শনিবার ১৬ নভেম্বর, ২০২৪


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগর কে ছিলেন? ঈশ্বর ছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ যেমন ঠাকুর।

ব্যক্তিপুজোর দেশে নাকি এ সব হয়ে থাকে। এখন পোস্ট ট্রুথের জমানা। অনায়াসে বঙ্কিমে ভাগ বসান রবি, রবিকে খানিক হজম করেন শরচ্চন্দ্র, আবার চাঁদ গিলে নেয় অন্য নক্ষত্র। তেমনই, বিদ্যাসাগর রামমোহন একাকার। বিদ্যাসাগর এবছর যদি বিধবা বিবাহ চালু করলেন তো পরের বছর সতীদাহ আটকালেন। বোর্ড কিংবা ইউনিভার্সিটির প্রশ্নের মতো, কিংবা ওই প্রশ্নেই আটকা পড়ে গিয়েছেন সক্কলে। সেদলে কালিদাস থেকে নজরুল, মহাকবি থেকে বিশ্বকবি, ঠাকুর-দেওতাদের পুজো পাওয়ার ঠেলাঠেলি। কটা ধুপের ধোঁয়া আর একগুচ্ছ মালার লোভেই যেন…. তবু মনে রেখো, আজি হতে শতবর্ষ পরে।
কিন্তু, ওই প্রশ্নটাতেই এসে খচখচ করছে ভারি। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নে আর পাঠ্যে জায়গা করে নেবেন বলেই এঁদের ঠাকুর কী ঈশ্বর হয়ে ওঠা? সাগরে যে অগ্নি থাকে সে কি শুধুই কল্পনা? অবিশ্বাসী যারা, তাদের প্রত্যয় হয় তো আদৌ?
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১১: মনের মানুষ এল দ্বারে

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

এই যেমন উল্টো পথে হেঁটেও সোজা কাজ করা যায় অথবা সোজা কাজ করা মোটেও সোজা নয় এ সব কি তারা বিশ্বাস করে? বিদ্যাসাগর জীবনের শেষ অধ্যায়ে আক্ষেপ করেছিলেন বৈকী! তাঁর দেশের লোক এমন অসার জানলে তিনি এমন হিতৈষণার কাজে নামতেন না বুঝি! কিন্তু বীরসিংহের সিংহশিশুর জীবন জুড়েই অদৃষ্টকে ব্যর্থ করার প্রয়াস বারবার যেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

দারিদ্র্য, প্রতিষ্ঠা, প্রতিবাদ, সংস্কৃত শিক্ষা, প্রাচ্যবোধ ও পাশ্চাত্যবিদ্যা, বর্ণপরিচয়, কথামালা, নীতিশিক্ষার পাঠ, বীর্যে সুগম্ভীর জনৈক একগুঁয়ে রাখালের ‘গোপাল’ তৈরি করার প্রয়াস, পাণ্ডিত্য, মাতৃভক্তি, নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি, নারীজাগরণ, উপযোগিতাবাদ, মানবতাবাদ, নবজাগরণ, ব্যবসাবুদ্ধি বা বজ্রকাঠিন্যের অন্তরালে কুসুমকোমলতার যে বিস্ময়কর ঘাত-প্রতিঘাত বিদ্যাসাগরের জীবনকে স্বতন্ত্র মাহাত্ম্য দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

পুরাণকথা যে ভাবে ‘মিথ’ বা অতিকথা হয়ে ওঠে, বিদ্যাসাগরের কর্মতত্পরতার বহুশ্রুত নানা কাহিনি বহুবার এ ভাবেই বাস্তবের সীমা অতিক্রম করেছে। বোঝা যায়, জীবত্কালে ও জীবনের পরেও ব্যক্তিমানুষের কর্মধারা সমাজমানসে ও জনজীবনে, নির্দিষ্ট করে বললে, সাধারণ মানুষের হৃদয়ে কীরকম অভিঘাত তৈরি করেছিল। এভাবেই গড়ে ওঠে মহাজীবনের আত্মকথা। রবীন্দ্রনাথের গানে যে “মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে”র ধ্বনি, তাতে যেন এই ব্যক্তিমানুষের গণদেবতা হয়ে ওঠার বার্তাটুকুও সঞ্চিত থাকে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনে “ঈশ্বর হয়ে ওঠার” থেকেও যে “সাগর হয়ে ওঠা”, তা-ই তাঁকে প্রবাহে স্থান দেয়, তথাকথিত “এলিটের” মন্দিরে নয়, পথপ্রান্তে তরুচ্ছায়াতলে দীনবন্ধু, নিভৃত প্রাণের দেবতা হয়ে ধূপের ধোঁয়া, দীপমালার ভিড় কাটিয়ে তাঁর “একা” হয়ে থাকার যে একক, অখণ্ড যাপন, তা-ই তাঁকে মনে করাবে বারবার।
* লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content