হিংলো নদী।
বীরভূমের ছোট্ট নদী হিংলো বর্ধমানের অন্যতম প্রধান নদী অজয় এবং বীরভূমের ময়ূরাক্ষীর মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ময়নাডাল, হজরতপুর, জোফলাই ও পলাশডাঙ্গা ইত্যাদি সুপ্রাচীন জনপদ ছুঁয়ে চাপলায় অজয় নদীতে মিশেছে। নদীটি অজয় নদ থেকে আট মাইল দূর দিয়ে প্রায় সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে বীরভূম জেলায় প্রবেশ করেছে। এই জেলার ১৫ মাইল পথ অতিক্রম করে সে অজয়ে মিশেছে। নদীটির উৎপত্তিস্থল হল জামতারার নিকট সাঁওতাল পরগনা (২৩°৫৪`N, ৮৭°৬`E)। নদী অববাহিকার ক্ষেত্রফল মাত্র ২০০৯ বর্গ কিমি বা ৭৭৬ বর্গ মাইল এবং অববাহিকাটি ৪৯৬০ একর বা ২০৯ হেক্টর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।
বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদীটিতে বর্ষাকাল ব্যতীত জলে প্রায় থাকে না বললেই চলে। স্বল্প গভীরতা এবং নদীবক্ষ ভরাট হয়ে যাবার জন্য, স্বল্প বৃষ্টির জলে হিংলো নদীতে প্রায়ই বন্যা হয়। ১৯৭৮ এবং ২০০০ সালের বন্যায় এই নদীর অববাহিকা ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে অতিরিক্ত জলের চাপ এবং বাঁধের জল ঠিকমতো নিষ্কাশন না হওয়ার জন্য, বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল এবং বীরভূমের ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দারুণ প্লাবন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কোপাই নদী ও অজয় নদের মধ্যবর্তী অঞ্চলে হিংলো নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে বহু পূর্বেই। এই বাধের ধারণ ক্ষমতা হল: ১৭১০২০০০ কিউবিক মিটার। এর ফলে সারা বছর জল ধরে রেখে বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যেমন: খয়রাশোল, দুবরাজপুর ইত্যাদি অঞ্চলগুলিকে জলসিক্ত করে চাষের উপযোগী করা হয়।
আরও পড়ুন:
এক ভিন্ন স্থপতিবিদ রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া
মনে রাখা প্রয়োজন, নদীর উপর এই বাঁধ নদীর কোটি কোটি বছরের শৃঙ্খলাকে ভেঙে নদীকে প্রায় স্তব্ধ করে দেয়। তাই বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে, নদী আর সেই জল বইতে পারে না। ভাসিয়ে দেয় তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে। বিশ্ববিখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক ম্যা ককুলি বলেছেন নদী এবং বাঁধ এরা একে অপরের পরস্পরবিরোধী। তাই এরা চেষ্টা করে একে অপরকে সংহার করতে। তার ফলস্বরূপ, যেসকল নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেই নদীগুলিই বন্যাপ্রবণ হয়ে গেছে। হিংলো তার ব্যতিক্রম নয়। নদীটির ওপর দিয়ে অন্ডাল-সাইথিয়া লাইনের ই. আই রেলের সাঁকো আছে। এই সব কারণে এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের মাঝেমধ্যেই বন্যা কবলিত হতে হয়। বাঁধের সাথে বর্তমানে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছে নদীর বুক থেকে বালি তুলে নেওয়া।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা
সরকারি নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদীর বুক চিরে তুলে নেওয়া হচ্ছে বালি, নদীর বুকে তোলা হচ্ছে রাস্তা। পলাশডাঙ্গাচর ও পলাশডাঙ্গা গ্রামের মাঝে এই নদীর উপর রাস্তা বানানো হয়েছে। কিন্তু সচেতন এলাকাবাসী এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ জানিয়েছিল। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি ও অন্যান্য পরিবেশ প্রেমিকদের মতে নদীর বুকে এইভাবে রাস্তা তোলার ফলে এবং বালি খাদের ফলে, নষ্ট হয় নদীর আপন গতিপথ ও সেই সঙ্গে নদীর বুকে গড়ে ওঠা বিপুল জীববৈচিত্র। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র এই হিংলো নদীকে নিয়ে অনেক লেখা লিখেছেন। খয়রাশোল এবং দুবরাজপুর অঞ্চলের স্থানীয় মানুষরা ‘কৃষি জমি রক্ষা কমিটি’ গঠন করেছেন। তারাও এই নদীটির রক্ষাকল্পে নানান সচেতনতামূলক কাজ করছেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান
এই নদীর তীরে অবস্থিত রাঢ়ভূমির অন্যতম বিদ্যাপীঠ ময়নাডাল। এখানে কর্তনের এক নিজস্ব ঘরানা রয়েছে, তার নাম ময়নাডাল ঘরানা। কথিত আছে শ্রীচৈতন্যদেব সিউড়ি থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়, গভীর জঙ্গলে ঘেরা এই জনপদে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন, অর্থাৎ স্থানটি শ্রীচৈতন্যের পদরেণুধন্য। এখানে রয়েছে কৃষ্ণ এবং গৌরাঙ্গ মন্দির। এখানকার মিত্রঠাকুর পরিবার এখনো পর্যন্ত পেশাগতভাবে কীর্তনের সাথে সংযুক্ত আছেন। একটা সময় এখানে মৃদঙ্গ ও কীর্তনের চতুষ্পাঠী ছিল। এখনও পর্যন্ত এখানে দোল, জন্মাষ্টমী ও নন্দ উৎসব বিশেষ সমারোহের সাথে পালিত হয়।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৩: আমার মালতী লতা কী আবেশে দোলে…
নদীকে ঘিরে এখনও এই অঞ্চলের মানুষের নানান উৎসব এবং রীতিনীতি ও আচার প্রচলিত রয়েছে। নদীর তীরে অবস্থিত মন্দির, শ্মশান ও কবরস্থানে স্বাভাবিকভাবেই রক্ষিত হয়ে থাকে হাজার উদ্ভিদ, প্রাণী ও জীববৈচিত্র। স্থানগুলি পবিত্রস্থান বা স্যা ক্রেড গ্রোভ পরিচিত। নদীতে পিন্ডদান ও পিতৃতর্পণ করা হয়। মকর সংক্রান্তিও পালন করা হয়। প্রচলিত কথা অনুসারে বলা যায়, ‘সোঁত মরলেও, রেক মরে না’। নদীর জল শুকালেও, নদীর চলার পথটি থাকে চির অমলিন। মানুষের স্বার্থে, পৃথিবীর স্বার্থে নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর এই ছোট ছোট নদী, বড় নদীর প্রাণস্বরূপ। তাই ছোট নদী বাঁচলে বাঁচবে বড় নদীও।—চলবে।
তথ্যসূত্র:
● Department of Agriculture, soil conservation section. Birbhum district, 25.03.2009
● Onlar Singh, Frontiers in Environmental Geography, Page-189
● বীরভূমের নদনদী, birbhum.org, 25.06.2017
● জয়া মিত্র, ‘সারা দেশে একটি নদীও অক্ষত নেই’, আনন্দবাজার পত্রিকা, 29.05.2017
● উইকিপিডিয়া
● কীর্তনীয়া প্রভাত মিত্রঠাকুর, শ্রীচৈতন্য পাট, ময়নাডাল (স্থানীয় বাসিন্দা)
● Hinglo River Dam- Wikimapia
● বাংলার নদনদী-দিলীপ কুমার বন্দোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
তথ্যসূত্র:
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।