রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

আগস্ট মাস এদেশে ও আন্তর্জাতিক স্তরেও বিপুল ঘটনাবহুল। এ মাসেই কোথাও ধ্বংসের ভয়াল স্মৃতি, কোথাও বা যুগসঞ্চিত জাড্য থেকে ফিনিক্স হয়ে উড়েছিল কেউ কেউ। গামী দশ তারিখ আন্তর্জাতিক সিংহ দিবস। কথায় বলে সিং নেই, তবু নাম তার সিংহ। তবে ভারতীয় সিংহের বীর্য শৌর্য নিয়ে নানা মিথ আখ্যান উপাখ্যান আছে। সব মিলিয়ে পুরুষকারের প্রতীক যেন সিংহ।
অশোকস্তম্ভে বুঝি জাতির সেই অভিজ্ঞান মুদ্রিত আছে। সে যাই হোক, গল্পে আছে একবার এক সিংহের নাকে ইঁদুর ঢুকে বিষম গোলযোগ ঘটিয়েছিল। আরেকবার, সিংহ কুয়োর জলে নিজের প্রতিচ্ছায়া দেখে কী করেছিল তা কারুর জানতে বাকি নেই। মুশকিল এই যে, সিংহের প্রজ্ঞা প্রকৃত, নাকি তার অহংবোধ তা বোঝা সহজ নয়। সিংহ কখনও ধাবমান পশুদের পৃথিবী ছেড়ে পালানোর দিবাস্বপ্নকে রোধ করে জ্ঞানচক্ষু জাগিয়ে তুলছে, কখনও দেখা যায় সিংহশিশু আরেক মানবশিশুর হস্তগত হয়ে রীতিমতো অত্যাচারিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৭: ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

সিংহ পশুরাজ, তার মধ্যে রাজসিক আভিজাত্যময় ব্যক্তিত্ব সব থেকে প্রবল, রজোগুণের মূলে যে উদ্যম, তা সিংহের আছে। কিন্তু রজোগুণের সীমাবদ্ধতা হল যে আত্মকেন্দ্রিক অহমিকা, তাও বুঝি রাজা আর সিংহের রাজকীয় হালচাল, ব্যক্তিত্বের উচ্চকিত নির্ঘোষ আর আগ্রাসনের আত্মগৌরবে প্রচারিত। এতকথায় যেটা মূল, সেটা হল এই যে, সিংহের এই মূল্যায়ন মানুষের চোখে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

মানবধর্মের অনুকূল আর প্রতিকূলে, ব্যক্তিপুজোর সঙ্গে মিশিয়েই সিংহের এই নির্মাণ। মানুষ সিংহকে ঠিক কেমন চোখে দেখে তা সিংহের জানা আছে কীনা বলা কঠিন তবে মানুষের জগতে সিংহের কদর অন্যরকম। বাঘ আর সিংহকে ঠিক পশু নয়, বরং জীবনের নানা দিক আর ভাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেই মানুষ শিখেছে। দুর্গার পায়ের নিচে থাকা সিংহ রজোগুণের শক্তিশালী উচ্ছ্বাসের প্রতীক, মানুষের পশুত্ববিজয়ের প্রতীক, শক্তির প্রতীক। সেই পথ ধরে বুদ্ধদেব শাক্যসিংহ।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

শাস্ত্রে নানাবিধ ন্যায়ের মধ্যে সিংহাবলোকন পাণিনির ব্যাকরণে সূত্রের শৃঙ্খলার পারম্পর্য নির্মাণ করছে। সিংহের পিছন ফিরে তাকানোর মধ্যে একরকম মহানায়কীয় চলন আছে বটে। সিংহের রূপে এক সাবলীল সম্পূর্ণতা আছে। সিংহের কেশর, থাবা, ওই চলাফেরা, হুহুঙ্কার মানুষের হতে চাওয়া, ছুঁতে চাওয়ার এক অলৌকিক ক্ষেত্র রচনা করে। মূলে থাকে বীরভোগ্যার নীতি, দুর্দমনীয় ঘাতক হিংসার স্বীকৃতি আর রূপায়ণ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৬: বার্নার্ড শ ও শার্লটি —তবে কেন মিছে ভালোবাসা/২

তবে কথা হল এই যে, সিংহের এই পুরুষালী বৈভবে সিংহীর কেশরহীন অস্তিত্ব কোথায়? মানবতার কথা উঠলে নর-নারীর প্রভেদের কথা আসে না, কিন্তু সিংহের প্রতীক কেবলমাত্র পুরুষ সিংহকে কেন্দ্র করেই যেন, তা নারীর বিক্রমেও হয়তো প্রযোজ্য হতেই পারে, তবে “সিংহের মতো” বললে এক ভীষণ পুরুষকার-ই শেষ সত্য। তবে সিংহীই শিকার করে আনলে আয়েস করার ফাঁকে সিংহ উঠে বসে খাদ্যগ্রহণ করে তার পৌরুষকে চরিতার্থ করে, এমনটাও সত্য বটে বৈকি! পুরুষ সিংহ এজন্যই। তবে দেবীর সাহচর্যেও সিংহকে আমরা পাই, বাঁশ-কাঠ-খড়-মাটির স্তরে স্তরে সিংহ হয়ে উঠে লাভ হয় না ততক্ষণ, যতক্ষণ না শক্তি জেগে ওঠে তার ওপরে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content