বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর, ২০২৪


বসুন্ধরা ভিলায় কার কথা হচ্ছে তা মায়ের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু অরুণাভর সঙ্গে বাবলির ঠিক কতটা যোগাযোগ রয়েছে সেটা জানা দরকার আর বাবলিকে সাবধান করাটা জরুরি। বসুন্ধরা ভিলায় গায়ে বহির্বিশ্বের কলঙ্কের দাগ সুরঙ্গমা লাগতে দেবেন না।

একটাই সৌভাগ্য যে এখনো খবরের কাগজে অরুণাভকে জড়িয়ে বাবলির কোনও উল্লেখ নেই। অদ্ভুতভাবে যিনি এটা নিয়ে জলঘোলা করতে পারতেন সেই আগরওয়াল ভীষণভাবে চুপচাপ।

মা একদিন দুপুরবেলায় লাইব্রেরি ঘরে বাবার উপস্থিতিতে বাবলিকে ডেকে পাঠালেন। লাইব্রেরি ঘরের দরজা ভেজানো থাকতো সেই দরজা ঠেলে একমাত্র মা যেতে পারতেন। বসুন্ধরা ভিলার ক্যাটারিং সার্ভিস এর এজেন্সির লোকেরা কফি নিয়ে এলে বাইরে থেকে ঘরে ঢোকার অনুমতি চাইতেন। কখনও কখনও দরজা হাট করে খোলা থাকতো। তখন হয়তো বাবা কিছু লিখছেন না বা মন দিয়ে কিছু পড়ছেন না। এমনি চুপচাপ বসে আছেন। বা কেউ এসেছেন কথা বলার জন্য । তখনও হুট করে কেউ খুব একটা ভয়ংকর জরুরি কিছু না হলে ঢুকতেন না। এদিন মা দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলেন।

কোনও ভূমিকা না করে মা সরাসরি অরুনাভর অন্তর্ধান প্রসঙ্গ তুললেন জানালেন তার খুব পরিচিত একজন সাংবাদিক সে বিষয়ে ঠিক কী জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সেটা বাবলি আশা করেনি। কিন্তু তার ভাবনার মধ্যে কোন অন্যায় নেই কোনও দুর্বলতা নেই তার। তবুও সে কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজিয়ে চুপ করে বসে রইল।
তারপর একতলা লাইব্রেরি ঘরের খোলা জানলা দিয়ে পিছলে যাওয়া সবুজরঙের লন থেকে পুজোর পরে কলকাতার মেঘরোদ্দুরে ঝলমলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে গেল—
—সেজমা আমি বাবি বা তোমাদের লজ্জিত করার মত কোনও ভুল এখনও করিনি আর করবও না।

বাবলি বাড়ির অনেকের মতোই আমার মা সুরঙ্গমাকে সেজমা বলে ডাকে কিন্তু বাবাকে বলে সেজ্জেঠু। প্রথম দিন থেকেই শ্বশুরমশাই তরুণকান্তি মানে আমার ন’কাকাকে বাবলি, বাবি বলে ডাকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনদিন শাশুড়ি সুজাতাকে মা বলে ডাকতে শুনিনি বোঝাবার প্রয়োজন হলে বাবলি ‘উনি’ বা প্রণয়ের মা বলে! আসলে পছন্দটা একেবারে ব্যক্তিগত পছন্দ বা সম্ভ্রম আদায় করা যায় না অর্জন করতে হয়।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ৩য় খণ্ড, পর্ব-৪২: অরুণাভ অন্তর্ধান

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন

—অরুণাভকে টিভিতে দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল। হঠাৎ করে কলেজের দিনের মজা আনন্দ রিহার্সালের ঝগড়াঝাঁটি বা হুল্লোড়কে যেন খুঁজে পেয়েছিলাম। দিল্লিতে আমি আর যাই না। মার সঙ্গে ফোনে কথা বলি। এত বছর ধরে আমার মা ওখানে থাকেন বাকি জীবনটাও থাকবেন। কিন্তু আমি গিয়ে আবার নতুন করে তাদের সমস্যা তৈরি করতে চাইনি। ও বাড়িতে মায়ের জন্য মাসোহারা বাবদ কিছু দেবার স্পর্ধা আমার নেই। প্রণয় আজ পর্যন্ত আমার মায়ের সঙ্গে একবারও টেলিফোনে কথা বলেনি। আমি চাইওনি। কাকা বা জ্যাঠাদের সঙ্গে ফোনে কথাবলার সময় একই সাজানো মিথ্যে বারবার বলি যেটা মাকেও বলে থাকি। কোম্পানির কাজে ভীষণ ব্যস্ত, একদম সময় পায় না। আমার সঙ্গে প্রণয় ঠিক কী ব্যবহার করে এটা বসুন্ধরা ভিলার বাইরে কেউ জানেন না । সেটা আমার দুর্ভাগ্য আমার দুর্বলতা আমার ব্যক্তিগত আক্ষেপ। দিল্লিতে কখনও জানাইনি। পুজো বা অনুষ্ঠানে আসা বসুন্ধরা ভিলার বাইরের আত্মীয়-স্বজনের সামনে কখনও প্রকাশ করিনি। রক্তকরবীর ভিডিও ক্যাসেটটা পাওয়ার পর টেলিফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে অরুণাভর সঙ্গে কথা হয়েছে কিন্তু সামনাসামনি এতদিনে খুব জোর ৪-৫ বার দেখা করেছি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৮: পালাবার কোনও পথ নেই

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?

অরুণাভ এই মুহূর্তে সেলিব্রেটি। বহুবার স্টুডিয়োতে আসতে বলেছে নানান ফাংশানে ডেকেছে। আমি খুব সন্তর্পণে যাতে ওর খারাপ না লাগে সেইভাবে এড়িয়ে গিয়েছি। বাবির কথা বলেছি, বলেছি বাবি আমি না থাকলে ওষুধ খেতে চান না। যেটা সম্পূর্ণ অসত্য না হলেও পুরোপুরি সত্যি নয়। আমি চাই না আমাকে জড়িয়ে কোনও গসিপ চালু হোক। অরুণাভকেও বিবাহিত জীবনের সমস্যা নিয়ে কখনও কিচ্ছু বলিনি। উল্টে অরুণাভর সামনে আমাকে ‘হ্যাপিলি ম্যারেড এভার আফটার’-এর নিখুঁত অভিনয় করতে হয় যাতে আমার ব্যক্তিগত সমস্যা শুনে অরুণাভর আমাকে নিয়ে কোনও ভুল ধারণা না হয়। ও বারবার প্রণয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে, আমি এড়িয়ে গিয়েছি। দূর্গাপূজোয় এবার না হয় বড়মা’র জন্য সেরকম কিছু হয়নি। কিন্তু এতবছর এতও জাঁকজমক হয়, এত সেলিব্রিটিরা আসেন, কিন্তু আমি সে প্রসঙ্গ তুলি না বলেই অরুণাভ আর কিছু বলেনি। হয়তো ভেবেছে বসুন্ধরা ভিলা খুব কন্সারভেটিভ তাঁরা বাড়ির বউয়ের পুরুষবন্ধুকে অ্যাকসেপ্ট করবেন না।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

এ বারের পুজোর মধ্যে বারবার খেতে ডাকছিল, আমি বাড়ির পুজোটুজো বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর দশমীর দিন লাঞ্চে ডাকল, আমি না করে দিলাম। বললাম, সেদিন বাড়িতে সকালসন্ধ্যে অনেক কাজ। ব্রেকফাস্টে ডাকলো। আর না করিনি। আসলে ছোটবেলা থেকে দিল্লিতে পড়াশোনা বেড়ে ওঠা ওর এখনও অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর অসুবিধে হয় । বিশ্বাস করে মনের কথা মানে কাজের পছন্দ অপছন্দ, খারাপ লাগা এসব মন খুলে কাউকে বলতে পারে না বুঝতে পারি সবাই আমার মতো নয়। কারও কারও মনের জমে থাকা কালোধোঁয়া বের করে দেবার চিমনি লাগে। এখানে ওর কাজের বাইরে কেউ পরিচিত নেই, সেই জন্য বারবার আর না বলতে পারতাম না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

এতক্ষণ কথা বলার পর বাবলি এসে মায়ের পাশে বসলো। বাবলির হাতটা মা ছুঁয়ে থাকলেন। বাবলি আবার বলতে শুরু করল—
—ভেবেছিলাম বিজয়াদশমীর সকালবেলার ব্রেকফাস্ট, রেস্টুরেন্টে কোন ভিড়ভাট্টা থাকবে না। ছিলও না। এদিকে ওদিকে একটা দুটো ফ্যামিলি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করে আবার বাড়িতে ফিরে এলাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে। আমাদের একেবারে অজান্তে সেদিনে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। কোনও একটি ফ্যামিলি নিজেদের সেলফি তোলার নাম করে তার মধ্যে আমাদের টেবিলের ছবি তুলেছিল। এটা তো তুমি বুঝতেও পারবে না। আমরাও পারিনি। সেই পরিবার সম্ভবত ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে এই ছবিটা শেয়ার করে। সেটা ভাইরাল হবার কোন কারণ ছিল না, হয়ওনি। কিন্তু প্রণয়ের কোনও এক বন্ধু যদি আমি খুব ভুল না করি সেটা আগরওয়াল, ওকে সেই ছবিটায় আমার সঙ্গে অরুণাভকে দেখিয়ে ইনস্টিগেট করে। প্রণয় এসে এটা নিয়ে ভয়ংকর অশান্তি করে। এরকম হিস্টোরিক হতে ওকে আমি কখনো দেখিনি। এবার এই ছবিটা থেকে যদি কেউ গসিপ তৈরি করলে সেটা…

বাবা এতক্ষণ তার লেখার চেয়ারে হেলান দিয়ে বাবলির কথা শুনছিলেন হঠাৎ হাত তুলে বাবলিকে থামালেন। চোখবোজা চশমা টেবিলে লেখার ক্লিপবোর্ডের পাশে রাখা। বাবা এতবছর ধরে এত অসংখ্য গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এভাবেই ক্লিপবোর্ড এর ওপর লাগানো পাতায় লিখে গিয়েছেন।
—বাবলি এক মিনিট। এই অরুণাভর অন্তর্ধানের পর প্রণয় রিঅ্যাকশন ঠিক কী?
—রিঅ্যাকশন মানে ও কিছু বলেনি। আমিও …কোন কথা বলিনি!
আমাদের মধ্যে কথা তো খুব একটা…
হঠাৎ একটা টেলিফোন এল বাবার কাছে। কথা শুনে মা বুঝতে পারলেন তারকবাবুর টেলিফোন।
—হ্যাঁ, বাবু বলুন!
ও প্রান্তের কোন প্রশ্নের উত্তরে বাবা আশপাশ দেখে বললেন—
—হ্যাঁ, একাই আছি বলুন!
পরের কথাগুলো শুনে বাবা চমকে সোজা হয়ে বসলেন
—সেকি! কী বলছেন বাবু?—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content