ছবি: প্রতীকী।
শেয়াল কখনও কোনও গল্পে বীরের মর্যাদা পেয়েছে? গল্পসাহিত্যের প্রকল্প বা প্লটে সিংহ উদারচেতা পশুরাজ, কখনও বা অবিমৃষ্যকারী, অপরিণামদর্শী। আর শেয়াল? “আমাকে দেখুন” টাইপের ঔদ্ধত্য নিয়ে নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গে তার জুড়ি মেলা ভার। এই যেমন আজকের গল্পেও একটা শেয়াল আছে, সিংহ-ও আছে।
সেবার বোধিসত্ত্ব রাজার বিদ্বান পুরোহিত হয়ে জন্মেছেন। জাতকমালার গল্পে দেখা যাচ্ছে, সেই বিদ্বান ব্রাহ্মণ আবর্জনমন্ত্র বা পৃথিবীজয়ের মন্ত্র জানতেন। এ মন্ত্র গোপনীয়, অপাত্রে পতিত হলে তুলকালাম ঘটে যেতে পারে। ব্রাহ্মণ তাই অতি সংগোপনে বনভূমিতে গিয়ে মন্ত্র আবৃত্তি করে নিজের মুখস্থবিদ্যা পরখ করছিলেন। শেষে খুশি হয়ে বললেন, বেশ মুখস্থ হয়েছে তো এ মন্ত্র। তিনি জানতেও পারেননি যে গর্তে লুকিয়ে এক শেয়াল সেই মন্ত্র শুনে কণ্ঠস্থ করে ফেলেছে। সে তড়াক করে লাফিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে দূরে পালিয়ে গেল, যাওয়ার আগে বলে যেতে ভুলল না যে, সে আরও নিখুঁত দক্ষতায় মন্ত্র জেনে নিয়েছে। ব্রাহ্মণ আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় হৈচৈ করলেও তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ
এরপর শেয়াল গভীর বনে এসে মন্ত্র পড়ে পশুরাজ হয়েছে। সিংহ থেকে বিড়াল পর্যন্ত তার অনুগত। এক শৃগালী হয়েছে প্রধানা মহিষী। তার পার্শ্বচর সিংহ হাতির পিঠে চড়ে। শেয়াল চড়ে সেই সিংহটার পিঠে। এভাবেই অতিদর্পে সে ঘোরে ফেরে ফিল্মি কায়দায়। কালক্রমে তার মনে হল রাজার নগরটা এবার অধিকার করতেই হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পশুর পালের চতুরঙ্গ সেনাবল নিয়ে সে নগর অবরুদ্ধ করে বার্তা পাঠালো, “হয় রাজ্য নয় যুদ্ধ”… এই আকস্মিক বিস্ময় ও ভয়ে প্রমাদ গুণে নগরবাসী নগরের দরজায় খিল দিল। সেই ব্রাহ্মণ এসে জানতে চাইলেন, “ওহে! কীভাবে নগরের দখল নেবে?”
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ
শেয়াল তার কৌশল জানাল। যুদ্ধে, রাজধর্মে মন্ত্রগুপ্তি বজায় রাখতে হয় শেয়ালের তা জানা ছিল কি? সে বলল, আমার অনুগত সিংহের দল মহাগর্জনে নগরবাসীকে ভয়ার্ত করে অনায়াসে নগর দখল করবে। শেয়ালের বুদ্ধি একেই বলে। চিনেপটকা, দোদমা কিংবা লাউডস্পিকার বা ডিজের দুমদামের কথা ভাবুন। ব্রাহ্মণ ভেরী বাজিয়ে নগরবাসীদের কুকুর বিড়ালসহ কান এঁটে বসে থাকতে নির্দেশ দিলেন। মাষকলাই বেটে তা দিয়ে নগরবাসী কান “সিল” করে বসে ইষ্টনাম জপতে লাগল বোধহয়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
এ বার ব্রাহ্মণ বললেন, কৈ দেখি, তোমার সিংহ কেমন ডাকে। শেয়ালের ইঙ্গিতে সিংহ হাতির পেটের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হুঙ্কার দিল। হাতি বেচারা ভয় পেয়ে কেঁপে গেল। তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল শেয়াল, অবিলম্বেই হাতির পায়ের চাপে সে গুঁড়িয়ে গেল। তারপর পশুর পাল পরস্পরকে আঘাত করে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে গেল। অচিরেই ধাক্কাধাক্কি করে মরল সকলে, বেঁচে থাকল সিংহগুলো, বীরভোগ্যা বসুন্ধরার জন্য। কিন্তু তারা তখন ভয়ে মুষিকের মতোই বনে আশ্রয় নিল। চারিদিকে টাটকা পশুমাংসের স্তূপ, নগরবাসী বেরিয়ে এসে মনের খুশিতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
এই গল্পটায় হাতি, সিংহ আর শেয়াল আছে। হাতির সঙ্গে সিংহের লড়াই হলে কে জেতে কে হারে তা বলা কঠিন। সেই হাতি কীনা শেয়ালের বাহন, সেই সিংহ-ও কীনা শেয়ালের পায়ের নিচে? তবে সমাজের মূল ভিত্তির শক্তি ওই হাতির মতো প্রবল শ্রম। তাকে অবলম্বন করেই বীর্যের, তেজের সিংহনাদ। এই যুগপত্ শক্তি-রাজসিক গুণে, তেজেই প্রতিষ্ঠানের সার্থকতা। হীনবল চাতুর্য ও কপট কাপুরুষতা সেই শ্রম-শক্তির ভারসাম্য, স্থিতিকে নড়িয়ে দিতে পারে, তাতে তার নিজের পতন-ও ত্বরান্বিত হয়। থেকে যায় সিংহরাই। শেয়ালের রাজা হওয়ার গল্পে সেই “প্রাংশুলভ্যে ফলে” লোভ করে বামনের চাঁদ ধরতে ছুটে মরীচিকায় হারানোর শিক্ষা আছে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।