গোড়ার দিকে উত্তমকুমার যখন নায়ক হয়ে এলেন, তখন একটার পর একটা ছবি ফ্লপ। সেই জন্য তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’। তখন চট করে কেউ তাঁকে নিতেও চাইতেন না। এদিকে তিনি এমপি স্টুডিয়োর স্থায়ী শিল্পী ছিলেন। মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের এম পি স্টুডিয়োর অবস্থানটা ছিল সিঁথির মোড়ে। কিন্তু এখন তার কোনও অস্তিত্ব নেই। এই এমপির ব্যানারে প্রচুর সুপারহিট ছবি আমরা উপহার পেয়েছি।
সেই সময় মুরলিধর একটি নতুন ছবি প্রযোজনা করতে চলেছেন। পরিচালক নির্মল দে। ছবির নাম ‘বসু পরিবার’। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে কাহিনি এগিয়ে গিয়েছে। সেখানে বড় ভাই সুখেনের ভূমিকায় কে অভিনয় করবেন প্রথমে ঠিক করতে পারছিলেন না নির্মল দে বা মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। তখন ঠিক করা হল অসিতবরণকে দিয়ে বড়দা সুখেনের চরিত্রটা করানো হবে। কিন্তু অসিতবরণ তখন এত ছবিতে অভিনয় করছেন, যে তিনি সময় দিতে পারছিলেন না। তখন অভি ভট্টাচার্যের কাছে বম্বেতে চিঠি পাঠানো হল। কিন্তু বোধহয় তিনি ঠিকানা বদল করেছেন বলে, সেই চিঠি ফেরত এলো। তখন নির্মল দে নিজের দায়িত্বে উত্তম কুমারকে গ্রহণ করলেন সুখেনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-২২: গুয়াহাটির সে কাল-এ কাল
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল
কিন্তু এর জন্য নির্মল দে টানা একমাস রিহার্সালের ব্যবস্থা করেছিলেন এমপি স্টুডিয়োর ফ্লোরেতে। নাটক রিহার্সাল দেওয়ার মতো টানা একমাস রিহার্সাল দিতে হয়েছিল ‘বসু পরিবার’ ছবির জন্য। এমপি-র একটা বিশাল ভ্যান ছিল। সেটা সকাল আটটার সময় এসে প্রথমে সুপ্রিয়া দেবীকে তুলে নিত। তারপরে তোলা হতো মঞ্জু দে’কে। মঞ্জু দে অবশ্য বসু পরিবারে ছিলেন না কিন্তু এমপি-র ব্যানারে আরেকটি ছবিতে তিনি তখন অভিনয় করছিলেন। ছবির নাম “কার পাপে”? মঞ্জু দে-কে তোলা হল ভ্যানে। তারপরে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তোলা হল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। সবশেষে ভবানীপুরের পূর্ণ সিনেমা হলের সামনে ভ্যানটা যেত। উত্তমকুমার সেখান থেকে উঠতেন। তারপরে সিঁথির মোড়ে স্টুডিয়োতে গিয়ে টানা সন্ধ্যে পর্যন্ত চলতো রিহার্সাল।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
সেই সময় সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন উত্তমকুমারের নিষ্ঠা দেখে। নিজেকে তৈরি করার জন্য কি অসম্ভব সুন্দর রিহার্সাল তিনি দিয়েই চলেছেন। বসু পরিবারের রিহার্সালের সময় দেখা গিয়েছে এক একটা শটের মধ্যে অভিনয়ে ইমপ্রুভ করার জন্য বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল নিয়ে উত্তমকুমার ভাবনা চিন্তা করছেন। সেটা তারপরেও তিনি বজায় রেখেছিলেন। একটা শটের এরকম ব্যাপার ছিল যে মায়ের গয়না বিক্রি করতে হয়েছে, যার কাছে বিক্রি করেছেন তিনি জিজ্ঞাসা করছেন “বিক্রি করে দিলেন”। উত্তম কুমার উত্তর দিচ্ছেন ‘দিয়েছি’। এই ‘দিয়েছি’ কথাটি বলতে পারফেকশন আনার জন্য কতক্ষণ যে রিহার্সাল উত্তমকুমার দিয়েছিলেন তার ঠিক ঠিকানা নেই। কারণ ‘দিয়েছি’ কথাটা শেষে যখন বলার ছিল “দিয়েছি মানে দিয়েছি। আমার মায়ের গয়না আমি বেঁচে দিয়েছি, এতে বলার কি আছে?” কিন্তু এই টোনটা সাবলীল ভাবেও আনার জন্য দরকার চর্চার। সুতরাং সেই দিন স্টুডিয়োতে উত্তমকুমার শুধু “দিয়েছি দিয়েছি” করেই রিহার্সাল দিয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?
শেষে ভ্যানে করে ফেরার সময় এই নিয়ে শিল্পীদের মধ্যে হাস্যরসিকতা হয়েছিল। তাঁরা সকলেই জিজ্ঞাসা করছেন তুমি দিয়েছো তো? আর উত্তমকুমার খালি জবাব দিয়েছেন হ্যাঁ দিয়েছি। যথাসময়ে এই ছবি মুক্তি পেল ১৯৫২ সালের ১১ এপ্রিল উত্তরা পূরবী উজ্জ্বলাতে। দেখা গেল এই প্রথম উত্তমকুমারের ছবি জনগণ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাবে গ্রহণ করলেন এবং তাঁর সৃষ্ট সুখেন চরিত্রটি সকলেরই মনে ধরে গেল।
এই ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পাহাড়ি সান্যাল, নেপাল নাগ, বাণী গঙ্গোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, জীবন বসু, মঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন পরিচালক নির্মল দে স্বয়ং। সংগীত পরিচালক ছিলেন উমাপতি শীল। ‘বসু পরিবার’ সুপার হিট হয়ে যাওয়ার পর আর কিন্তু উত্তম কুমারকে তেমনভাবে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি যেন সত্যিই পায়ের তলার মাটিটি খুঁজে পেয়েছিলেন এই ‘বসু পরিবার’ ছবির মাধ্যমে।—চলবে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।