শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


এখন দ্রোহকাল। বিপ্লবের সময়। আজ এক বিদ্রোহিনীর গল্প বলি। হয়তো তিনি লেখক হতে পারতেন। তিনি তাঁর জীবনযাপনের মধ্যেই উনিশ শতকে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে চিকের আড়ালে কত জ্যোতির্ময়ী আলোর শিখা যে প্রচারের আলো পাননি, ভাবলে অবাক লাগে। সময়টা মেয়েদের জন্য গহীন আঁধারের। সেই যুগে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে নিজেদের ইচ্ছের মর্যাদা রাখতে পেরেছিলেন যাঁরা, তাঁরা প্রত্যেকেই আলোকবর্তিকা। এমনই একজনের কথা বলবো আজ। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী যোগমায়া দেবী।
যশোর জেলার চেঁচুরি অঞ্চলের মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা ছিলেন যোগমায়া। অপৌত্তলিক দেবেন্দ্রনাথের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি নিশ্চিন্ত গৃহসুখ নয়, চেয়ে নিয়েছিলেন গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনকে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ব্রাহ্মধর্মের অপ্রতিরোধ্য প্রতিষ্ঠানু। তাঁর কথায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মূর্তিপুজো স্তব্ধ হয়ে যায়। অন্দরমহলে লুকিয়ে, গোপনে পুজো, ব্রতপালন করতেন মেয়েরা। কিন্তু সে তো নিঃশব্দ ভীরু ভঙ্গিতে। যোগমায়া দেবী নিজের ইচ্ছের আড়াল রাখেন নি। এইখানেই তাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতেই পারে আধুনিক মেয়েদের মুগ্ধতা।
দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর গিরীন্দ্রনাথ আর নগেন্দ্রনাথের মাথার উপর ছায়ার মতোই ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। বিস্তর দেনা মোটামুটি সামলে ওঠার পর, সকলেই দেবেন্দ্রনাথকে পরিবারের কর্তা হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং দায়িত্বজ্ঞানের কারণে সকলে তাঁকে সম্ভ্রমের চোখেই দেখতেন। যোগমায়া দেবীও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের অবসর সময়ে পুজো, ব্রত পার্বণ অনেকখানি জায়গা নিয়েছিল। সেই পুজো, মূর্তি উপাসনার উপর যখন কোনও আলোচনা ছাড়াই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল, চণ্ডীমণ্ডপের জায়গায় নির্মাণ করা হলো ব্রহ্ম উপাসনার বেদী, তখন আর কেউ নয় প্রতিবাদ করেছিলেন যোগমায়া দেবী।

আসলে, ভক্তি আর বিশ্বাস তো সকলের ব্যক্তিগত, অন্য কারো ইচ্ছেমতো কি মুহূর্তে দেববিশ্বাস থমকে যেতে পারে?এই সহজ সত্যটি প্রকাশ করেছিলেন যোগমায়া দেবী, অত্যন্ত মার্জিত ভঙ্গিমায়। দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে তিনি চেয়ে নিয়েছিলেন গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনকে। তারপর যোগমায়া দুই ছেলে গুণেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ এবং দুই মেয়ে কাদম্বিনী আর কুমুদিনীকে নিয়ে দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়িতে উঠে এসেছিলেন। ব্যক্তিগত পরিসরের জন্য বৈঠকখানা বাড়ির টানা বারান্দা ঝিলমিল দিয়ে আড়াল করা থাকতো ভোর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪১: ফয়জুন্নেসা— প্রথম মুসলমান মহিলা সাহিত্যিক

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

যোগমায়া দেবী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী। অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণায় তাঁর শরীরের পদ্মগন্ধের কথা লেখা আছে। অবনীন্দ্রনাথের ঠাকুমা ছিলেন যোগমায়া। তাঁর শরীরের সোনার বর্ণটিও অক্ষরের মালায় গেঁথে রেখেছিলেন অবন ঠাকুর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগমায়া দেবীর কাছে ছেলেবেলায় লেখাপড়া করার স্মৃতিচারণ করেছিলেন। বাংলাটা বেশ ভালোই জানতেন। পড়ার অভ্যাসও ছিল তাঁর। দয়া বৈষ্ণবীর কাছে চিঠি লেখা শিখতেন। ‘নব নারী’, ‘লয়লা মজনু’, ‘হাতিমতাই’, ‘আরব্যরজনী’,‘ লাম্বস টেল’ ইত্যাদি বই পড়েছিলেন। স্বামীর লেখা ‘কামিনীকুমার’ ও পড়েছিলেন যোগমায়া দেবী। তাঁর বইয়ের তালিকায় সম্ভবত ছিলো‘ মানভঞ্জন’,‘প্রভাসমিলন’,‘ কোকিলদূত’, ‘অন্নদামঙ্গল’, ‘রতিবিলাপ’, ‘বস্ত্রহরণ’, ‘গীতগোবিন্দ’, ‘গোলেব কাওলী’, ‘বাসবদত্তা’ প্রভৃতি বই। দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদাদেবীর সঙ্গে বই পড়তেন যোগমায়া দেবী।লেখাপড়ায় অত্যন্ত আগ্রহের কারণে ১৮৫১ সালে মেয়ে কুমুদিনীকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

অন্দরমহলের শিশুদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল যোগমায়া দেবীর ঘর। দেবেন্দ্রনাথের মেয়ে সৌদামিনীর সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গ ছিলেন যোগমায়া। তাই যোগমায়াদেবীর বৈঠকখানা বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্তে মর্মাহত হয়েছিলেন সৌদামিনী। তবু আত্মসম্মানকে গুরুত্ব দিয়ে জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়ির নতুন রীতি রেওয়াজ শুরু করেছিলেন যোগমায়াদেবী।

খুব সংসারী ছিলেন যোগমায়া। অথচ স্বামী গিরীন্দ্রনাথ স্বল্পায়ু ছিলেন। তাঁর পরিবারের মেয়েদের অতিথি সেবা, গৃহদেবতার পুজো, সংসারের কাজ সবই মন দিয়ে শিখতে হতো। যশোরের কাঁথাকাজ, নকশিকাঁথার কাজের চর্চা করতে উৎসাহ দিতেন যোগমায়া। এছাড়াও তত্ত্ব তল্লাশে কাগজের বাড়ি, মশলার বাড়ি,মেওয়ার পুতুল,ডাল দিয়ে ছবি তৈরি করে বিয়ের তত্ত্বে পাঠানো হতো। যশোর থেকে নারকেল চিড়ে, জিরে নারকেলের ফুল আনানো হতো। বিরাট বিরাট বাতাসা, কদমা, কলকাতার বিখ্যাত সব খাবার যেতো তত্ত্বে। সঙ্গে যেতো একশো দেড়শো লোক।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

এইসব দেখাশোনা করতেন যোগমায়া। অল্পবয়সে দেওর নগেন্দ্রনাথকে বিয়েতে রাজি করিয়েছিলেন যোগমায়া দেবী। নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরীকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিতেন যোগমায়া। তারপর কালের নিয়মে শরীর ভাঙতে থাকে, তবু অসুস্থ অবস্থাতেই সংসার তদারক করতেন এই ব্যক্তিত্বময়ী! অসুস্থ শরীরেই মেয়ের বিয়ে দেন, তারপর আড়িয়াদহের বাগানবাড়িতে হাওয়া বদল করতে গিয়ে ওখানেই মৃত্যু হয় যোগমায়ার। হয়তো, তাঁর প্রিয় লক্ষ্মী জনার্দনের কাছে আশ্রয় পেয়ে গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সব বিপ্লব একরকম হয় না। যোগমায়ার মৃদু ভঙ্গি অথচ আত্মমর্যাদাবোধ—তাঁর বিদ্রোহটিকে জোরালো করেছিল। তখনকার দিনের পর্দানশীন মেয়ে, ক্ষমতা কতটুকু?অথচ দোর্দণ্ডপ্রতাপসম্পন্ন দেবেন্দ্রনাথের মতাদর্শের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের বক্তব্যকে। নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে ভালোবেসেও পৃথক হয়েছিলেন গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনের প্রতি কর্তব্যের খাতিরে। নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরীর মতো তিনি দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে মামলা করেন নি, কিন্তু প্রদীপের নিস্পন্দ শিখার মতো অটল থেকেছেন নিজের কথায় ও কাজে। এই কারণেই তিনি মহিয়সী, অপরাজিতা। সময় কি মনে রেখেছে? আধুনিক নারীর আলোয় আলোময় পথে একটি প্রদীপশিখা তিনিও জ্বালিয়েছিলেন।

ঋণ স্বীকার
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল, চিত্রা দেব
ঠাকুরবাড়ির সাতকাহন, শান্তা শ্রীমানী
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content