ছবি: প্রতীকী।
ভর্তৃহরি বলছেন, যে মানুষ উত্তম, সে কার্যের সমাপ্তি না করে থামে না। যে মধ্যম, সে আরব্ধ কর্মে বাধা পেয়ে ত্যাগ করে। যে অধম, সে তো বাধার ভয়ে ভীত হয়ে কার্যের সূত্রপাত ঘটিয়ে উঠতে পারে না।
চারপাশে যে বিপুল কর্মস্রোত, সকল কর্মই কি সফল? সকল কর্মই কি যথার্থ? সকল কর্মই কি অবশ্যম্ভাবী? তবুও কর্ম করে করে চিত্তশুদ্ধির পথ ধরেই আসে সেই প্রমা। অবিদ্যার অনুষ্ঠানে মৃত্যু অতিক্রম করে বিদ্যা বা পরা জ্ঞানে অমৃতলাভ, এই প্রজ্ঞাই তো অর্জন করেছে মানুষ তার যুগ যুগান্ত যুগান্তরের সাধনায়!
“আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার, ওগো প্রিয়/ বড়ো উতলা আজ পরান আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও?”
চারপাশে যে বিপুল কর্মস্রোত, সকল কর্মই কি সফল? সকল কর্মই কি যথার্থ? সকল কর্মই কি অবশ্যম্ভাবী? তবুও কর্ম করে করে চিত্তশুদ্ধির পথ ধরেই আসে সেই প্রমা। অবিদ্যার অনুষ্ঠানে মৃত্যু অতিক্রম করে বিদ্যা বা পরা জ্ঞানে অমৃতলাভ, এই প্রজ্ঞাই তো অর্জন করেছে মানুষ তার যুগ যুগান্ত যুগান্তরের সাধনায়!
“আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার, ওগো প্রিয়/ বড়ো উতলা আজ পরান আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও?”
তবুও কীসের ভয় আর গ্লানি আবিষ্ট করে? যে মানুষ রাজপথের আবিশ্রান্ত শকটভারের মহাগতির মাঝে নিরুপায়, সেও কি পথ অতিক্রম করে ওপারের ওই অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না? নিশ্চেষ্ট হয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেই বুঝি পথ আপনিই ধরা দেয়? পথের প্রাপ্তিতে সুখ নাকি বিস্মরণে? সংসারগহনেই সুখ নাকি নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে চিরসখার চিরসান্নিধ্যে?
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৭: যাহা শুভ, যাহা ধ্রুব ন্যায়, তাহাতে জীবন কর দান
সেই মহিসম্মিলনের ধর্মক্ষেত্রে তখন এক মুহ্যমান বীর অবাধ্য হৃদয় আর বুদ্ধির মাঝে চলে আসা ঘনবর্ষার সজল মেঘভারের ওপারে স্বতোজ্জ্বল ভাস্বর দীপ্যমান দিব্য অন্তর্জ্যোতিকে দেখতে চাইছিলেন। ভোগাশ্রয়, সকল ন্যায় অন্যায় সত্য মিথ্যার সাক্ষাৎ ভোক্তা দেহরথের পঞ্চাশ্ব পঞ্চেন্দ্রিয়ের আকর্ষণে দেহ ছুটে চলেছে। চার্বাক দেহাতিরিক্ত কোনও অস্তিত্ব মানেন না, দেহের পরম সুখেই তাঁর অভীষ্টসাধন। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের অভীষ্টসিদ্ধিই কি চরম ও পরম? রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শসুখের অভ্যাসেই কি জাগতিক কর্মের সম্পাদন ঘটে যায়?
“তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো/ এই হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়”
“তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো/ এই হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়”
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়
দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা
জগৎ সুখ-দুঃখ-মোহের অধীন। দুঃখ ও সুখ এখানে অবিমিশ্র নয়। দুঃখ ব্যতিরিক্ত সুখ লাভ-ও এখানে আকাশকুসুম। কিন্তু যা দুঃখ বলে মনে হয়, তা কি যথার্থ? যা সুখ বলে বলে মনে তাও কি যথার্থ?
সেই মহিসম্মিলনের ধর্মক্ষেত্রে এক যুগপুরুষ তখন বলছেন, ভেবে দেখো তো, দেহ কি ধ্রুব? তার আকার প্রকার-ও কি অচঞ্চল নির্বিকার? না তো? জীবননদের নীররাশি স্থির নয় যেমন, তেমনই তো শৈশব কৌমার যৌবন জরার আগমন দেহে শাশ্বত সত্য, দেহ নিত্য নয়, তবে তার বিনাশের ভয়ে ভীত কেন, কেন কর্মের উদ্যোগে, রূপায়ণে সম্পাদনে এতো সংশয়? যে দেহে বিনাশ-ই একমাত্র সত্য, সেই দেহের স্বরূপ ও জীবধর্মের অনুষ্ঠানের বাইরেও এক বৃহত্তর সত্য আছে।
সেই মহিসম্মিলনের ধর্মক্ষেত্রে এক যুগপুরুষ তখন বলছেন, ভেবে দেখো তো, দেহ কি ধ্রুব? তার আকার প্রকার-ও কি অচঞ্চল নির্বিকার? না তো? জীবননদের নীররাশি স্থির নয় যেমন, তেমনই তো শৈশব কৌমার যৌবন জরার আগমন দেহে শাশ্বত সত্য, দেহ নিত্য নয়, তবে তার বিনাশের ভয়ে ভীত কেন, কেন কর্মের উদ্যোগে, রূপায়ণে সম্পাদনে এতো সংশয়? যে দেহে বিনাশ-ই একমাত্র সত্য, সেই দেহের স্বরূপ ও জীবধর্মের অনুষ্ঠানের বাইরেও এক বৃহত্তর সত্য আছে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬০: শ্রীমার রামেশ্বরম যাত্রা
মৃত্যু জীবনের এক স্বাভাবিক পরিণতিমাত্র। ছিন্নবাস ত্যাগ করে নববসন ধারণ যেমন লৌকিক সত্য, এও তদতিরিক্ত কিছু নয়। দেহ, জন্ম, মৃত্যু, জীবন ইত্যাদির চেয়েও বড় সত্য হল কর্ম। ধর্মসাধনের পথে শরীরের সুস্থিতি-ও সত্য, তবে কর্মমুখর জীবনেই তার তাত্পর্য অবিসংবাদী হয়। নিরলস কর্মী কর্ম সম্পাদন করেই শতায়ু হতে চেয়েছেন এই তো বৈদিকবচন। তবে সেই বিনাশশীল দেহ কখনোই কর্মের তুলনায় মহত্তর নয়। দেহ নয়, অবিনাশী কর্ম-ই জগতে স্থিত হয়। যাঁরা ধীমান, তাঁরা দেহীর দেহান্তকে দেহান্তরপ্রাপ্তি বলেই উপলব্ধি করে মুহ্যমান হন না।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
তাই, আত্মবিদ হও। নিজেকে জানো। অণুপরিমাণ থেকে মহান্ বিভুকে জানো, বেদ্য থেকে বেদ্যান্তরকে জেনে অনির্বেদ্য থেকে নির্বেদ্যকে জানো, প্রেয়ঃ থেকে শ্রেয়ঃকে জেনে সকল কর্মের প্রেরণা, সকল অনন্ত-আনন্দরূপ নিঃশ্রেয়স্ বাঙ্মনের অতীত, অন্তর্গত নিবিড়ঘন তমিস্রায় নিত্য ধ্রুবতারকা সেই অন্তর্যামীকে সংসারের সুখে দুখে হৃদয়ে বরণ করো, তাঁর সুধাধারায় অভিসিঞ্চিত হয়ে, আত্মদীপ হও।—চলবে।
* গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে (A Special Write Up on Shrimad Bhagwat Gita): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।