বুধবার ১৩ নভেম্বর, ২০২৪


 

স্ক্রিনলাইফ থ্রিলার

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: স্ক্রিনলাইফ থ্রিলার (২০২৪)
ভাষা: হিন্দি
প্রযোজনা: নিখিল দ্বিবেদী, আরিয়া মেনন
কাহিনি চিত্রনাট্য: বিক্রমাদিত্য মোতোয়ানে
সংলাপ: সুমুখী সুরেশ
নির্দেশনা: বিক্রমাদিত্য মোতোয়ানে
অভিনয়ে: অনন্যা পাণ্ডে, ভিহান সমত প্রমুখ
সময়সীমা: ৯৯ মিনিট
রেটিং: ৫.৫/১০
ওটিটি: নেটফ্লিক্স

আজকের প্রতিবেদনের কাহিনি বৈশিষ্ঠ্য আর একবার খেয়াল করলে দেখবেন আজ একটি নতুন ধরণ বা জনারের উল্লেখ করা হয়েছে। স্ক্রিনলাইফ থ্রিলার। স্ক্রিনলাইফ হল মোবাইল, কম্পিউটার বা ট্যাবলেটনির্ভর আমাদের আধুনিক দিনযাপন। আর ‘CRTL’ শব্দটি আধুনিক কর্মজীবনে অত্যন্ত পরিচিত। আর এই সংক্ষিপ্ত শব্দটির অর্থ হল কন্ট্রোল যা কম্পিউটার কিবোর্ড-এর একটি বহুল প্রচলিত ফাংশন। দৈনন্দিন জীবনে ক্রমাগত আধুনিকতায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। সমাজমাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করার প্রচার করার তাগিদ আজ মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কিভাবে আরও বেশি মানুষ আমাকে দেখবে আমাকে জানবে সমাজমাধ্যমে আমাকে ফলো বা অনুসরণ করবে সেটা এখন একটা বিশেষ ভাবনার বিষয়। একটা সময় মানুষ ব্যক্তিগত জীবনযাপন করতে পছন্দ করতো। নিজেকে নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে রেখে সুখে থাকতো। আজ ঠিক তার উল্টো। মানুষ নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে সমাজমাধ্যমে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। আমাকে কেউ নজর করুক, অবিরত আমাকে অনুসরণ করুক একসময় এটা ঘোর অপছন্দের ছিল। আজ সেটাই পছন্দের। বিশেষ পছন্দের।
আজ অভিনেতা অভিনেত্রীদের জনপ্রিয়তা মাপতে তাঁদের ফলোয়ারের সংখ্যাতত্ত্ব হিসেবে করা হয়। মনে করা হয় সমাজমাধ্যমে সেই অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে যত মানুষ দেখতে চাইছেন তত মানুষই তার ছবি দেখতে যাবেন। অথচ বারবার এই হিসেব ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ। ফোর্বস ইন্ডিয়া প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২০২৪-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এই অভিনেত্রীর সোশ্যাল মিডিয়া ফলোয়ার্সের সংখ্যা ৭ কোটি ১১ লক্ষ। অথচ অভিনেত্রীর শেষ হিট ছবির নাম ওয়েলকাম থ্রি। ছবি মুক্তি পেয়েছিল আট বছর আগে ২০১৬ সালে। তারপর ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সার্কাস ছবিটি পর্যন্ত তাঁর ঝুলিতে একটিও হিট ছবি নেই।

এরপর উর্বশী রৌতেলা। সমাজমাধ্যমে তাকে অনুসরণ করেন ৭ কোটি ২৮ লক্ষ মানুষ। অথচ ২০১৩ থেকে ২০২৪ এই ১২ বছরে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যাই হল মাত্র ছটি। হিট ছবির সংখ্যা শূন্য। সম্ভবত এই ভ্রান্তি সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন পোর্টাল থেকেই সুকৌশলে সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক কারণে প্রচার করা হয়ে থাকে। মানুষ মদ খায় না মদ মানুষকে খায়। ঠিক তেমনি মানুষ সমাজমাধ্যম ব্যবহার করেন না সমাজমাধ্যমই মানুষকে ব্যবহার করে। নিয়ন্ত্রণ করে। তার পছন্দ অপছন্দ ভাবনাচিন্তা এমনকি সিদ্ধান্ত, সবার অলক্ষ্যে অনুসৃত এবং অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হয়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৮: পালাবার কোনও পথ নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন

এই অজানা অচেনা অদেখা নিঃশব্দ নিয়ন্ত্রণই হল CRTL বা কন্ট্রোল ছবিটির বিষয়বস্ত। বিষয় এবং পরিবেশনার দিক থেকে কন্ট্রোল অত্যন্ত আধুনিক ছবি। কিন্তু যাঁরা মানবিক সম্পর্কের ছবি দেখতে অভ্যস্ত এবং পছন্দ করেন তাদের এই ছবির প্রথম প্রায় ৩০ মিনিট একেবারেই ভালো লাগবে না। এই ৩০ মিনিট ধরে আমাদের গ্যাজেট নির্ভর স্ক্রিন জীবনকে পর্দায় দেখানো হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে বিষয় অনুযায়ী এই দৃশ্যভাবনা অবশ্য প্রয়োজনীয় কিন্তু এটির দৈর্ঘ্য আরও অনেকটা সংক্ষিপ্ত হতে পারতো।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?

ছবিতে এক প্রেমিক দম্পতি সমাজমাধ্যমের জন্য নানান কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভিডিও তৈরি করেন। এবং সেইসব ভিডিও ভয়ংকর ভাবে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। সমাজমাধ্যমের এই জনপ্রিয়তার নিরিখে আর্থিক রোজগার হয় এটা আজ শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের সকলেই জানেন। আর এই সহজলভ্য অর্থের তাগিদে মানুষ ক্রমশ যন্ত্র থেকে অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। রিল বা শর্ট ভিডিও’র বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক না অপ্রাসঙ্গিক, সভ্য না অসভ্য, অর্থবহ না নিছক নিরর্থক সময়ের অপব্যবহার এসব না ভেবেই একই ধরনের অসংখ্য ভিডিও সমাজমাধ্যমে চলতে থাকে। তার মধ্যে কয়েকটি বেশি সংখ্যায় দেখা হলে তাকে ভাইরাল আখ্যা দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

একবার অর্থের যোগান শুরু হলে অর্থ রোজগার করাটা নেশা হয়ে যায়। ঠিক যেমন এই ছবির নায়িকার ক্ষেত্রে হয়েছিল। সে তার ব্যক্তিগত জীবনের নিভৃত মুহূর্তটুকুও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে বেপরোয়া। এ ভাবেই সে তার প্রেমিকের থেকে আঘাত পেয়ে ভেঙে পড়ে এবং সিদ্ধান্ত নেয় তার জীবন থেকে প্রেমিককে এবং প্রেমিকের সমস্ত ডিজিটাল উপস্থিতি সে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। মানে যত ভিডিও যত স্টিল ছবি যত হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টাগ্রাম চ্যাট বা যত ইমেইল আদান-প্রদান। সব কিছু থেকে তার প্রেমিকের অস্তিত্ব গায়েব হয়ে যাবে। এমনকি যেসব ছবিতে তার প্রেমিক তার ঘনিষ্ঠ হয়ে ধরা রয়েছে সেখান থেকে প্রেমিকের ছবিটুকু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এজন্য আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ন্ত্রিত এক বিশেষ সফটওয়্যার তাকে সাহায্য করতে থাকে। বিষয় অনুযায়ী পরিচালনা ক্যামেরা ও এডিটিং প্রয়োজন মেটালেও ছবির গান মনে দাগ কাটে না।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

এই ছবিটি দেখতে বসলে মাঝেমধ্যে আতঙ্ক হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর এই দুনিয়ায় আমি বা আপনি একজন মানুষ হিসেবে ঠিক কতটা নিরাপদ? আপনার চেহারা বা আপনার কণ্ঠস্বরের নিখুঁত ক্লোনিং করে দুনিয়ার যেকোনরকম জালিয়াতি করা সম্ভব। আপনি যেখানে উপস্থিত নেই সেখানে আপনার উপস্থিতি রাখা সম্ভব, যেখানে আপনি ছিলেন সেই প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব। ডিজিটালি আপনাকে মুহূর্তের মধ্যে কপর্দকশূন্য করে দেওয়া সম্ভব। আপনি যে ধরনের ভিডিও দেখেন যে ধরনের গান শোনেন যে ধরনের খবর পড়তে ভালোবাসেন, সেই সব আপনার অজান্তে কোথাও না কোথাও নিয়মিত লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আপনার যত চ্যাট আপনি ডিলিট করেছেন তার সমস্ত ডিজিটাল অস্তিত্ব থেকে গিয়েছে।

আমার আপনার মতো অনেকেই স্কুলজীবনে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত ছিল। বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ। এই প্রজন্মের আগে পর্যন্ত সকলেই বিজ্ঞানকে বারংবার আশীর্বাদ বলে প্রমাণ করেছেন। অভিশাপের ক্ষেত্রে লিখেছেন পারমাণবিক বোমার আতঙ্কের কথা। আগামী প্রজন্ম লিখবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-=এর ভয়ংকর আতঙ্কের কথা। লিখবে তার অজানা অদেখা নিয়ন্ত্রণের কথা।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content