অলঙ্করণ: লেখক।
কবি বলেছেন, “তোমার বিশ্ব-নাচের দোলায় দোলায় বাঁধন পরায় বাঁধন খোলায়/ যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে।” ছেলেভুলোনো ছড়ায় আছে “আয় রে আয় টিয়ে/ নায়ে ভরা দিয়ে/ না’ নিয়ে গেল বোয়াল মাছে/ তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে/ ওরে ভোঁদড় ফিরে চা/ খোকার নাচন দেখে যা।”
শোনা যায়, প্রলয়কালে নটরাজ তাণ্ডবনৃত্য করেন। আবার নাচ থামলে তিনি চোদ্দোবার ঢাকে কাঠি দেন, নানা শব্দগুচ্ছ থেকে নির্গত হয় আদি বর্ণমালা, সৃষ্টির পর জগৎ চালানোর জন্য। বর্ণ থেকে শব্দ, শব্দ থেকে পদ, আর পদে পদেই আসে বিপদ।
শোনা যায়, প্রলয়কালে নটরাজ তাণ্ডবনৃত্য করেন। আবার নাচ থামলে তিনি চোদ্দোবার ঢাকে কাঠি দেন, নানা শব্দগুচ্ছ থেকে নির্গত হয় আদি বর্ণমালা, সৃষ্টির পর জগৎ চালানোর জন্য। বর্ণ থেকে শব্দ, শব্দ থেকে পদ, আর পদে পদেই আসে বিপদ।
পদ-ই নৃত্যের অবলম্বন। জগতের নৃত্য চলছে বিপদ আর সুন্দরকে দুই পকেটে রেখেই। ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকেই নাকি এসব লৌকিক নৃত্যের শুরুয়াত্। অলৌকিক অমর্ত্য পঞ্চমবেদের লোকরঞ্জনের পথে যাত্রা। জড়ের দুনিয়ায় এই নাচটা নেই, প্রাণের জগতে এই নাচটাই মূল। বামদিকের বুকের নিচে যে নাচটা চলছে তাকেই খাতায় কলমে বেঁচে থাকা বলে তো? মরা-বাঁচার ঐ হিসেবটা এত জলবত্ নয় যদিও, তবুও জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাচটা চলছে তো?
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৭: ওরাল হেলথ
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ
পুরাকালে কেউ ধনুকভাঙা পণ নিয়ে ধ্যানে বসে গেলেই অপ্সরারা তাঁকে নৃত্য প্রদর্শন করে সঙ্কল্পচ্যুত করতে চাইতেন। মানে, বিরক্ত করতেন আর কী! এসব আমাদের দেখা নেই, তবে দিনে দুপুরে কী সন্ধ্যেবেলা নৃত্যরত মশার “বহু বাসনায় প্রাণপণে চাওয়ার” তালে তালে পুণ্যকর্ম রক্তদানে অনিচ্ছুক জগৎবাসীর লৌকিক নৃত্য জগতের সেই চাঞ্চল্যের-ই পরিচয়। নিন্দুকরা একে অবশ্য ‘ছটফট’ বলবেন, তবে ‘কাতুকুতু দিলে গরু কেন করে ছটফট” এর উত্তর না জানলে এসব ভুল একটু আধটু হতেই পারে। এই যে, লাঙ্গুলবিশিষ্ট কী বিমুক্ত জীবমাত্রেই লেজে খেলাতে পারদর্শী, কিংবা শাখামৃগের চঞ্চলতার সঙ্গে যখন দ্বিপদ জীবকুলের কর্মকুশলতার বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়, তখন এইসব জাগতিক ক্রিয়াকে পণ্ডিত এক নামে, পণ্ডিতন্মন্য আরেক নামে, নেহাত বোকাসোকা না-মানুষ অন্যতর নামে ডাকে, কিন্তু এসব কর্মের পিছনে আছে নৃত্যের উপর নিবিড় টান, নাচতে ও নাচাতে ভালোবাসার অভিজ্ঞান।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: রাজকোষে সঞ্চিত সোনা-রূপা-ধান্যাদি সবই প্রজাবর্গের, রাজার ব্যক্তিগত নয়
ফুলের মাথায় প্রজাপতির, নগরকীর্তনে, বাসে-ট্রেনে আপনার আমার, মণ্ডপে ঢাক কিংবা ধুনুচির, শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদলের, ভাসান ড্যান্সে জনগণের, রাষ্ট্রজীবনে নাগরিকের, সংসারে মনুষ্যকুলের, জন্মমরণচক্রে জীবাত্মার আর পাতায় পাতায় আলোর নাচ… এই তো ভালো লেগেছিল!! কেননা, কবি বলেছেন, “নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া”, বলেছেন, “তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম/ মোর সংসারে তাণ্ডব তব কম্পিত জটাজালে/ লোকে লোকে ঘুরে এসেছি তোমার নাচের ঘূর্ণিতালে।”
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?
নাচ নির্ভার করে। আবার, নাচতে না জানলেও ক্ষতি নেই। উঠোনের ঘাড়ে বেতালের মতো চাপিয়ে দিন দায়, চুপি চুপি। কলাপের মতো বিকশিত হৃদয় নেচে ওঠে সময়ে সময়ে। হাতি নাচে ঘোড়া নাচে। নাচে জন্ম নাচে মৃত্যুও। কবিই সার্টিফাই করে লিখেছেন, নাচা-হিলে যারে পাওয়া যায়; এই পার্থিবলোকেই এক মহা-অপার্থিব ডান্স চলছে বিদ্রোহী পরমাণুর সংঘর্ষ থেকে মাথার মধ্যে কাজ করতে থাকা বোধে, মনের অন্দরে কন্দরে, হরিবোল ধ্বনি দিয়ে বিপুল উচ্ছ্বাসে শেষ স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার চমত্কার তৎপরতায়, যুদ্ধের ময়দানে, ভূতের কেত্তনে, স্ক্রিন ছুঁয়ে থাকা আঙুলের ডগায়, আগে পৌঁছনোর উতকণ্ঠায় কিংবা জয়ের ভিক্ট্রিল্যাপে… বিশ্বমঞ্চে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে যে নাচটাই দৈনন্দিনের অবলম্বন অথবা বাধ্যতা, তাকে মনে করায় এপ্রিল মাসের ঊনত্রিশে “বিশ্ব নৃত্য দিবস”, অতয়েব? পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স!!!
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।