ শব্দে উষ্মা প্রকাশ করে। ছেলে বলে পোষ্যকেও ছোট্ট শিশুর মতো ম্যানারস শেখানো যায় – বিদেশে লোকজন পোষ্য নিয়ে ট্রেনে বাসে ঘোরেন এমন কি বেড়াতে গিয়েও সঙ্গে নিয়ে যান। এখানে তো তেমন চল নেই তাই কোথাও যেতে হলে ছেলের এক বন্ধুর গলফগ্রীনের বড়সড় বাড়িতে নিনজাকে রেখে যেতে হয়। তাঁরা অবশ্য নিনজার যথেষ্ট যত্নআত্তি করেন। তাদের কোন কুকুর নেই বাড়ি বোঝাই পাখি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ

পোষ্যের মায়া সাংঘাতিক তাই সারাটা দিনের মধ্যে অনেকটা সময় জুড়ে থাকে নিনজার যত্নআত্তি। তাকে চান করানো খাওয়ানো, থাকার জায়গা পরিষ্কার করে দেওয়া। বছরের সারাটা সময় নিনজা খুব ফুর্তিতে থাকে। কিন্তু কালীপুজোয় শব্দদৌরাত্ম্যে সে যেন পাগল হয়ে যায়। জানলা বন্ধ করে, জানলার ভেতরের গ্রিলে মোটা মোটা তোয়ালে চাপা দিয়েও শব্দ আটকানো যায় না। এখন আর কালীপুজোর তো একটা রাত নয়। বাঙালিরা এখন প্রায় সপ্তাহব্যাপী দীপাবলি পালন করেন। সঙ্গে চলে শব্দদৌরাত্ম্য। মাঝে মাঝে মাইতিবাবুর মনে হয় ক’টা দিন কলকাতা ছেড়ে নিনজাকে নিয়ে তাঁরা দূরে কোথাও গিয়ে থাকবেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ভয়ও বেড়েছে। একা একা যাবেন, কোন একটা অসুবিধে হলে স্ত্রীকে নিয়ে নিনজাকে নিয়ে মুশকিলে পড়ে যাবেন মাইতিবাবু। যাওয়া আর হয় না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

শব্দবাজির কম্পাঙ্ক কমানোর জন্য আইনকানুন আলোচনা সবই হচ্ছে কিন্তু আখেরে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। কানফাটানো শব্দের কোন বিরাম নেই। আর পাড়ার ভেতরে এতো কড়া আইনকানুন বলে কিছু নেই। মানা করতে গেলে বেশিরভাগ লোকই নাক কান চুলকে বলবেন—
—কালী পুজোর সময় বাজি পুড়বে না? এ কি হয় নাকি মশাই? কানে তুলে দিয়ে রাখুন, জোরসে মিউজিক চালিয়ে দিন।

এই কটা দিন মাইতিবাবুর মেজাজ চড়ে থাকে। এক-দুবার বারণ করতে গিয়ে কোন লাভ হয়নি। অসভ্য ছেলেগুলো কোন কথা কানে নেয়নি উল্টে আরও বেশি করে বাড়ির চারপাশে শব্দবাজি পুড়িয়েছে। আশপাশে কয়েকটা পাঁচ ছ’ তলা ফ্ল্যাটবাড়িও আছে। তার ছাদে বাজি পোড়ালে অত সমস্যা হয় না, কিন্তু একেবারে বাড়ির সামনে বারান্দায় রাস্তার ওপরে ক্রমাগত ভয়ংকর শব্দ। এবার উল্টে আরও জোর ফলিয়ে গেলো ছেলেগুলো।
—কাকু, কালীপুজোর কটা দিন আপনারা তো আর বেরোন না। দজ্জাজানলা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন। তাই থাকুন। আমরা গিলবারান্দায় বাজির স্টকটা রাখব।
—কি মুশকিল – আমি কি রাতে গ্রিল বারান্দার দরজা খোলা রাখবো
নাকি?
—দরজা বন্ধ রাখুন নো পবলেম, নিচে দিয়ে মাল সাঁটিয়ে দেব।
আজকাল বাংলাভাষায় বহু ক্ষেত্রে র-ফলা বা ঋ-কার মাইতিবাবুর মতোই অবসর নিয়েছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশেষ শব্দবন্ধ – যা রাস্তাঘাটে বাজারে অটোতে শোনা যায় – যেগুলো ক্ষমাঘেন্না করে ওরা আর বললো না!
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

মাইতিবাবু একটু চুপ করে ভাবেন। ছেলেবৌমা বা মেয়েজামাই চারজনেই অবিরত ফোনে পইপই করে মানা করে দিয়েছে।
—দিনকাল ভালো নয়- তোমরা দুজনে একা থাকো। কোনওরকম প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার কথা ভেবো না খুব বাড়াবাড়ি না করলে যা বলছে মেনে নিও।

অগত্যা মেনে নিলেন। মৃদুকণ্ঠে বলেছিলেন—
—বাড়ির একেবারে সামনেটায় বোমটোম ফাটিও না। আমাদের তো
অসুবিধে হয়ই। নিনজা বড্ড ছটফট করে।
—আপনার নাতি?
—না, ওরা তো পূজোয় এসেছিল, ফিরে গেছে। নিনজা আমাদের ছোট্ট পেট পমেরিয়ান!
—কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন! কুত্তার আবার সাউন পল্যুশান! হ্যা হ্যা, হ্যা।
এদের ইংরিজি বাংলা কোনও কথাই শুদ্ধ নয়! না হবার যথেষ্ঠ কারণ আছে। কিন্তু ‘কুত্তা’ শব্দটা শোনামাত্র মাথায় যেন শক্ লেগে গেল। নিনজাকে নিয়ে মস্করা করার অধিকার কে দিয়েছে?

সন্ধ্যেবেলা ডিউটি রোস্টার মেনে পাম্পের সুইচ অন করে দিয়েছিলেন মাইতিবাবু। তারপর টিভিতে কালীদর্শন দেখছিলেন মন দিয়ে।

খানিক পরে হঠাৎ একটানা কলিংবেলের শব্দ গ্রীলে ঠংঠংঠং শব্দ শুনে দরজা খুললেন। বাইরে সেই ধমক দেওয়া ছেলেগুলো হাঁহাঁ করে চেঁচাচ্ছে।
—কী হয়েছে?
—কী হয়েছে? আমাদের সব বাজি আপনি নষ্ট করে দিয়েছেন?
—আমি?
—হ্যাঁ লাইটটা জ্বালুন!

আলো জ্বালিয়ে দেখা গেল। টবে লাগানো জলের পাইপ টব থেকে খুলে গিয়ে মেঝেতে অবিরাম জল ঢেলে যাচ্ছে আর সেই থই থই জলে সমাজের কারগিল যুদ্ধ জয় করবার সামরিক সম্ভার ছোট বড় মেজ বোমেরা জলে ভিজে রসেপড়া লেডিকেনির মতো চুপচুপ করছে।
মাইতিবাবু আঁতকে উঠলেন—
—ছি ছি ছি ছি! পাম্প বন্ধ করো পাম্প বন্ধ করো।
—আপনি বাইরে বেরিয়ে আসুন, যা বাজি নষ্ট হয়েছে তার পুরো টাকাটা আপনাকে দিতে হবে!
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

ছেলেগুলো চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজড়ো করে ফেলে প্রায় সকলের সামনে হুমকি দিতে দিতে মাইতি বাবুকে প্রায় টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল ওরা। মাইতিবাবুর স্ত্রী আতঙ্কে ছেলেগুলোর কাছে মিনতি করতে লাগলেন। কিন্তু তারা তখন বাজি হারানোর প্রতিহিংসায় উন্মত্ত।
কিন্তু আচমকা সব ওলটপালট হয়ে গেল।

সকলকে অবাক করে কলকাতা পুলিশের একটা ঝকমকে আলো লাগানো জিপ এসে দাঁড়ালো মাইতিবাবুর বাড়ির ঠিক সামনেটায়। দূর থেকে গলিতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে দেখেই ছেলেগুলো মুহূর্তের মধ্যে ভোল বদলে ফেলেছে। গাড়ি থেকে নামলেন একজন বিবাহিতা মহিলা অন্য দিক থেকে সুঠাম চেহারার একজন উচ্চপদস্থ পুলিশকর্মী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মহিলা এসে মাইতিবাবুকে প্রণাম করে বলল।
—আমায় চিনতে পারছেন কাকাবাবু?
— তোমাকে মানে আমি ঠিক
মাইতি বাবুর স্ত্রী এসে মহিলাকে বললেন
—সুমনা না?

পরের পর্বটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সুমনা পানিহাটিতে থাকতো। মাইতিবাবুর মেয়ের কলেজের বন্ধু। পুজোর সময় কয়েকবার একসঙ্গে কলকাতা ঠাকুর দেখতে এসে এই বাড়িতেই থেকেছে। মাঝে অনেকদিন যোগাযোগ নেই। সুমনার বর রাতুল সিনহা, অনেকদিন দক্ষিণ ২৪ পরগনায় কাটিয়ে সবে প্রমোশন পেয়ে কলকাতায় ফিরেছেন। সাউথ ওয়েস্ট ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। হরিদেবপুর থানা তাদের আওতায় পড়ে। সুমনা করুণাময়ী কালীবাড়িতে পুজো দিতে এসেছিল। তাই খুঁজে খুঁজে কাকু-কাকিমার সঙ্গে দেখা করে বিজয়া করতে এসেছে। ব্যস! ওই এক থ্রেটেই এতদিনের কালচার বদলে গেল। এরপর আর কালীপুজোতে মাইতিবাবুদের বা নিনজার কখনও কোন অসুবিধা হয়নি। তবে সেদিন গ্রিলবারান্দার টব থেকে জলের পাইপ আপনাআপনি কি করে খুলে গিয়েছিল সে কথা মাইতিবাবুর কাছে কেউ জানতেও চাননি আর মাইতি বাবুও কাউকে বলেননি। — শেষ।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content