শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


বাংলা ভাষা আজ যেমন, অনেক আগে ঠিক এরকম ছিল না, অনেক পরেও তেমনটা থাকবে না।

এরকম বললে প্রশ্ন হতে পারে, আগে মানে কত আগে? পঞ্চাশ, দুশো না পাঁচশো? পরে মানেও কতো পরে? তিরিশ, দেড়শো না…?

আবার, এমন মনে হতেই পারে, ভাষাটাই থাকবে তো? প্রতিদিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে বসা, ছবি হয়ে যাওয়া নানা ভাষার বিপন্নতায় মিশে যাবে নাতো? এই ভাষায় কথাবার্তা বলার লোক থাকবে?

ভাষা চর্চার বিষয়, ভাব আদান প্রদানের বিষয়। দেয়া নেয়ার এই ভাব না থাকলে মিলাবে মিলিবে কি?
এই সব ভাবনার মূলে ভাষাতত্ত্ব আছে, আছে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্র আছে, ক্ষমতার অলিন্দ ও অক্ষম যুক্তিনিষ্ঠ দক্ষিণের জানলা আছে। বারান্দায় রোদ্দুর, দক্ষিণের জানলার পথে যুগ যুগান্তের হাওয়া আসে যায়। প্রাচীন, আদিম, প্রাগৈতিহাসিক, ঐতিহাসিক, আধুনিক, উত্তরাধুনিক, নব্য ইত্যাদি প্রভৃতির পথ ধরে ধরে রূপবেদনাদি পঞ্চস্কন্ধের ভার এড়িয়ে স্বর্ণময় করুণা নৌকা কখন যেন সোনার তরী হয়ে অচলায়তন ভেদ করে। তাসের দেশ কিংবা ভুশুণ্ডীর মাঠের ঝোড়ো হাওয়া, গলিত স্থবির ব্যাঙ আর সংঘারামে জেগে থাকা মশাদের ছাড়িয়ে ভিখু আর পাঁচি নবমীর চাঁদ, প্রাগৈতিহাসিক তমিস্রা কিংবা আশাবরী আলো খোঁজে?
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৭: লোকে যারে বড় বলে

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি

আগে আর পরেকে নিজের মতো করে গড়ে নেওয়ার বাংলাভাষা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। নিঃসন্দেহে ভাষার ইতিহাস আর তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের পরিসরে এক সন্ধিক্ষণ। শিল্পের চর্চায় ক্লাসিক্যাল থেকে সেমি, মর্ডার্ণ, ফিউশন, অ্যাবসট্রাক্টের নানা ধারা। শিল্পের বাহন ভাষাকে ঘিরেই আবেগের স্রোত, যুক্তির সিঁড়ি কিংবা প্রাচীর ওঠে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

ভাষাই ভাবের আধার, ভাবনার আশ্রয় হয়ে সামাজিক অবস্থান, উত্তরণ, জাতির বৌদ্ধিক চর্যা-চর্যার সাক্ষ্য বহন করেছে। বাংলাভাষা তার ব্যতিক্রম নয়। তার খাতায়-কলমে ‘ক্লাসিক্যাল’ হয়ে ওঠায় নতুন নতুন ভাষ্য ও সমীকরণের সম্ভাবনা, মৌরলা মাছ আর নালচে শাক দিয়ে লাঞ্চ করা আর তার দুঃখ অবধানের চর্যার বারোমাস্যা আমানির গর্ত দেখা সেই অতীত মানুষ বাংলাকে জীবনানন্দ, প্রাণের সুখ বলে ভেবেছে, ভাবছে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

কিন্তু এই তকমা জাদুকরের রংদার বিবর্ণ পোষাকের বুকে ঝুলতে থাকা অনুজ্জ্বল মেডাল না হয়ে যায় এটাই শুধু ভাবার, সংস্কৃতের সং নিয়ে অন্য অন্য আরও নানানরকম সাজ, প্রেরণা নিয়ে ইং-এর পালিশ দিয়ে বং হয়ে ওঠা বঙ্গীয় বঙ্গভাষা জয়যুক্ত হোক এ তো বলা বাহুল্যমাত্রই। গাঙুড়ের জলে ভেলা ভাসিয়ে হাজার হাজার বছরের স্রোত ঠেলে চাঁদসদাগরের চাঁদের তরণী বনলতা সেন কিংবা, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি, সেলাই দিদিমণিদের স্বপ্নে আসে যায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

কেএফসি সিসিডি আইফোন চ্যাটজিপিটির ব্রো সিস-দের মুখে যে বাংলায় মজা ওড়ে, খিল্লি শোনা যায়, তাদের হাসি কান্নার হীরা পান্নার পাশেই এই দাদা, দিদি, ভাই, বোন, মাসি পিসিরাও বাংলায় এখনও হাসে, কাঁদে, খিস্তি করে, ডায়লগ দেয়। মাতৃভাষায় কাজের সুযোগ বৃদ্ধি হলে যেমন ভাষা বেঁচে থাকবে, তেমনই কাজের পরেও তাকে আগ্রহের সঙ্গে চর্চা চর্যায় রাখলে চাইলে শুধু আবেগ, রাগে, ক্রোধে বা দুঃখে বাংলা বেরিয়ে আসার ব্যাপারটা না হয়ে রূপে, জয়ে, যশে, ক্ষান্তিতেও সে থাকবে, ধ্রুবপদে অন্তরতর হয়ে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content