বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: লেখক।

সেপ্টেম্বরের মাঝে আসেন বিশ্বকর্মা। বিশ্বকর্মা পুজো মানে আশ্বিনের শারদপ্রাতে অকাল বোধনের আগে সেমিফাইনাল। ইদানীং গণেশ পুজো একটা কোয়ার্টার ফাইনালের অবকাশ রাখে বটে, তবে বিশ্বকর্মার মেজাজ আলাদা। লোকে বলে, বিশ্বকর্মাই পরে একবার কাত্তিক হয়ে আসেন। তবে ওই মুখের মিলটুকু না ধরলেও বিশ্বকর্মা জটায়ুর ভাষায় “আপনাকে কাল্টিভেট করতে হচ্ছে মশাই”! টাইপের।
চারটে হাত, পিছনে হাতি, সঙ্গে ছেনি হাতুড়ি ঘুড়ি; বিশাল, ভারি, মাঝারি, ছোট, কুচো ইত্যাদি শিল্পের কাণ্ডারি তিনি, শিল্পী। শিল্পে স্যাকরার ঠুকঠাক থেকে কামারের এক ঘা তাঁর হাতের মুঠোয়। দেশের অন্যত্র তিনি পক্বকেশ বৃদ্ধ হলেও শিব ঠাকুরের আপন দেশে তিনি ঘোরতর যুবাপুরুষ। সকলের প্রিয় করিত্কর্মা ‘বিশুদা’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

বাড়ি, গাড়ি, পণ্যের উৎপাদনে কাঁচামাল থেকে ফিনিশিং টাচে হালকা থেকে ভারি, সকল স্তরের সুকুমারবৃত্তির দেবতা তিনি। হিসেব, অঙ্ক, নানা দরের প্রযুক্তি জানা এই ভদ্রলোক সূর্যের শ্বশুর। ক্ষমতার সঙ্গে ওঠাবসা করেন। বড় বড় দৈব প্রোজেক্টে একডাকে হাজির হন। ত্রিভুবনচর্চিত এই ব্যক্তিত্ব প্রাসাদের মায়াকানন থেকে কুটিরের ভাঙা দরজার ততোধিক জীর্ণ কব্জা সর্বত্র মায়া ছড়াচ্ছেন। তাঁকে এড়ানো কঠিন। তাঁর ডিপার্টমেন্টাল কাজকর্ম কিছু কিছু সরস্বতী, লক্ষ্মী ও সিদ্ধিদাতার মর্জির ওপর সফল হয় বলাবাহুল্য, তবে তিনিই মাথার ঘাম পায়ে ফেলার মূল কারিগর। শ্রম তাঁর মূলধন, আবার কৌশল ছাড়া তাঁর দুনিয়া অচল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫৩: সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে

যন্ত্রের উপভোগ ও যন্ত্রণা দুটোই মানুষের ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে। উপভোগের মাত্রা ও ধরণ বদলেছে। বদলেছে যন্ত্রণার ধারণা। নির্মাণের প্রকৌশল আর প্রকৌশলের বিনির্মাণ, দুটিই চলেছে হাত ধরাধরি করে। বিশ্বকর্মা তাঁর পেটকাটি চাঁদিয়াল নিয়ে সেই স্বপ্ন বোনেন, আবার কঠিন ভূমিতে হাতুড়ির ঘায়ে প্রাণ জাগানোর কারিগর-ও তিনি।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

মর্ত্যের নানা হট্টগোলের মাঝে পড়ে কার্ত্তিকের সঙ্গে তাঁর একটা আত্মবন্ধন ঘটে গিয়েছে। দু’জনেই হাই প্রোফাইল। একজন দেবসেনাপতি তো অন্যজন দেবশিল্পী। তবে ভারি কাজ করে ভালোরকমের বিশ্রাম লাগে বলে বিশ্বকর্মার পিঠে ওই হাতি। বেশ হেলান দিয়ে কায়দা করে দাঁড়ান আর সমবেত ভক্তদের প্রসন্নতা বিতরণ করেন। কচিকাচারা ভিড় করে ‘এলিফ্যান্ট’ দেখে, চিড়িয়াখানার কায়দায়। অন্যদিকে ময়ূরবাহন কার্ত্তিককে দেখলে ট্রেন-বাসের সেই সব নিত্যযাত্রী কিংবা হাউসফুল ক্লাসঘরের সেইসব ছাত্রদের কথা মনে পড়ে, যারা পুরো সময়টাই ঠেলাঠেলি করে অদ্ভুতভাবে নিজের জায়গাটুকু ধরে রাখে প্রাণের দায়ে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

“দাদা আরেকটু চেপে বসুন” কিংবা “সরে বস না রে, ওই তো অত্তো জায়গা” ইত্যাদি বিপ্লবের মাঝে ত্রিভঙ্গমুরারি অথবা ত্রিশঙ্কু হয়ে বসে থাকার যে শ্রম তা ওই কদিন প্যাণ্ডেলে কার্ত্তিককে করতে হয় বৈকী! যে সব বসার চেয়ে দাঁড়ানো ভালো, সেই সব বসা হাসিমুখে মেনে নেওয়ার শিল্প কার্ত্তিকের করায়ত্ত। বছর বছর করে করে এভাবেই হয়তো শিল্পী বিশ্বকর্মার শিল্পের শরিক হয়ে গেছেন তিনি।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content