বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর ১৯৬০ সালে অসম বিধানসভা ভাষা বিল পেশ করে। বরাক উপত্যকার বিধায়ক মইনুল হক, নিবারণচন্দ্র লস্কর, জ্যোৎস্না চন্দ, নন্দকিশোর চন্দ, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, মুনীন্দ্রকুমার দাস, হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, রামপ্রসাদ চৌবে, অরুণলাল রায়, আলতাফ হোসেন মজুমদার এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠতার সঙ্গে বিল পাশ হয়। বরাক উপিত্যকা তথা গোটা অসমের মানুষের মাথায় যেন বাজ পড়ে। শুরু হয় সভা-সমিতি, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন। আর সেই সঙ্গে ‘বঙ্গাল খেদার’ আগুন সারা অসমে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬০ সালের জুলাই মাসে করিমগঞ্জে ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। ১১ জুলাই করিমগঞ্জে বনধ ডাকা হয়। সেদিন বিকেলে এক বিরাট জনসভায় হাজার হাজার মানুষ জমা হয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য শপথ নেন। এই ধরনের অনেক সভা-পদযাত্রা হয়েছে সে সময়। ১ লা বৈশাখ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাকের মানুষজন মাতৃভাষা মর্যাদা রক্ষা করার দাবিতে ‘সংকল্প দিবস’ পালন করেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার পর্ব ২৬: উনিশের প্রাক-কথন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

মাতৃভাষার প্রতি আবালবৃদ্ধবনিতার বুকে ভাষা প্রেমের আগুন জ্বলে ওঠে। সংগ্রাম পণপরিষদ ১৯ এপ্রিল ভোর চারটায় করিমগঞ্জ টাউন হল থেকে এক বিশাল পদ যাত্রা শুরু করে। রাত্রিবেলাটুকু বাদে এই পদযাত্রা দেশাত্মবোধক গান এবং বাংলা ভাষার জয়ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। একুশ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত প্রতিদিন ভাষা সংগ্রামীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়েছেন। কাছাড় জেলা গণ সংগ্রাম পরিষদ ১৯ মে সমগ্র জেলার বনধের ডাক দেয়। উনিশে মে দিনটিকে সফল করার জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন ভাষা সংগ্রামীরা। উনিশে মে’র ডাক দিয়ে ভাষা সেনানীরা, স্থানীয় নেতারা একটি আবেদনপত্র জনসাধারণের হাতে তুলে দিয়ে ছিলেন।
উনিশে মে দিনটিকে স্বার্থক করতে অনেক দিন, তারিখের কাহিনি লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আঠেরো তারিখ বিকেলে ‘উনিশে মে সফল করো’ এই স্নোগান দিয়ে এক শোভাযাত্রা হয়। তাতে বহু মানুষ যোগ দেন। পরদিন সকাল ৪টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হরতাল হবে বলে ঠিক করা হয়। ঠিক সকাল থেকেই সারা শহর সত্যাগ্রহীতে পূর্ণ হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষ মাতৃভাষার জন্য পথে নেমে এলেন। অসংখ্য মানুষ রেল স্টেশনে জড়ো হয়ে রেল লাইনে বসে পড়েন। সত্যাগ্রহীরা সকাল ৫.২০ মিনিটে করিমগঞ্জগামী ট্রেনটি আটকে দেয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্তনারী মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৪: জোড়াসাঁকোয় পাগল-যাচাই

প্রসাশন এবং রেল স্টেশনের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, জেলা প্রসাশন, ম্যাজিস্ট্রিট, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সামনেই শান্তিপূর্ণ ভাবে সত্যাগ্রহীরা ধর্মঘটে ছিলেন। কিন্তু সকাল ৭.৩০ টায় অসমের পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র শান্তিপ্রেমী ভাষাসেনানীদের উপর। পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করেও সত্যাগ্রহীরা রেল লাইন থেকে সরে যাননি। শিলচরের তারাপুর রেল স্টেশনে তখন ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছিল। কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জে পরও সত্যাগ্রহীরা রেল স্টেশন চত্ত্বর ছেড়ে যাননি। পুলিশ ভাষা সংগ্রামীদেরকে অস্থায়ী জেল হাজতে পাঠাতে থাকে। কিন্তু এক সময় জেলে ও থানায় আর জায়গা না থাকায় জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে শহর থেকে অনেকে দূরে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। একই দৃশ্য সেদিন করিমগঞ্জ রেল স্টেশনেও ছিল। সেখানেও সত্যাগ্রহীদের উপর পুলিশ লাঠি চালায়।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

সমগ্র বরাক উপত্যকায় বনধ ভালো ভাবেই চলছিল। সূর্যের প্রখর দাবদাহকে মাথায় নিয়ে ভাষাপ্রেমীরা রেল লাইনেই ছিলেন। দুপুর পর্যন্ত ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। হাজার হাজার সত্যাগ্রহী রেল স্টেশনের আশপাশেই ছিলেন। কিন্তু কাঠিগড়া থেকে নয় জন সত্যাগ্রহীদেরকে হাতকড়া লাগিয়ে ট্রাকে নিয়ে সত্যাগ্রহীদের সামনে এসে হাজির হয়। ভাষা সেনানীদের এমন বন্ধিদশা দেখে রাগে, দুঃখে শিলচরের বিপ্লবীরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয়ে গাড়ির চালক পালিয়ে যান। শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ। সত্যাগ্রহীরা এত মার খেয়েও পালিয়ে যাননি। সাধারণ মানুষ তাতে ভয় পেল না।

স্বাধীন দেশে নিজেদের ভাষা ব্যবহারের অধিকার সবার আছে। নিজেদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে দেওয়া যাবে না। তাই সত্যাগ্রহীরা পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করেও বলে যাচ্ছিল, “জান দেব, জবান দেব না, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।” কিন্তু শান্তিপ্রিয় সত্যাগ্রহীদের উপর ঠিক বেলা দু’টো নাগাদ পুলিশ গুলিচালাতে শুরু করে। স্টেশনে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা স্টেশন ঘিরে রাখে। এদিকে উত্তেজিত তরুণ ছেলে-মেয়েরা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিতে রাজি। এমন পরিস্থিতিতেও কেউ স্টেশন ছেড়ে পালাননি। বরং স্টেশনে ভিড় বেড়েই যাচ্ছিল।

এগারোজন শহিদ।

সত্যাগ্রহীরা গুলিবিদ্ধদের রেডক্রস হাসপালে নিয়ে যান। হাসপাতালে পৌঁছনোর পর কমলা ভট্টাচার্য (১৬), চণ্ডীচরণ সূত্রধর (২২) এবং তরণী দেবনাথকে (২১) মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। তার পর কানাইলাল নিয়োগী (৩৭), হীতেশ বিশ্বাস (২৩), কুমুদ দাস (১৮) সুনীল দে সরকার, সত্যেন্দ্র দেব (২৪) সুকোমল পুরকায়স্থ (৩৬) ,বীরেন্দ্র সূত্রধর (২৪), শচীন্দ্র পাল (১৯) মোট ১১জন গুলিতে শহীদ হন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৮: জঙ্গির গুলিতে মন্ত্রীর মৃত্যু

পর দিন শহিদদের মরদেহ নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়। হাজার হাজার মানুষ সেদিন ভাষা শহিদদের প্রণাম জানাতে জড়ো হয়েছিলেন। চোখের জল মুছে, ফুল দিয়ে সাজিয়ে বিদায় জানানো হয়েছিল দশজন ভাই এবং এক বোনকে। ভাষা শহিদদের বলিদান ব্যর্থ হয়নি। অসম সরকার ভাষা আইন সংশোধিত করতে বাধ্য হয়। আজও বরাক উপত্যকার প্রত্যেকটি সরকারি স্কুলের মাধ্যম বাংলা। অফিস-আদালতে বাংলা ভাষাই ব্যবহৃত হয়। আর সেই সঙ্গে প্রতি বছর উনিশে মে পালন করা হয় ভাষা শহিদ দিবস।
উনিশে মে সকালবেলা বরাক উপত্যকার মানুষ শহিদবেদিতে গিয়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করেন। শিলচর শহর নতুন বৌয়ে মতো সেজে উঠে। রাস্তায় রাস্তায় আল্পনা দেওয়া হয়। সবাই নিজের বাড়ির গেটে কিংবা দোকানে মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানান। দিনভর অনুষ্ঠান চলে। আর এর মধ্য দিয়েই প্রণাম জানানো হয় মাতৃভাষাকে, মাতৃভাষার সেনানীদের। শিলচর শহরে ঘটা এই ঘটনাটি আসলে সমগ্র বাঙালিদের জানার বিষয়। আমরা আমাদের ভাষাকে ভালোবেসে প্রাণ দিতে জানি। কিন্তু আজ এতো বছর পর তো শুধু অনুষ্ঠান করলেই তো হবে না, মাতৃভাষাকে ভালোবেসে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে বাংলাভাষা চর্চা করতে। পড়তে হবে, লিখতে হবে। নিজের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। তবেই তো আমরা হতে পারব শহিদদের যোগ্য উত্তরাধিকারী।—চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content