সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


মুণ্ডেশ্বরী নদী।

দামোদরের প্রধান শাখা মুণ্ডেশ্বরী নদী। মধ্যযুগে রচিত একটি পৌরাণিক গ্রন্থ ‘দ্বিগ্বিজয় প্রকাশ’-এ মুণ্ডেশ্বরী নদীর নামোল্লেখ আছে। তবে পুরাণ বর্ণিত মুণ্ডেশ্বরী নদী বর্তমানের মুণ্ডেশ্বরী নদী কিনা, সেই নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। এই গ্রন্থে বর্ণিত মুণ্ডেশ্বরী খাল, বর্ধমানের রায়না থানার শ্রীরামপুর গ্রামের উত্তর দিকে অবস্থিত একটি বিরাট পুস্করিণী থেকে নির্গত হয়েছে। পরে তা কাইতি, চকভুরা, পাঁই ও বেতাবগ্রাম ইত্যাদি গ্রাম অতিক্রম করে হুগলি জেলা স্পর্শ করেছে এবং ওই জেলার নারায়ণপুর, যাদবপুর ইত্যাদি অতিক্রম করে হায়াৎপুরের কাছে দামোদরের পশ্চিমাংশে কাঁকি নামক খাতের সাথে মিলিত হয়ে এটি মুণ্ডেশ্বরী নদীতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে যা কাঁকি নদী, সেটি পূর্বে বেগুয়া হানা (খাল) নামেও পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য মুণ্ডেশ্বরী এক বিশাল জলধারায় পরিণত হয়েছে। ফলে এই নদী দামোদরের মূল শাখার থেকেও বৃহৎ, জোরালো এবং সজীব হয়ে উঠেছে এবং এই বিপুল জলরাশি শেষ পর্যন্ত রূপনারায়ণ নদীতে পতিত হয়েছে।
ভূগোলবিদ এবং নদী বিশেষজ্ঞদের গবেষণা এবং ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে, মুণ্ডেশ্বরী নদী অত্যন্ত নবীন এক নদী। হুগলি ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারের (১৯১২) মানচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুণ্ডেশ্বরী খালের পূর্বদিকে জলধারাটি রাজবলহাটের বিপরীত দিকে তিন কিমি উত্তরে দামোদরের মূল শাখায় একদা মিলিত হয়েছিল এবং দক্ষিণ দিকের ধারাটি দ্বারকেশ্বর নদে পতিত হয়। ওই সময় মুণ্ডেশ্বরী কেবলমাত্র একটি খাল, দামোদরের শাখা হিসেবে মুণ্ডেশ্বরীর কোন অস্তিত্বই ছিল না।

মুণ্ডেশ্বরী নদীর নামকরণ সম্পর্কে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। বর্ধমান জেলার কাইতি গ্রামের জমিদার কন্যার নাম ছিল মুণ্ডেশ্বরী। বিশেষ কাজে ব্যস্ত জমিদারের কাছে একদিন তাঁর কন্যা এসে বায়না ধরল, বাবার সাথে কোথাও বেড়াতে যাবে। বারবার বিরক্ত করায় জমিদার মেয়েকে বলল, “যাবি তো দীঘিতে যা”। অভিমানী মেয়ে সেই যে বাড়ি থেকে বের হলো এবং দীঘির দিকে চলে গেলো, তারপর আর মেয়ে বাড়ি ফিরল না। ঘটনাক্রমে সেই দিন থেকে ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয় এবং প্রবল বন্যায় প্লাবিত হয়ে দিঘী থেকে স্বাভাবিকভাবে একটি খালের মধ্য দিয়ে বইতে শুরু করল। লোকমুখে এই কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভালবেসে ওই অঞ্চলের মানুষ এই খালটির নাম দেয় মুণ্ডেশ্বরী। জনশ্রুতির পিছনে যে ঘটনাটি ঘটতে পারে, তা হল—ওই জমিদারকন্যা অল্প বয়সে মারা যাওয়ায় শোকসন্তপ্ত জমিদার ওই অঞ্চলের মানুষের জলকষ্ট নিবারনের জন্য ওই গ্রামের দীঘি থেকে প্রায় 8 কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লম্বালম্বি খাল খনন করেন এবং তার নাম, তাঁর কন্যার নামেই দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

আদিম মানবের পদধূলি ধন্য, রাঢ়সুন্দরী কুনুর

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

তবে কারও কারও মতে, ম্যালেরিয়া এবং বন্যার কবল থেকে স্থানীয় মানুষদের রক্ষা করার জন্য দামোদর নদ থেকে মুণ্ডেশ্বরী খাল খনন করা হয়। পরে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে দামোদরের বিধ্বংসী প্লাবনের ফলে, দামোদর তার মূল খাত ত্যা গ করে এই মুণ্ডেশ্বরী খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদীতে পতিত হয়। পরবর্তী সময়ে, এটি মুণ্ডেশ্বরী নদী নামে পরিচিতি লাভ করে।

ক্রমে ১৯১৪ সাল থেকে দামোদরের জল অনেকটা কমে গেলে মুণ্ডেশ্বরীই প্রবল হয়ে ওঠে। এছাড়াও, ১৯২১ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে প্রবল বন্যার কারণে মুণ্ডেশ্বরী ক্রমে প্রবল প্রতাপশালী হয়ে ওঠে। এই নদীটি প্রধানত দামোদর সৃষ্ট অববাহিকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তাই তার চারপাশে শস্য-শ্যামলা কৃষিজমি প্রচুর। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মূল দামোদর একটি হারিয়ে যাওয়া লুপ্ত খাতে পরিণত হবে। তবে এটা, ওই অঞ্চলের ক্ষেত্রে খুব একটি শুভকর ঘটনা হবে না। যদি কোন সময় ব্যাপক প্লাবনের সৃষ্টি হয়, তাহলে হুগলি এবং হাওড়া জেলায় যে বিপর্যয় নেমে আসবে, তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট মুণ্ডেশ্বরী হল, আসলে দামোদরের দক্ষিণ শাখা। নদীর গতিপথের পুরোটাই উর্বর এবং সমতলভূমি। তাই এই নদীতে জল থাকলেও নদী খরস্রোতা নয়। নদীর পাড়ও খুব উঁচু নয়। বর্ষার সময় দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে যে জল ছাড়া হয়, তার প্রবাহমাত্রা যদি ৭০ হাজার কিউবিক ফুট/সেকেন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে, তখনও পর্যন্ত এই নদী সেই পরিমাণ জলকে নিরাপদে বইতে পারে। কিন্তু পরিমাণ যদি তারও বেশি হয়ে থাকে, তখন নদীর দুকুল ছাপিয়ে বন্যা হয়। এই বন্যায় প্লাবিত হয় হাওড়া, পূর্ব মেদনীপুর ও হুগলি জেলার বহু অংশ।

তবে, বন্যার আরেকটি কারণ হলো নদী খাতে চড়া পড়া। একদা বেগুয়ার হানায় আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিয়ে দামোদরের আমতা চ্যানেলটি তৈরি করা হয়েছিল এবং পরে দেখা গেল, মুণ্ডেশ্বরীর বিভিন্ন জায়গাতে বালির চড়া পড়ায়, বর্তমানে আবার আমতা খাত দিয়েই বেশি জল প্রবাহিত হচ্ছে। এই চ্যানেলটি আবার মাদারিয়া নামক খালের সাথে যুক্ত। দামোদরের জল নিষ্কাশনের ব্যাপারে একদা মাদারিয়া খালের এক বিশাল গুরুত্ব ছিল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

বর্ধমান জেলার রায়না থানার মুখ থেকে দামোদর নদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একদিকে মুণ্ডেশ্বরী, অন্যদিকে দামোদরের প্রধান শাখা। ঠিক সেই মুখের কাছে কয়েক কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে বালির পাহাড়, সেই বালির পাহাড় আটকে দিচ্ছে মুণ্ডেশ্বরী নদীর স্বাভাবিক জলস্রোতকে। তাই বর্তমানে এই নদী ক্ষীণতোয়া। হুগলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেই কারণে আজ জলের অভাবে দীর্ণ। আলুর বীজ বোনার সময়, ধান চাষের মরশুমে সেখানকার চাষিরা জল কষ্টে ভুগছেন। নদীর বুক থেকে অপরিকল্পিত এবং বেআইনিভাবে বালি তুলে নেওয়া ও দীর্ঘদিন ধরে নদীকে ড্রেজ না করা এবং প্রায় পনেরো-কুড়ি বছর ধরে নদীর বুকে বালি জমতে জমতে, তা আজ পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। ফলস্বরূপ, মুণ্ডেশ্বরী নদীতে এখন সঠিক পরিমাণে জল ঢুকছে না।

নদীর নাব্যতা হ্রাসের জন্য দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় মানুষ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পাচ্ছেন না। তাই, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের জল ছাড়া এবং বর্ষার সময় ব্যতীত মুন্ডেশ্বরী নদী দিয়ে প্রায় সারা বছর কম জল প্রবাহিত হচ্ছে। আবার এই কারণের জন্যই বর্ষায়, প্রায়শই হুগলির পুড়শুড়া, হাওড়ার উদয়নারায়নপুর, আমতা বন্যার জলে ভেসে যায়। এই সকল এলাকার দু-একজন চাষি যেমন, চণ্ডীচরণ মালিক, মৃত্যুন সাঁতরা, বিশ্বজিৎ মালিক বললেন, নদীর বুকে চর এবং নদীর উৎসমুখ থেকে বালির পাহাড় যদি সরিয়ে দেওয়া হয়, মুণ্ডেশ্বরী আবার তার আগের রূপ ফিরে পাবে। রাজ্যের সেচদপ্তরকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বালি তোলা, নদীর গর্ভের নাব্য্তা বৃদ্ধি করা চালিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত নদী গবেষণাকেন্দ্রকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় মানুষ এবং যুবক-যুবতীদের নদীর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পেলে তারাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নদীর পাড়ে গাছ লাগাবে নদীকে দূষণমুক্ত রাখার চেষ্টা করবে। নদীর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত কলকারখানাগুলি থেকে বর্জিত দূষিত পদার্থ সরাসরি নদীগর্ভে না ফেলে তাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রসেস করে ফেলা দরকার, যাতে নদীর জলদূষণ না হয়। তবে আনন্দের ব্যাপার এই যে, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যেমন; সবুজমঞ্চ, মুন্ডেশ্বরী নদীর উপর খুব ভালো কাজ করছে। তারা বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র তৈরীর মাধ্যমে নদীর স্বাস্থ্যোদ্ধারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমরা জানি, ভারতবর্ষের কৃষি, ব্যবসা এবং অর্থনীতি নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাই কেবলমাত্র এই নদী নয়, পশ্চিমবঙ্গের অবহেলিত সকল ছোট এবং আলোকিত সকল বড় নদীকেও বাঁচাতে হবে, না হলে অর্থনীতির সাথে ধসে যাবে পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক জীববৈচিত্রও।

তথ্যসূত্র:
বাংলার নদ-নদী-দিলীপ কুমার চট্টোপাধ্যায়। দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৭
উইকিপিডিয়া (বাংলা)
উইকিপিডিয়া (ইংলিশ)
বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড), যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, ১৯৯৫
চট্টোপাধ্যায়, এককড়ি: বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, রেডিক্যাল ইম্প্রেশন
বাংলার নদীকথা: কল্যাণ; সাহিত্য সংসদ, প্রকাশকাল: ২০০৮
ড. উৎপল অধিকারী, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান
ড. সুনাম চট্টোপাধ্যায়, সাঁচড়া হাই স্কুল, সাঁচড়া, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান

Skip to content