শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

সমবেত ঋষিগণ বললেন, হে মহাত্মন্, কলিকালে ভূলোকে ভোট নামক এক উৎসবের কথা আমরা শুনেছি। এই উৎসব কীদৃশ তা নিয়ে জানতে আমরা নিতান্তই উৎসুক, আমাদের আলোকিত করুন। এই উৎসব কি অকালবোধনের তুল্য? কারা এই উৎসবে অংশ নেন?
বৈশম্পায়ন হেসে বললেন, পুরাকালে দেবতাদের সারভূত অংশ নিয়ে রাজার মহান আবির্ভাব ঘটেছিল। তো রাজাকে যাতে প্রজারা মেনে চলে তার জন্য দণ্ডনীতির ব্যবস্থা। তারপর সেই সব যুগ পার করে গণতন্ত্র, আর গণতন্ত্রের উৎসব হল ভোট। নির্বাচন। রাজাকে নির্বাচন করার নানা প্রসঙ্গ ইতিহাসে আছে, ধর্মশাস্ত্রকারেরা সচেতন করেছেন নানাভাবে, কোনওভাবে পদস্খলন হলে রাজার সিংহাসন টলমল করবে, প্রজারা ডিম্ব করবে। অনেকটা দুই চাকার ওপর সাতমহলা বাড়ি, বাড়াবাড়ি হলে সেই গাড়ি কিংবা বাড়ি ধসে পড়তে চায়, দুলতে থাকে ভয়ানক নড়বড়ে সাঁকোর মতো।
কৌটিল্যের রাজনীতি থেকে কৃষ্ণের কূটনীতি অথবা ইতিহাসের আদিগন্ত ধরে বয়ে চলা কৌশলী রণনীতি, পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রক্তের ছাপ, অসির ঝনঝন, নীতির চলাচল, যুক্তির শাণিত লড়াই অথবা…অনেক অনেক কিছু নিয়েই একটা তাত্ত্বিক দুনিয়া।

এই তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে দুনিয়াটা বেশ আছে। তত্ত্ব আছে, তার উপযুক্ত প্রয়োগ-ও আছে, এমন উদাহরণ জগতে কম নয়, সেক্ষেত্রে ঘোড়াকে পক্ষিরাজ বলার, শিব গড়তে বাঁদর হয়ে ওঠার আশা বা আশঙ্কা থাকে না, জিলিপিকে জিলিপির মতোই পাওয়ার কথা থাকে আর পাওয়াও যায়, কিলবিলে কেন্নো হয়ে ফণা তোলে না সে। আবার অনেক তত্ত্বের প্রয়োগ নেই, অনেক প্রয়োগের তত্ত্ব নেই। ধরো….

ঋষি জমদগ্নি বললেন, “কিন্তু মহাত্মন্, আমরা তো ভোটোৎসবের কথা শুনতে চাই, আপনি তাই-ই বলুন না”
বৈশম্পায়ন বললেন, “আহা, শাস্ত্রে অধিকার না থাকলে ব্যুৎপত্তি জন্মে না। আমি রাজনীতিক নই, এই উৎসবের প্রথা কীদৃশ তা আমার অধিগত নয়।”
ঋষিগণ হই হই করে শশব্যস্ত হয়ে বিরোধ করে বললেন, আপনি সর্বজ্ঞ, আপনার অবিদিত কী-ই বা আছে। আমাদের নিবেদন পূর্ণ করুন, এই উৎসবের স্বরূপ জ্ঞাপন করুন।
আরও পড়ুন:

হে নূতন…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

বৈশম্পায়ন হেসে বললেন, ঠিকাছে, ওহে বাপু, তোমরা এতোই নাছোড় যখন, তখন শ্রবণ করো। ভাবীকালে ভোট একটি যজ্ঞ হবে, তা একাহ থেকে অষ্টাহ হতেই পারে, এখানে একটি কক্ষে যজ্ঞবেদী স্থাপন করা হবে। কক্ষ টিকে কলিতে ‘বুথ’ এই পরিভাষায় জানতে হবে। ওই যজ্ঞবেদী নানারূপ, এর জন্য পৃথক শূল্বসূত্র থাকবে। তাকে প্রিসাইডিংয়ের ম্যানুয়াল বলা হবে। এটিই এই উৎসবের পুরোহিতের পঞ্জিকা ও বেদ। মূলত, এই যজ্ঞবেদীর ক’টি ভাগ হল কন্ট্রোল ইউনিট, ব্যালট ইউনিট ও ভিভিপ্যাট। তবে যজ্ঞ চলাকালীন যজ্ঞবেদী পরিবর্তন করতে হতে পারে বিনা নোটিশে, এটাই কলির মাহাত্ম্য।

বৈদিকগণ এই রীতিতে অভিজ্ঞ নন, একথা জানলে তাঁরা যজ্ঞে অবতীর্ণ হতেন না। তবে এখানেও একটি পুরোহিতের দল থাকে, তাঁদের প্রধান পুরোহিত হলেন প্রিসাইডিং। এঁর দায়িত্ব ওই দ্বিদিবসীয় সত্রের দেখাশোনা বা পৌরোহিত্য, যাদৃশ গোষ্ঠে গোষ্ঠপালগণ করে থাকেন। ইনি এই দিনে পুরো হিট করেন। তাঁকেই পোয়াটাক উত্তুঙ্গ মাহাত্ম্য আর কয়েক ছটাক কর্মভারে মিশিয়ে অদৃশ্য কটাহে চাপিয়ে ওই দিন হিট দেওয়া হয়, তাই তিনি এমন নাম গ্রহণ করেন। এঁর ঊর্ধ্বতন কর্তা সেক্টর নামে ত্রিশঙ্কু হয়ে বন্দিত হবেন, তিনি নব্য সাংখ্যের প্রণেতা হয়ে পুরুষতুল্য হবেন। প্রকৃতি হবেন এই প্রিসাইডিং, সাহেবি নামে তোমরা চমৎকৃত হতে পারো, ইনি প্রকৃতপক্ষে শপিং মলের ফ্লোর ম্যানেজার সদৃশ, সাইড ধরে ধরে, সাইড দিয়ে দিয়ে কখনও ফুটপথে কখনও রাজপথে জগিং করে করে হাজার কিলোমিটারের দ্রুতধাবন অলৌকিক উপায়ে সম্পন্ন করাই এঁর কাজ।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

তবে মনে রাখতে হবে, মহামানবের সাগরতীরে এই মহাযজ্ঞ আয়োজিত হলেও যজ্ঞভাক্ ও যজমানগণ সকলেই নরবেশী মেজ সেজ বড় ছোট দেবতা। এই যজ্ঞে সারিবদ্ধ হয়ে সাকার দেব-দেবীগণ আসেন দেখেন ও জয় করেন, সেকথা আমার আলোচ্য নয়। আমি যাজ্ঞিকগণের বিষয়ে কিছু অবহিত আছি। এঁরা যজ্ঞে যে হবিঃ দান করবেন কলিকালে তাকে ফর্ম বলে। যে দর্বি দিয়ে তাঁরা আহুতি দেন তাকে কলম বলে। দেবগণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ছাপ অথবা স্বাক্ষর করে তাঁদের আগমন সূচিত করে অবশেষে নানা লীলা সহকারে ভোট দেন। বৈদিক যজ্ঞে দেবগণের আহুতিদানের প্রথা ছিল না। তাঁরা অবাধে কৃপাবর্ষণ করতেন। নব্যকলিতে এই যজ্ঞে দেবগণ যে কৃপা বর্ষণ করবেন তাকে নানা ছাঁকনিতে মাপার ব্যবস্থা আছে, কৃপার নানা প্রভেদ আছে, যেমন ইডিসি, চ্যালেঞ্জ, টেন্ডার ইত্যাদি। এসব পূর্ণ করেই দেবগণ কৃপা তথা আহুতিদানে যোগ্য হয়ে লীলাপ্রদর্শন করেন। সেই লীলা যাঁরা চাক্ষুষ করেন তাঁদের জীবন ও মৃত্যু সার্থক হয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

বস্তুত, তাকে জেনেই মৃত্যুকে অতিক্রম করতে হয়, না জেনে কোনও শর্টকাট নেই, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়। তবে বাপু, আমার মুখ থেকে জেনে তোমরা সেই পরনির্বৃতির স্বাদ পাবে না, সেই স্বাদ পেতে গেলে কলিতে প্রিসাইডিং হয়ে দিবসব্যাপী সেই দৃশ্যকাব্যের সম্ভোগ করতে হবে। তবে বুদ্ধ যেমন খালি পেটে বাজি মাত করতে পারেননি, এঁরাও তাদৃশ। শুধু পার্থক্য এই যে, সেখানে অনেকসময় সুজাতাদের খুঁজে আনতে হয়, তাঁদের ডালভাতের পায়স রন্ধন করিয়ে কখনও বা খিস্তি ও কলহের অনুপানে মিশ্রিত করে গ্রহণ করতে হয়। যজ্ঞশালা যদি বৃহৎ হয় তো, দেবগণ উপদেবতুল্য হন। যথাযথ খাদ্যাদি অপ্রতুল হলে গড়াগড়ি ও গালাগালি খাওয়ার প্রভূত আয়োজন থাকে, কিন্তু আদিবৈদিকযুগের অপ্রতুল ও মহান অন্নচিন্তা চমত্কারা হয়ে ওঠে।

এ এমন জগৎ, এমন কালকক্ষ ও কক্ষাধিপতির ওয়ান্ডারল্যান্ড যে সেখানে ভোগ ও ত্যাগ সমার্থক। ভোগ করে করে ত্যাগের তত্ত্বের প্রয়োগ সেখানে শূন্যগর্ভ। নিন্দুকগণ একে দুর্ভোগ বলবেন। ভোগীগণ এখানে ভুক্তভোগী হবেন। তবে এসব নিন্দাবচন সারসত্য নয়, আসল কথা হল এখানে ভোগকে ত্যাগ ও ত্যাগকে ভোগ বলেই মনে হবে। পুরাকালে ভূতের স্কন্ধ দখলের কথা শোনা যায়। কলিকালে বুথদখল বলে কিছু একটা ব্যায়োগের আভাস আমি পেয়েছি, তবে সম্যক অবগত নই। দেব শঙ্কর বলতে পারবেন। শুনেছি নররূপী দেবগণ পার্থিবলোকে এই লীলা দেখান। তবে মনুষ্য নিতান্তই অকৃতঘ্ন বলে এসব নিন্দাবাদ করে।
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

একথা সত্য, বালকগণের ক্রীড়াতেও একদল ব্যাট ছাড়তে চায় না। আরেকদল ব্যাট করবে এই আশায় বল করে যায়, আরেকদল বল কুড়িয়ে যায় শুভক্ষণে বল করতে পারবে ভেবে। একে “আশার আশা ভবের আশা” বলা হবে। নরগণ বীরভোগ্যা বসুন্ধরার তত্ত্বে আস্থা স্থাপন করে থাকে। তবে জগতে বীরগণ মনুষ্যরূপী এই তাঁদের বিশ্বাস। কিন্তু শেষে সেই কালকক্ষের একটি প্রচ্ছন্ন ঘুলঘুলি থেকে অগণিত মধুমক্ষিকা বহির্গত হয়ে আগত দেবতা, সাংখ্যমতে আবাহনপটু যাজ্ঞিক ও যজ্ঞকুণ্ডলী গ্রাস করে ঘূর্ণিপাক খেতে থাকলে কোন রসের সঞ্চার হতে পারে অবগত আছো? তোমাদের নবরস ও ষড়-রসের সমাহারের অধিক সে রস। তোমরা বাপু এই ভেবেই আনন্দ পাও যে, মধুমক্ষিকার নিশানা কেবল শকুন্তলার ওষ্ঠবিম্বাধর, আর কিছুই না। নিন্দুকগণ একে তীব্র ব্যঞ্জনা ভাববেন। কিন্তু এ একান্তই অভিধেয়।

মস্তকে অগ্নি নিয়ে জলের জন্য আকুলতা আর ক্ষুধার্তের কাছে ঝলসানো রুটি যতটা বাস্তব এই মধুবিদ্যাও তাদৃশ রহস্যহীন। কবিগণ জগতকে আনন্দযজ্ঞ বলেছেন। বিষ্ণুর তৃতীয় পদক্ষেপে মধুর উত্স কীভাবে, তা এতদিন অজ্ঞাত ছিল, এই তত্ত্ব কলির ঐ কালকক্ষের যজ্ঞশালার মর্মে আগুন জ্বালিয়ে নিতান্তই সত্যে পরিণত হতে পারে, শুধু নির্বাচনযন্ত্রের তীক্ষ্ণ বংশীধ্বনির অপেক্ষা, উন্মত্ত মধুমক্ষিকার গণনাট্যে অভিভূত হয়ে কলিকালে তোমরা দলে দলে নীলকণ্ঠ হয়ে আনন্দতাণ্ডব করো এই আশীর্বাদ করি।
* লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content