রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

এক প্রখ্যাত কবির অতি প্রসিদ্ধ কবিতার পংক্তি প্রবাদে প্রবেশ করেছিল। “মানুষই দেবতা গড়ে তাহার কৃপার পরে করে দেবমহিমা নির্ভর।” নির্মোহভাবে ভাবলে এর চেয়ে স্পষ্টতর কিছু হতে পারে কি? বেশ বোঝা যায়, অন্তর্নিহিত পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভাবটাকে। বৈদিক মন্ত্রেও তো সেই তত্ত্ব-ই আছে বৈকী।

সৃষ্টি ও স্রষ্টা, সে যে বা যারাই হোক না কেন, পারস্পরিক এক বন্ধনে তাদের নিবদ্ধ থাকতে হয়। এ কথা বলা হল, তার এই যে, মাসজুড়ে নানা জাতীয় আর আন্তর্জাতিক দিবস, মানুষ পালন করতে চায় বলেই সাজিয়ে রাখে। এতে দিবসের নাকি বিষয়ের নাকি মানুষেরই গরিমা বেড়ে ওঠে, তা বোঝা ভার, তবে ভগবানের সব দিন সমান হলেও মানুষের তা নয়, আর সচেতনতার পাঠে একথাও মনে আসে যে, অজ্ঞানলব্ধ অচেতন অবজ্ঞাই জীবের আদি অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্য।
তবে সর্বত্র তা গাণিতিক নিয়মেই বলবত্ হবে এমনটা নয়, তাই তাদের স্বরূপ বুঝতে একটু সমস্যা হয় বৈকী। এই যেমন জুন মাসের পনেরো তারিখে বিশ্ব হাওয়া দিবস অথবা আঠারোতে ইন্টারন্যাশনাল পিকনিক ডে কিংবা একুশে জুন বিশ্ব সঙ্গীত দিবসের তাৎপর্য ঠিক কী? উদযাপন? সচেতনতা? নাকি দুটোই? অথবা অন্যতর কিছু?

এই যেমন বিশ্ব হাওয়া দিবস। এর তাৎপর্য নাকি বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব ও অপ্রচলিত শক্তির অনুধ্যান। বায়ুশক্তির সুতীব্র শক্তি কেমন হতে পারে সে কথা সর্ববিদিত। পবনদেব ও তাঁর পুত্রগণের কথা কে না জানে!! কিন্তু হাওয়ার শক্তি যে চারপাশের অনুভূতিবেদ্য পাগলা হাওয়া কী মাতাল সমীরণের বায়ুতেই আটকে থাকে কেবল, তা নয় মোটেই।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪১: দুধ না খেলে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

হাওয়া খাওয়া নিয়ে যাবতীয় বাদবিসম্বাদ পার করে চারপাশের ভালো হাওয়া, খারাপ হাওয়া, যুগের হাওয়া, উল্টে দেওয়ার, পাল্টে দেওয়ার হাওয়ার তালে তালে “হাওয়া করে” দেওয়ার কিংবা স্বয়ং “হাওয়া হয়ে যাওয়ার” ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কেউ ভাবে, কেউ হয়তো ভাবে না, কেউ হাওয়ার খবরে আস্থা রাখে তো, কেউ সেসব নিয়েও বায়বীয় আখ্যান উপাখ্যান রচনা করে। মহাপুরুষরা একেই “গ্যাস” বলেছেন…
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

এখন হাওয়া আর গ্যাসের সম্পর্কটা ঠিক কোথায় তার কথা বরং থাক। বরং, পিকনিকের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশি মজবুত। কিন্তু এমন একটা দিনে সারা বিশ্বের মানুষকে পিকনিক করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, এটা ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়। অপু দুর্গার চড়ুইভাতিতে ভাত আর বেগুনভাজা ছিল। তবে হাত পুড়িয়ে এসব না করলে আনন্দ তখন শব্দব্রহ্মের নিয়ত প্রকাশকে আশ্রয় করে, আর বায়বীয় ও তরল ইত্যাদি মাধ্যমে প্রবেশ করে। অপু দুর্গারা এসব ভাবতে পারতো না। একালের বনভোজকরা পিকনিকে গেলে তা একেকটা খাণ্ডবদাহন-ই বটে। বিশেষত, বনজঙ্গলের এই আক্রাগণ্ডার যুগে “পিকনিক পার্টি” যেখানেই যায়, সেখানেই অরণ্যের রহস্য আর জঙ্গলের রাজত্ব নেমে আসে। এ কথা কম কী!!
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

তবে এখান থেকে বোঝা যায়, হাওয়ার সঙ্গে পিকনিকের একটা নৈকট্য বেশ আছে। কারণ, আমাদের এখানে হাওয়া খাওয়া যায়, আর পিকনিকে খাদ্যটাই মুখ্য। তবে, পিকনিক মানেই হাওয়া খাওয়া কি না, আর, হাওয়া খাওয়াটাই পিকনিক কীনা এ নিয়ে আর এগোনোর দরকার নেই বিশেষ। বায়ুসেবন নিয়ে ভ্রমণপ্রিয়দের বিশেষ আধিক্যতা আছে। অতীতে কিংবা এখনও, হাওয়া বদল আরোগ্যের দ্যোতক। তবে, নানাভাবে দেখতে চাইলেও, বিশ্ব বনভোজন দিবসের কর্তারা যদি একটু বলে দেন যে, বায়ুকেই সম্বল করে বনভোজনে নামলে তা অনুমোদিত হবে কিনা। মানে একদম ফ্রি এয়ারের ব্যাপার, চাঁদা নেই, ব্যস্ততা নেই, শুধু পিকনিক পার্টি আর হু হু হাওয়া! পেট ভরবে?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

দেখা যাচ্ছে, খাওয়া আর গাওয়া এই দুটো ক্রিয়ার সঙ্গে ক্রিয়া না হয়েও হাওয়ার বেশ সৌহার্দ্যের সম্পর্ক। এই যেমন হাওয়াটা খাওয়া যায়, আবার সেটা নিয়ে গাওয়াও যায়। খাওয়ার ব্যাপারটা হাওয়া করে দিতেই বা কতক্ষণ? যাদের খাবার নেই, গানটাই আছে শুধু, তাদের শেষ সম্বলটাও হাওয়া করে দেবেন না প্লিজ!

এসব ভাবতে ভাবতে বিশ্ব সঙ্গীত দিবসের সঙ্গে হাওয়া আর খাওয়ার যোগাযোগ খুঁজছেন? বেশি কিছু বলার জায়গা নেই, ক’টা গানের লাইন…গুপির গুপ্তখাতা থেকে…
“দুঃখ কিসে কিসে যায়?
দুঃখ কিসে যায়?
প্রসাদেতে বন্দী রওয়া
বড় দায়।
একবার ত্যাজিয়া সোনার গদি
রাজা মাঠে নেমে যদি
হাওয়া খায়!
তবে রাজা শান্তি পায়।”
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content