বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


বশিষ্ঠ মন্দির।

সমাজ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থক্ষেত্রগুলিকে কেন্দ্র করে রয়েছে অনেক রকম পৌরাণিক কিংবা প্রচলিত গল্প। অসমের মাটিতেও অনেক পুরনো পুরনো মন্দির বা দেবালয় আছে। আছে দেবী তীর্থ কামাখ্যা, উমানন্দ, বৈশিষ্ট মন্দির, ভুবন পাহাড় তীর্থ, কাঁচাকান্তি মন্দির, পোয়ামক্কা প্রভৃতি।

গুয়াহাটি শহরের বুকে রয়েছে মুনিবর বশিষ্ঠের প্রতিষ্ঠা করা বশিষ্ঠ আশ্রম। এখানে সন্ধ্যা, ললিতা এবং কান্তা—এই তিন জলধারার অদ্ভুত সুন্দর সঙ্গম হয়েছে। বর্তমান আশ্রম গৃহটি আহোম রাজা রাজেশ্বর সিংহ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই আশ্রমকে ঘিরে অনেক গল্প আছে। বলা হয়, ব্রহ্মার ন’জন জ্ঞানী মানস পুত্রের মধ্যে এক জন হলেন বশিষ্ঠ মুনি। তিনি সূর্য বংশের কুল পুরোহিত ছিলেন। উল্লেখ্য, এই সূর্য বংশে রামচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কালিকা পুরাণে উল্লেখ রয়েছে সূর্য বংশের এক রাজার যজ্ঞ করার অভিলাসা হয়। তিনি বশিষ্ঠ মুনিকে যজ্ঞ করার জন্য অনুরোধ করেন। এই যজ্ঞ করতে এক হাজার বছর সময় লাগবে।

এদিকে দেবরাজ ইন্দ্রও যজ্ঞ ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বশিষ্ঠ মুনিকে অনুরোধ জানিয়েছেন। যজ্ঞের জন্য পাঁচশো বছর সময় লাগবে। তাই মুনিবর রাজাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে অনুরোধ করে ইন্দ্রের যজ্ঞ সম্পাদন করতে চলে যান। এদিকে রাজা দীর্ঘ দিন ধরে বশিষ্ঠ মুনির অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে গৌতম মুনিকে আমন্ত্রণ করে সেই যজ্ঞ সম্পন্ন করেন।
এ দিকে ইন্দ্রের যজ্ঞ শেষ করে ফেরার পর বৈশিষ্ঠ মুনি সব শুনতে পেয়ে খুব ক্রোধান্বিত হয়ে রাজাকে ‘দেহ হীন হও’ বলে শাপ দেন। যজ্ঞের ফলে রাজাও যথেষ্ট ক্ষমতাশীল হয়ে পড়েছিলেন। তিনিও মুনিকে একই শাপ দেন। দেহহীন হয়ে বশিষ্ঠ মুনি ব্রহ্মাদেবের কাছে যান, ব্রহ্মা তখন মুনিকে কামরূপের নির্জন সন্ধ্যাচলে ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা করার পরামর্শ দেন। তখন কামরূপে নরকাসুরের রাজত্ব ছিল। সন্ধ্যাচল এক জলবিহীন গভীর অরণ্য ছিল।

বশিষ্ঠ মুনি শিবের আরাধনা করেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে গঙ্গাকে আদেশ দেন প্রবাহিত হতে। গঙ্গা সন্ধ্যা, ললিতা এবং কান্তা—এই তিন জলধারা হয়ে প্রবাহিত হন। বশিষ্ঠ মুনি এখানে তপস্যা করে এই তিন জলধারার জলে স্নান করে দেহ ফিরে পান। এখানে এই আশ্রম থেকে কিছুটা দূরে গভীর অরণ্যে মুনিপত্নী অরুন্ধুতি দেবীর আশ্রম রয়েছে। মনে করা হয়, আহোম রাজা রাজেশ্বর সিংহ স্বপ্নে বশিষ্ঠ আশ্রমের সন্ধান পেয়ে এই আশ্রমের পুনর্নির্মাণ করেন। এই আশ্রমের চতুর্দিক এতটাই সুন্দর যে আশ্রমচত্বরে চুপ বসে থাকতেই সাধারণ মানুষের ভালো লাগে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব ২৮: বরাকের সাহিত্যে উনিশে মে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

গুয়াহাটি মহানগরীর ব্রহ্মপুত্র নদী বুকে দাঁড়িয়ে আছে উমানন্দ মন্দির। প্রতিদিন পর্যটকদের ভিড় দেখা যায় উমানন্দে। আর দেখা যাবেই না কেন! কারণ বিশাল ব্রহ্মপুত্রের বুকে একটি নয়নাভিরাম শীলাময় দ্বীপ উমানন্দ। কালিকা পুরাণ এবং যোগিনীতন্ত্রে একে ভষ্মাচল, ভস্মকূট কিংবা ভস্মশৈল নামে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়, কামদেব এখানেই তপস্যারত শিবের ধ্যান ভঙ্গ করেন এবং শিবের এখানে মহাদেব দেবী উমার সঙ্গে সময় কাটান। তাই এর আরেক নাম উমানন্দ বা উমা নাথ।

ইংরেজরা এই দ্বীপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একে ‘পিকোক আইল্যান্ড’ বলতেন। দ্বীপে কয়েকটি মন্দির রয়েছে। উমানন্দ মন্দির, চন্দ্রশেখর বৈদ্যনাথ এক সীমানার ভিতরে রয়েছে। এই মন্দিরগুলি থেকে কিছুটা দূরে সীমানার বাইরে রয়েছে হরগৌরী মন্দির। উমানন্দ মন্দিরটি ১৬৯৪- ৯৫ সালে আহোম রাজা গদাধর সিংহ নির্মাণ করান। মন্দিরের চার সীমানায় রয়েছে গণেশের মূর্তি। মূল মন্দিরটি হল উমানন্দ। এখানে শিবলিঙ্গের পুজো হয়। শিবরাত্রির দিনে ভক্তদের ভীড় উপচে পরে এই মন্দিরে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩১: হেমন্তবালা দেবী— রবি ঠাকুরের পত্রমিতা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭১: মহাভারতে বর্ণিত পোষ্যপ্রাণী ও পালকপিতার সম্পর্কের বাঁধন, আজও খুঁজে পাওয়া যায় কী?

গুয়াহাটি প্রাচীন গল্প সমূহে কামদেবের এক ভূমিকা সব সময় লক্ষ করা যায়। শহরের কিছুটা বাইরে রয়েছে দিওয়ান গিরি বা মদন কামদেব পর্বত। এই পর্বতের সুন্দর পরিবেশে ‘প্রত্নতত্বর রত্ন ভাণ্ডার’ নামে মদন কাম দেবের একটি প্রাচীন মন্দির অবস্থিত। এক সময় এই মন্দিরটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছুই জানত না। ১৯৭৭ সালে অসমের প্রত্নতত্ব বিভাগ এই মন্দিরটি খুঁজে পায়। অপূর্ব ভাস্কর্য-সহ মূর্তি এবং মন্দির জনসমক্ষে তুলে ধরে। মন্দিরের গর্ভগৃহে উমা এবং শিবের মূর্তি রয়েছে। মন্দির উদ্ধারের খননকার্যে অনেক মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। আশপাশে আরও মন্দিরের ভগ্নাবশেষও পাওয়া যায়।

ক্রাইস্টচার্চ।

অসমের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র তীর্থক্ষেত্র পোয়ামক্কা। কামরূপ জেলার হাজোর গরুড়াচল পাহাড়ে এই পোয়ামক্কা অবস্থিত। ষোড়শ শতকের ধর্ম প্রচারক এই তীর্থক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি এবং একটা মসজিদ রয়েছে। বলা হয়, মক্কা থেকে এক পোয়া মাটি আনা হয়েছিল এই মসজিদের নির্মাণ কার্যে। আবার এমনও শোনা যায়, এই মক্কা দর্শন করলে মূল মক্কা দর্শনের চার ভাগের একভাগ পুণ্য লাভ হয়। তাই একে পোয়া মক্কা বলা হয়। জানা যায়, গিয়াসউদ্দিনের জন্ম ১১৯৩ সালে। তিনি নিজে সুলতান হিসেবে প্রায় ৩৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর আসল নাম শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

এক সময় তাঁর আর রাজকার্য ভালো লাগছিল না। তখন তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে মন নিবেশ করেন। অসমের হাজতে প্রায় ২০ বছর ছিলেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। কেউ কেউ বলেন, তাঁর কবর নির্মাণের জন্য এক পোয়া মক্কার মাটি আনা হয়। আবার এমনও শোনা যায়, ১২২২ সালে আরবে হওয়া এক মহামারীর সময় ভারতে এসে তাঁর তিন সঙ্গীকে নিয়ে অসমের ওই অঞ্চলে আজীবন বাস করেন। অসমের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভক্তরা এই দরগায় যান। অসমে সব চেয়ে প্রাচীন মুসলিম ধর্মপ্রতিষ্ঠান এই পোয়া মক্কা।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

মূলত ইংরেজদের হাত ধরেই উত্তরপূর্বাঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তিত হয়। গুয়াহাটি পানবাজার অঞ্চলে উত্তর পূবাঞ্চলের সর্বপ্রাচীন চার্টটি অবস্থিত। ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ‘ক্রাইস্টচার্চ’টি। ১৮৪৪ সালের ৯ মে গির্জাটি ‘চার্চ অব ইংলেন্ডের চেপলিন রেভারেন্ড রবার্ট ব্লেন্ড প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত অসমের চা বাগানগুলিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য অনেক ব্রিটিশের অসমে আগমন ঘটেছিল। সেই সময় এই চার্চটি যথেষ্ট সুন্দর ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৮৫৬ এবং ১৮৯৭ সালে হওয়া ভূমিকম্পে এর বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। চার্টটিকে মেরামত করা হয়েছে বহুবার। বহু সময়ের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই উত্তরপূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো এই চার্চটি।

পোয়ামক্কা।

তীর্থক্ষেত্র গুলির একদিকে যেমন জড়িয়ে থাকে ধর্মীয় বিশ্বাস, ঠিক তেমনি এই সব তীর্থক্ষেত্রের সঙ্গে থাকে অনেক রকমের গল্প। অনেক ইতিহাসের ভগ্নাবশেষও দেখতে পাওয়া যায়। পর্যটকের মন নানা কারণেই আকর্ষণ করে এই ধর্মীয় স্থানগুলি। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন অনেক ছোট-বড় মন্দির, মসজিদ কিংবা চার্ট। আর তার পিছনে আছে এক বা একাধিক গল্প। সবুজে ঘেরা অসমও তার ব্যতিরেকে নয়। অসমের বন্ধুর মাটিতেও আছে বিভিন্ন সময়ের চিহ্ন বহনকারী এমনই অনেক তীর্থক্ষেত্র।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content