অলঙ্করণ: লেখক।
দুধ না খেলে, হবে না ভালো ছেলে। তাই বোধহয় আন্তর্জাতিক দুগ্ধ দিবস। পয়লা জুন। দুধ সুষম খাদ্য। শিশু থেকে বৃদ্ধ, দুধ খায়। অথবা, পান করে। দুধ খেতে ভালো লাগুক বা না-ই লাগুক, স্তন্যপায়ী প্রাণী-মাত্রেই দুধ খেয়েই জীবন শুরু করে। তবে মানুষের সঙ্গে তাদের একটা পার্থক্য আছে। অন্যান্যরা স্বজাতির মধ্যেই আটকে থাকে। ব্যতিক্রম আছে। হরিণশাবক মানুষ মায়ের, বিড়ালছানা কুকুরের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে এমনটাতো দেখা যাচ্ছেই, তবে মানুষ আপন থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ানোয় বিশ্বাসী। তাই বাল্যে মাতৃদুগ্ধ, আর পরবর্তীকালে গোদুগ্ধ, ছাগদুগ্ধ বা অন্যান্য কিছু পান করে আর বাঘের দুধ পানের স্বপ্ন দেখে।
এদিকে বাঘ, সিংগি, হাতির দল ছোটবেলাতেই মায়ের দুধে পুষ্ট হয়ে পরে আর খাদ্যতালিকায় তাকে রাখে না। মানুষ তেমনটা নয়। মায়ের দুধ পানের সময় অতিক্রান্ত হলে তারা মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধ বলে, তাকে অন্য ভাষার অম্লে কাটিয়ে ছানায় পরিণত করে। পয়সা ফেললেই বাঘের দুধ মিলতে পারে এমন ভরসা থেকে জাগতিক সম্পদ ও জগত্টাকেই তারা হিপ পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে এমন আত্মবিশ্বাস মানুষেরই সাজে। তাই বিড়াল দুধ চুরি করলে তাদের গোসা, কিন্তু দরকারে বাছুরের দুধ মেরে নিজের উদরপূর্তিতে দোষের কিছু নেই।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪০: সকালবেলা সাইকেল চড়ে
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার
কিন্তু ব্যাপার হল এটাই যে, দুধটা তাদের কারও নয়। বেচারা গরুর। মানুষ এই যে একচেটিয়া ক্ষমতার কায়েমে বিশ্বাস করে অন্তর থেকে, আর সেটাই করতে চায় প্রাণপণে, মাঝে লজ্জা-ঘেন্না-ভয়ের একটা সূক্ষ্ম আবরণ রেখে, আজন্ম আর আমরণ দুধে-ভাতে থাকার আকুলতা তারা পোষণ করে চলে। অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের এমন বোধ আছে কীনা কৌতূহল হয়। সেই শ্বেতধবল দুধ মানুষের জীবনে একটা পবিত্র পূর্ণতার চিহ্ন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা
পুরাণে সাত সাগরের কোনওটা দুধে ভরা এমন ধারণার উল্টোপিটেই রূপকথার দুধসাগরে ঢেউ ওঠে। অন্যান্য রাজশিশুরা যখন দুধ খেত অশ্বত্থামা পেতো পিটুলিগোলা। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটে না। পিটুলির তো কথাই নেই। কোথায় তাদের পার্থক্য আর সেটা বজায় রাখলে ঠিক কী কী হতে পারে তা বোঝার জন্য একটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-ই যথেষ্ট তো? নেপোর দৈ মারা আর সুবিধাভোগীর ক্ষীর খেয়ে যাওয়ার মূলেও সেই দুধ। সাংস্কৃতিক বোধে তার উথলে ওঠার অপেক্ষা, প্রাচীন ভাষায় দুধ আর জল পয়ঃ নামেই অভিন্নপ্রায়। পয়ঃ দুধের সংযোজনেই পায়স পরমান্ন হয়ে ওঠে। তাই দুধ না খেলে ‘ভালো ছেলে’ বা গুড বয় হওয়ার আশা কম।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
সুকুমার রায় অমৃতের পুত্র খোকা খুকুদের মধ্যে জগতের যতো ধুলো কাদা ময়লামাখা ছেলেদের দেখেছেন। দুধ ননী ছানা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি মেয়েদের-ও দেখেছেন। তা সে যাই হোক, বালগোপালের ননীচোরা হওয়ার মূলেও তো সেই দুধ। দুরন্ত গোপবালকের যতো দুষ্টুমি আর জগত্পালক হয়ে ওঠার থিওরিতেও তো সেই “ভালো ছেলে”র আত্মপরিচয়। আর দুধের দাম? মায়ের হলে, অমূল্য। আর বাছুরের মায়ের হলে… একপো দুধ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে হাত ঘুরে ঘুরে আকাঙ্ক্ষা, ত্যাগ আর বেঁধে বেঁধে থাকার গল্প বলে ওঠে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।