বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

সেই যে মাকড়সার গল্পটা ছিল, যে বারবার একটা গুহার অতিপিচ্ছিল প্রস্তরগাত্র থেকে পড়ে যাচ্ছিল, আর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল আবার, আবারও। এক ধ্বস্ত বীর তাকে গভীর মনোযোগে দেখছিল। অনেক অনেক চেষ্টা করে করে মাকড়সাটি সফল হল, পৌঁছল গন্তব্যে। সেই বীর উপলব্ধি করল, আশা আছে। তারপর সে ইতিহাস গড়ল বুঝি।
খেতে বসে বাধল গোল। কিছুতেই অন্ন গ্রহণ করা যায় না আর, এদিকে ক্ষুধায় কাতর, অবসন্ন শরীর। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি এক শিক্ষা পেলেন। কৌশল বদলে চারপাশ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অতপ্ত অংশ কেটে কেটে গ্রহণ করতে লাগলেন। এ ভাবেই একসময় পৌঁছে গেলেন মধ্যবর্তী অংশে, তখন সেটি অনুষ্ণ, উপাদেয়, যা ছিল অগ্নিকুণ্ডতুল্য। রাজনীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল যেন। তারপর তিনিও ইতিহাস রচনা করলেন।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৫: আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

দ্বিধা দ্বন্দ্বজর্জর হতাশাক্ষুব্ধ বিমূঢ় মানবমন। জীবধর্ম ও স্বার্থের সংঘাত অহোরাত্র, ক্ষুদ্র দ্বেষ ও লোভের নিত্য পদপাত সেখানে। জগৎ এবং জাগতিক কর্মই কি শেষ সত্য? দ্বন্দ্ব ও বিক্ষোভে আকীর্ণ যে জগৎ ইন্দ্রিয়ের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার এক মুক্ত ক্ষেত্র, যে ইন্দ্রিয়ের অমোঘ আকর্ষণ জীবধর্মের পরিপুষ্টি ও জাগতিক অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্যও বটে, সেই জগতে শুদ্ধ ন্যায়নিষ্ঠ কর্মের অনুষ্ঠান কি কেবলই তত্ত্বগত এক চর্চা? এমন সংশয়ভারই তো আচ্ছন্ন করে রাখল আজীবন?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

কর্মণ্যেব অধিকারস্তে।

মহারথীরা দূরে প্রস্তরবত্ দণ্ডায়মান, অযুত নিযুত সেনাবল থেকে মহাসাগরের মহানাদ ভেসে আসছে। ভারতযুদ্ধ আরম্ভ হতে বুঝি আর বিলম্ব নেই। দুন্দুভি, পটহ, ভেরী, শঙ্খ, তূর্যনাদ করে যে মহাসংগ্রাম সূচিত হতে চলেছে তার ফলাফল কি হবে? কোনও পক্ষে বিজয়ীর মুকুট কোনও পক্ষেই বা নিশ্চিত মহামরণের অলক্তরাগ তা কে জানে? যদি তা জানতো তবে এরা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে পারতো? নিশ্চিত মৃত্যু জেনে এই রাজ্যলাভের, শ্রী সম্পদলাভের উন্মাদনায় অটল থাকতে পারতো? যে রাজ্য কদাপি লাভ করতে পারবে না, তার জন্য প্রাণত্যাগের মোহ তখনও কি অন্ধ করে রাখতো তাদের? যারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, তারা জয়ের উদগ্র বাসনা নিয়েই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে, সেনা প্রবৃত্ত হবে প্রভুর ভৃতি গ্রহণ করে, পরিবারের পালনের জন্য, রাজা সপার্ষদ সমিত্র প্রবৃত্ত হবে আশু রাজ্যলাভ ও প্রভূত সম্পদের লোভে, বীরধর্মের অভ্যাসে, সম্মুখসমরে হত হলে নিশ্চিত স্বর্গবাসের আকাঙ্ক্ষায়, সত্যধর্মের পরিপালনে, জিঘাংসা ও প্রতিহিংসার পরিপূরণে, স্বার্থদ্বন্দ্ব ও ক্ষুদ্র অহংবোধের উদযাপনে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

মহাকাল এদের সর্বদিক থেকে আবৃত করে রেখেছে, বিমুগ্ধ করে রেখেছে রূপ-রস-গন্ধের মায়াজালে। এদের আবির্ভাব, তিরোভাব সকলই কালের দ্বারা একান্তভাবেই গ্রস্ত, অখণ্ড মহাকাল বিপুল বেগে এদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে, কালের সেই করাল ভীষণ ও সুন্দর মূর্তির কাছে এদের খণ্ড ক্ষণিক অস্তিত্ব ও কামার্ত কর্মাবলী নিতান্তই তুচ্ছ, নগণ্য। এই সত্য জানে না বলেই এরা আজ যুদ্ধে প্রবৃত্ত, এই সত্য জানে না বলেই নিশ্চিত নিয়তি, পরিণাম এদের জ্ঞান, বোধের অতীত। মহাকালের বিপুল তরঙ্গভঙ্গের বুকে দোদুল্যমান অতি ক্ষণস্থায়ী শূন্যগর্ভ বুদবুদের মতোই এরা অদৃশ্য অঙ্গুলির চালনায় কর্মমুখর হয়ে আছে মাত্র।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

এবং, এভাবেই জগত্ চলে আসছে আদিকাল থেকে। যোগ্যতমের উদ্বর্তনের আকাঙ্ক্ষা বুকে বহন করে, এমনভাবেই পুষ্ট হয়েছে মানবের স্বাভাবিক জগত-বীক্ষণ। জীবন, মৃত্যু, অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব, বিদ্যা, অবিদ্যা, জ্ঞান, অজ্ঞান, সৃষ্টি, স্থিতি, লয় কিংবা বিচিত্র আনন্দভার তাকে বিবশ করেছে কখনও, তারপর সেখান থেকেই জেগে উঠেছে নবীন তত্ত্বৈষণা। নিশ্চিত বিনাশের ওপারে তখনই জেগে উঠেছে মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনবেদ, সে উপলব্ধি করেছে সেই অবিনাশী মহাসত্য “সম্ভবামি যুগে যুগে”।—চলবে।
* গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে (A Special Write Up on Shrimad Bhagwat Gita): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content