বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


 

এক নিমেষ

ম্যারি বোনাপার্টকে একবার অস্ট্রিয় মানসিক রোগ চিকিৎসক এবং মনস্তাত্ত্বিক ডাঃ সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) বলেছিলেন, “সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটির উত্তর আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, এবং নারী মন নিয়ে আমার ৩০ বছরের গবেষণার পরও যে প্রশ্নের কোনও উত্তর আমি খুঁজে পাইনি তা হল, ‘What does a woman want?’

“নারী কি চায়?” একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে পৌঁছে তৃতীয় বিশ্বের কোনও লেখিকা যিনি পেশায় মনোবিদ যখন সদর্পে ‘মন বলতে চায়’ এর ঝুলি নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হন তখন প্রত্যাশার পারদ যে চড়বেই তা আর অপ্রত্যাশিত কি! তবে কি নারীর চাওয়ার কিছু দিক উদ্ভাসিত হবে?

সঙ্গত কারণেই ‘মন বলতে চায়’ এই শিরোনামটি চোখে পড়তেই আপনার মনের কোণে ভিড় করে আসা অসংখ্য প্রশ্নেরা উঁকি-ঝুঁকি মারতে শুরু করে, চুম্বকের মতো বইটি আপনাকে আপন করে নেয়, কিংবা আপনি বইটিকে। কখন যেন আপনার অনুসন্ধানী চোঁখ দুটি বইটির পাতার পর পাতা জুড়ে খুজতে শুরু করে দেয় মনের কোণে ভিড় করে আসা সেই সব হাজারো প্রশ্নের উওর। কিন্তু বইটি পড়া শুরু করতেই শব্দের এক তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় আপনাকে কি এক অদৃশ্য জাদুবলে (পড়ুন লেখিকার গল্প বলার মুন্সিয়ানায়)। একসময় প্রশ্নগুলো ভুলে গিয়ে ডুবে যেতে থাকেন মনের অলিগলিতে। মেলাতে থাকেন অন্যের মনের সঙ্গে নিজের মনকে, কখনও কখনও অন্যের মনের কথার সঙ্গে মিলে যায় আপনার মনে জমে থাকা অনেক না বলা কথা, সুর, ঝংকার।

বইয়ের পাতার পর পাতা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শব্দ গুলো আপনার মনে শিহরন জাগায়, রোমাঞ্চিত করে, এলোমেলো করে দেয় আপনার চেনা জগৎটাকে, টলমল করে ওঠে আপনার পায়ের তলার মাটি, মাঝে মাঝে হয়তো আপনার চসমার কাচ ঝাপসাহয়ে আসে, আর নাগের ডগা বেয়ে টুপ টাপ ঝরে পড়ে রুপালি মুক্তোর বিন্দু। এক নিমেষে পুরো বইটি শেষ করে শেষ রাতে যখন আপনি বিছানায় আপনার শরীরটাকে এলিয়ে দেন, মাথা রাখেন নরম বালিসে, তখন কোনও ভাবেই আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না। গালিবের মতো আপনারও মনে হয় ‘মৈতকা একদিন মুয়াইয়ান হ্যায়, নিন্দ কিয়ুন রাত ভর না আতি।’ কেমন যেন অস্থির লাগে, কিছু মানুষের অভিজ্ঞতার কথা, নৈশব্দের মধ্যে কিছু শব্দ আপনার মস্তিস্কে ভেসে বেড়ায়। আর্তনাদ করতে থাকে।

কিছু মানুষের মনের কথা আপনাকে ভাবায়, শেখায়, আর সমাধানসূত্র খুজতে খুজতে কখন যেন ভোর হয়ে আসে। হয়তো আপনি নিজে, নিজের অজান্তেই কখন নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করে বসেন, ‘দিল-এ-নাদান তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়, আখির ইস দর্দ কি দোয়া কেয়া হ্যায়।’ সত্যিই তো এই মানসিক অস্থিরতা, এই যন্তনা উপষমের সত্যিই কি কোনও ঔষধ হয়? ‘দর্দ হো দিল মে তো দ্বা কিজিয়ে, দিল হি জব দর্দ হো তো কেয়া কিজিয়ে’। ‘মন বলতে চাই’ এর গল্পগুলি এক অস্থির সময়ের গল্প, নারী মনের হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রনার গল্প, যার সাক্ষী হয়ে, সমস্যার সমাধান খুজে না পেয়ে আপনার মন অস্থির হবেই। আর এখানেই বুঝি ‘মন বলতে চাই’ এর স্বার্থকতা।
 

দুই ‘মনের কথা’

তাহলে ‘মন বলতে চায়’ কি? ‘মন বলতে চায়’ আসলে একটি গল্প সংকলন যেটিতে মোট দশটি গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গল্পগুলি লেখিকার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও সত্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। ঘটনাগুলি বর্তমান শহুরে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের অন্যতম অসুখ মানসিক বিকার বা মানসিক অবসাদের চিত্র তুলে ধরে। এই মানসিক বিকৃতি বা অবসাদ কোনও না কোনও ভাবে নারীর জীবনের উপর প্রভাব ফেলে। ‘মন বলতে চায়’ এর প্রথম, তৃতীয়, সপ্তম ও দশম গল্পে নারীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা উঠে এসেছে। গল্পের চরিত্রগুলি আলাদা হলেও তারা কোনও না কোনওভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে।

চতুর্থ গল্পে উঠে এসেছে নারীর সন্তানহীনতার যন্ত্রণা। নারীর মাতৃত্বকালীন সংকট এবং তার পরবর্তীতে সন্তান ও মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন উঠে এসেছে পঞ্চম ও ষষ্ঠ গল্পে। একাকিত্ব জনিত অসহয়তা এবং অবসাদ উঠে আসে দ্বিতীয় ও অষ্টম গল্পে। নবম গল্পে উঠে এসেছে স্বপ্নভঙ্গের হতাশা ও অসহয়তার কথা। নারী জীবনের বহুত্ব প্রতিফলিত হয় দশটি গল্পের এই সংকলনে। অভিনবত্ব হল এখানে গল্প কথক সুমনা নিজে নন, মালা সেনগুপ্ত। ড. মালা সেনগুপ্তের লেখা ডায়েরির পাতা তুলে ধরেছেন সুমনা। হয়তো মনোবিদের পেশাদারী বাধ্যবাধকতা থেকে ড. মালা সেনগুপ্তের ছদ্মনাম তাকে গ্রহণ করতে হয়েছে!

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

 

কার মন? কাদের মন বলতে চায়?

অতি অবশ্যই শোষিত লাঞ্ছিত অবসাদগ্রস্থ নারীর মন বলতে চায়। শোষিত লাঞ্ছিত মানুষরা সব জেনেও নিরুপায় হয়ে অনেক সময় মুখ বন্ধ রাখে, কিংবা সামাজিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁদের মুখ বন্ধ রাখতে হয়। তাই এদের কথাও চাপা পড়ে যায় নিঃশব্দের অতল গভীরে। বছরের পর বছর তাঁদের মনের কথামনের চার দেওয়ালের অন্দরে অবরুদ্ধ থাকে, ভাষা পায় না। সুমনার কলম সেই সব অবরুদ্ধ মনের কথাকে স্বাধীনতা দেয়, মুক্তির উল্লাস এনে দেয়, নিঃশব্দেরা ভাষা পায়। যাদের মনের কথা হয়তো কোনও দিনই আপনার জানা হতো না, যারা নিজের কথা নিজে বলতে পারে না সুমনার কলম তাদের মনের কথা তুলে ধরে।
 

কিন্তু শুধু কি তাই?

গল্প কথক এখানে শুধু গল্প বলেই ক্ষান্ত হন না, তার স্বাতন্ত্র্য চরিত্র নিয়ে হাজির হন গল্পের প্রতিটি বাঁকে, হাজির হন তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে। মন বলতে চাই সেদিক থেকে শুধু গল্পের চরিত্রের নয়, আবার শুধু লেখিকার নয়। সুমনার লেখনিতে তাই দুটি মনের কথা পাশাপাশি চলতে থাকে, গল্পের চরিত্র বা চরিত্রগুলির মন ও লেখিকার (মনোবিদ মালা সেনগুপ্তের) মন।
তৃতীয় মনটি আপনার (পাঠকের), যে মনে ড. সেনগুপ্তের অভিজ্ঞতাগুলো, তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সজোরে আঘাত হানে। হয়তো অভিজ্ঞতাগুলো আপনাকে ভাবাবে, কাঁদাবে, চিন্তা করতে শেখাবে, সমাধান খুজতে অনুপ্রাণিত করবে। লেখিকা মুন্সিয়ানার সাহায্যে যে গল্প তুলে ধরেন তার চিত্রকল্প ভাসতে থাকে আপনার চোখে, ব্যাথাতুর তিন মন একে অপরের দুঃখে সমব্যাথী হয়ে কখনও কখনও হাত ধরাধরি করে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। গল্প আর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মিলে নারীর অচেনা রূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?

 

ত্রিগুণা

কেন মন বলতে চায়? কিংবা সুমনা মালা সেনগুপ্তের লেখা ডায়েরির গল্পগুলো কেন পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চায়?
হ্যাঁ, পাঠককে সচেতন করার একটা প্রয়াস বা দায় যে লেখিকার আছে তা লেখিকা নিজেও অস্বীকার করেননি। কিন্তু শুধু কি তাই? অনেকদিন আগে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রশ্ন তুলেছিলেন, নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারে? কারণ, নিম্নবর্গের তো কোনও ভাষা নেই। তাঁরা তো কথা বলতে জানে না। মেয়েরা তো নিম্নবর্গের, তারা নিজে কথা বলতে জানে না। তাই তাদের হয়ে কলম ধরতে হয় পুরুষকে। কিন্তু বিংশ শতকের গোড়াতেই তো ভার্জিনিয়া উলফ, সিমোন-দ্য-বোভেয়ার প্রমুখ নারী চিন্তকরা এই পুরুষ কতৃক নারী চরিত্র নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁরা বলেন, পুরুষের কলমে যে নারী চরিত্র উঠে আসে সে বাস্তবের নারী নয়, পুরুষ যেমন ভাবে তাকে দেখতে আর দেখাতে চায় তেমন নারীর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তাদের কলমে। আর এখানেই অপরিহার্য হয়ে ওঠে নারীর কলম।

১৯৭৯ সালে সান্দ্রা গিলবার্ট ও সুসান গুবার লিখেছেন ‘The Madwoman in the Attic. গিলবার্ট এবং গুবারের মতে, উনিশ শতকে পুরুষ-রচিত সাহিত্যগুলিতে সমস্ত মহিলা চরিত্রগুলিকে দু’ ভাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা হয়েছে হয় তারা ‘দেবদূত’/ ‘ফেরেশতা’ (angel) নতুবা তারা ‘দানব’ (monster)। ‘ফেরেশতা’ চরিত্রটি ছিল বিশুদ্ধ, নিরপেক্ষ এবং বশ্যতাপূর্ণ; অন্য কথায়, পুরুষ শাসিত সমাজে আদর্শ নারী ব্যক্তিত্ব। ‘দেবদূত’ চিত্রের তীক্ষ্ণ বিপরীতে, ‘দানব’ মহিলা চরিত্রটি ছিল কামুক, আবেগপ্রবণ, বিদ্রোহী এবং সিদ্ধান্তহীনভাবে অনিয়ন্ত্রিত: সমস্ত গুণাবলী যা ভিক্টোরিয়ান আমলে পুরুষদের মধ্যে প্রচুর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই পুরুষ লেখকদের একটা ঝোঁক থাকে এই আবেগপ্রবণ নারীকে দানব বা মানসিক ভারসাম্যহীন নারী (Madwoman) হিসেবে দেখার ও তাকে ‘অপর’ এবং প্রান্তিক করে রাখার। গিলবার্ট এবং গুবারের মতে নারীত্বের এই দুটি প্রতীকের কোনওটিই, সম্পূর্ণ বা পরিপূর্ণ নারী নয়। দুটি সত্তার মিলিত রুপ একটি সম্পূর্ণ নারী চরিত্রকে প্রতিফলিত করতে পারে। আসলে তো নারী ত্রিগুণা কিংবা আরও অনেক সত্তা বা গুণের অধিকারিনী। শিবপুরাণে (২.৩.৪) দেবীকে (উমা/দুর্গা/সতী) বর্ণনা করতে গিয়ে ত্রিগুণা হিসাবে (‘দেবী দুর্গা’, ‘ব্রহ্মাণ্ডের মা’, ‘দুর্গম দুর্দশার বিনাশকারী’) তুলে ধরা হয়েছে।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪১: প্রতিকার না করেও রাজা যদি প্রজার দুঃখটুকুও শোনেন তাহলেও যথেষ্ট

 

কিন্তু বর্তমানে নারীর প্রতিটি সত্তাই কি সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়? বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নারীকে উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে কি খুব বদল এসেছে সাহিত্যে?

সংবাদ মাধ্যম কোন নারীকে দেখাতে চায়? কোন নারীকে আদর্শ হিসাবে তুলে ধরতে চায়? বিদ্রোহী, লাঞ্ছিত, প্রতিবাদীরা কতদিন শিরোনামে থাকে?সমস্যার কথা বলা, অবসাদগ্রস্থ, চিরাচরিত ব্যবস্থার বিরোধীতা করা নারীরা তো আসলে সেই প্রান্তিক মুখ হয়েই রয়ে যায়। যে চরিত্রগুলোকে সামনে আনার ক্ষেত্রে সমাজ আজও দ্বিধাগ্রস্থ। সেই প্রান্তিক মনের কথা তুলে এনে সুমনা নারী ইতিহাস চর্চার অপূর্ণতাকে ভরাট করার প্রচেষ্টা করলেন। সুমনার লেখায় স্বতস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে নারীর এক নিজস্ব সংস্কৃতি, সমাজচেতনা এবং আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ। সর্বোপরি গল্পের নারীচরিত্রগুলির সঙ্গে তাঁর ভগিনীপ্রতিম একাত্মবোধ, যেটি উঠে আসে চরিত্রগুলির অবসাদের মনস্তাত্তিক বিশ্লেষণে। অবসাদ গ্রস্থ নারীর চরিত্রায়ণ ও মনোবিদ হিসাবে তাদের সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে লেখিকার দ্বৈত স্বত্তা প্রকাশ পায়।দুটি ভূমিকা সম্পাদনেই সুমনা অনবদ্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।

 

মন বলতে চায়

লেখক: সুমনা (বাগচী)
প্রকাশক: দ্য কাফে টেবল
প্রকাশকাল: ২০২৪
দাম: ১৫০ টাকা

* লেখক ড. ইমরান ফিলিপ। গবেষক, রিসার্চ ফেলো, দি এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা। ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলো, ইন্ডিয়া চায়না ইনস্টিটিউট, দি নিউ স্কুল (আমেরিকা)।

Skip to content