ছবি: প্রতীকী।
কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হতে বলে কেন? কথা আগে নাকি কাজ? কথা সকলের কাছে বশ মানে না, এ সত্য বটে। কথা, সার্থক বাকের প্রয়োগ নিয়ে শাস্ত্রে বহু উপদেশ, অনুশাসন। বাক্ আর বাণ একবার প্রযুক্ত হলে তাকে ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব, তবু বিশ্বজুড়ে বাকের অপ্রতিহত গতি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে কথার স্রোত কাটিয়ে চলাফেরা তাতে কাজের কাজ হয়, অকাজের কাজ হয়, কাজ মেটে, কাজ বাড়েও।
বাক্ নিয়ে নানা বিতণ্ডা, ভালো-মন্দ বাকের ফলেই জগৎটা চলছে, ধাক্কা খাচ্ছে, আবারও চলছে। তাহলে শব্দের, কথার প্রসঙ্গ এলেই কাজের কথা এসে পড়ে কেমন করে যেন। শব্দ আর কর্মের মধ্যে একরকম পারস্পরিক যোগ; শব্দ না করে কর্মের সম্পাদন যেমন প্রায় অসম্ভব, আবার, শুধু শব্দ করে গেলেও তাতে কাজ মেটে না।
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১২: সেইখানে যোগ তোমার সাথে
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন
শাস্ত্রে কর্মের যে এত প্রশংসা, তা তো বাক্-কে বাদ দিয়ে নয়, যজ্ঞীয় কর্মের সম্পাদন তো অভ্রান্ত মন্ত্রের সুপ্রয়োগেই। রাজা তো রাজকীয় কর্মের আগে মন্ত্রণা করবেন, শাস্ত্রের নির্দেশ। মনে মনে হলেও বিবেচনা, আলোচনা, লাখ কথা প্রশংসনীয় তো। মৈত্রেয়ীর প্রগলভতা না যাজ্ঞবল্ক্যের নিষেধবাণী, কোনটি সার্থক হয়েছে কালে কালে? যা অমৃতত্ব দেয় না তাতে কাজ কীসের? কিন্তু কথা না কাজ, কে এগিয়ে দেবে, এগিয়ে যাবে, এগিয়ে রাখবে?
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৪: আততায়ী এক, নাকি দুই?
তবুও কথা আর কাজ নিজেদের সমঝোতার সীমা ছাড়ালেই দ্বন্দ্ব, মুখটি বুজিয়ে কাজ করার নিদান। অথচ বাদী-বিবাদীর তর্কের পথ ধরেই বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠা, জগতে অনির্বচনীয়, অনির্ণেয়, অপ্রকাশ্য বুঝি কিছুই নয়। সার্থক বাকের উপযোগে তা সততঃই সম্ভব। তবুও কথার সঙ্গে কাজের বিরোধ, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হয় বটে। যে কথা কাজকে এগিয়ে দেবে, যে কথা কর্মসংশ্লিষ্ট তা নিশ্চয়ই নিন্দনীয় নয়। যে কথা কেবলই চর্বিতচর্বণ, কেবল তত্ত্বমাত্র, প্রয়োগের সঙ্গে সম্পর্কহীন, যে কথা আড়ম্বরবহুল, অবাঞ্ছিত অথবা দুষ্প্রযুক্ত, অতিরিক্ত, সারহীন, নিষ্ফল, শুষ্ক, সে কথায় কোনও কাজ নেই। জগতে এমন কথাই বেশি।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
এর সঙ্গে কাজের কোনও সম্পর্ক থাকে না। শাস্ত্র তাই পুনরুক্তি করে না, অল্পেই অতিবিস্তৃত তা, সারগর্ভ ও সংক্ষিপ্ত হতে চাওয়াতেই তার সার্থকতা। ভূমাতেই যাঁরা সুখ খোঁজেন তাঁরা কর্মী। কথা বলাটাই যখন কাজ হয়, তখন কর্ম সেটিই, সেখানে তত্ত্ব ও প্রয়োগ অভ্রান্ত, সার্থক বাকের প্রতিই একনিষ্ঠ, কর্ম-ই যখন প্রধান, তখন হাতেকলমে কাজ না হলে তাকে সার্থক বলা যাবে না।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত
কোনটি কর্ম, কোনটি অকর্ম তা নিয়ে ধীমান মানুষ-ও সংশয়ে থাকেন। ধর্মক্ষেত্রে যিনি রথের রশি ধরেন, যিনি মুহ্যমান কিংকর্তব্যবিমূঢ়কে আলো দেখান তিনি বলবেন, কর্ম হল তা-ই যা অশুভ জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়, যা করলে পাকে পাকে পঙ্কিল আবর্তে জড়িয়ে পড়া নয়, বরং উত্তরণের পথ প্রশস্ত হয়, তা-ই কর্ম। তিনি নিষ্কাম কর্মের উপদেশ দেবেন, কিন্তু কর্মের গতি অতি গহন।
* গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে (A Special Write Up on Shrimad Bhagwat Gita): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।