রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

পূষণ ও রিমিতা সত্যিই চমকে উঠেছিল। এই নির্জন জঙ্গুলে পথে তাদের নিভৃত আলাপের সময় আর কেউ এসে পৌঁছবে, তা তারা ভাবতে পারেনি। তার উপর দেহাতি মানুষজন হলে কথা ছিল। কিন্তু এমন একজন, যিনি কি-না জঙ্গুলে গাছের সায়েন্টিফিক নেম বলবেন, তার অরিজিন বলবেন, এমনটি হলে চমকে উঠতেই হয়।

ভবানীবাবু বললেন, “মাফ করবেন। আপনারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন, এর মাঝে আমি এসে পড়ে রসভঙ্গ করলাম! বাই দ্য ওয়ে, চিনতে পারছেন?”
পূষণ একগাল হেসে অপ্রস্তুতের ভঙ্গিতে বলল, “ভবানীবাবু তো? সেই যে আসবার সময় পথে আলাপ হয়েছিল। ইতিহাসের শিক্ষক।”
ভবানীবাবুও এবার একগাল হেসে বললেন, “আপনার মেমারি সাংঘাতিক মশাই। একবার দেখাতে যে-ভাবে নাড়ি-নক্ষত্র মনে রেখেছেন, তা প্রশংসা করার মতো। লোকে পথের আলাপ পথেই ভুলে যায়!”
“যদি না সেই আলাপের পরিবেশ স্মরণীয় হয়। কিন্তু যে ভয়ঙ্কর পরিবেশে আমাদের দেখা হয়েছিল, সেই সময় আপনার সান্নিধ্য না পেলে, আমরা দু’জনে মানসিক ট্রমা কাটাতে পারতাম না। চারদিকের নানা ধরণের মানুষজনের ভিড়ে আপনিই একমাত্র যাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি কিছুটা হালকা হতে পেরেছিলুম।” পূষণ বলল।
“তার কারণ কিন্তু আমি নই। সেই সময় যারা ওখানে ছিল, তাদেরকে আপনি নিজের সমতুল্য বলে মনে করেননি, আমি সাধারণ শিক্ষিত হলেও, যেই শুনেছেন, আমি শিক্ষকতা করি, সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনে হয়েছে যে, আপনার মতো শহুরে শিক্ষিত মানুষের ক্ষেত্রে একমাত্র আমিই আপনার সমতুল্য হতে পারি। এই কারণে আপনার অবচেতন মন আমাকে মনে রেখেছে। এটা আপনাদের কলকাতা হলে অনেক উচ্চশিক্ষিতের ভিড়ে আমাকে আলাদা করে মনে রাখার কথা ছিল না।”
“কী যে বলেন ভবানীবাবু? শিক্ষিত সহৃদয় মানুষ সর্বত্র পূজা পান। আপনিও তেমনই। তারপর বলুন, এখানে কী মনে করে?”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৬: আর্যর কথা

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

ভবানীবাবু তার কথার জবাব না দিয়ে রিমিতাকে বললেন, “ম্যাডাম, আপনি কেমন আছেন?”
রিমিতা অবশ্য ভবানীবাবুর সঙ্গে আগে কথা বলেনি, সে বাসের মধ্যেই বসে ছিল সেদিন। পূষণ যেহেতু বাস থেকে নীচে নেমেছিল, ফলে তার সঙ্গেই ভবানীবাবুর আলাপ হয়েছিল। তবে পূষণের কাছে সে ভবানীবাবুর কথা শুনেছে। কিন্তু ভবানীবাবু এমন আন্তরিকতার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, যেন আগে থেকে রিমিতাকে তিনি চেনেন। রিমিতা তাঁর প্রশ্নের জবাব দিল স্মিত হেসে, “এই মোটামুটি ঠিক আছি। আপনার খবর ভালো তো?”
“আমিও ম্যাডাম মোটের উপর ঠিক আছি। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট মফস্‌সল ঠিক নেই!”
“মানে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল রিমিতা।
“আপনি তো জানেন ম্যাডাম, কয়েকদিন ধরে একের-পর-এক যা-সব ঘটছে এখানে, এত খুন, এত রক্তপাত, এত নৃশংসতা আমাদের এই ছোট্ট মফস্‌সল শহর আগে দেখেনি।” বিষণ্ণ স্বরে ভবানীবাবু বললেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

তাঁর গলার বিষণ্ণতা ছুঁয়ে গেল রিমিতাকেও। সে বলল, “ঠিক বলেছেন ভবানীবাবু। আমিও এইরকম অবস্থার মধ্যে আগে কখন পড়িনি। এখানে যা-যা ঘটছে, তা কেবল গল্প-উপন্যাসে পাওয়া যায়।”
“জীবন গল্প-উপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর। হয়তো সকলের সবসময় সেই রোমাঞ্চের সঙ্গে পরিচয় ঘটে না এক জীবনে, কিন্তু যার সঙ্গে ঘটে সে স্বীকার করতে বাধ্য যে, গল্প-উপন্যাসের চেয়েও অবাক করা ঘটনা ঘটে এই জীবনে! পিশাচপাহাড়ে তেমনই ঘটে চলেছে এখন। আমরা যারা এসে পড়েছি এখানে কিংবা আছি ঘটনাচক্রে, তারা সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্তের সাক্ষী মাত্র।”
“কিংবা শিকার!” বলল পূষণ।
“কী বললেন?” ভবানীবাবু চমকে তার দিকে তাকালেন।
পূষণ বলল, “বলতে চাইছি যে, আমরা কেবল সাক্ষী নয়। শিকারও বটে কেউ কেউ। তা-না-হলে কলকাতা থেকে আসা অনিলবাবু হঠাৎ খুন হলেন কেন? আর সুবল, তাকে হত্যা করল কে?”
“আর যেই হোক, কালাদেও নয়। কারণ, কালাদেও সম্পর্কে লোকাল নিউজপেপারে প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আমি যতদূর অনুসন্ধান করেছি, তাতে এখনকার হত্যাগুলির ধরণ কালাদেও-মিথের ধরণের সঙ্গে ঠিক মিলছে না। আমার মনে হয়, কেউ কালাদেও-মিথকে ব্যবহার করে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করার খেলায় নেমেছে। পিশাচপাহাড়ের আর যাই বদনাম থাক, কালাদেও এ ভাবে সাধারণ খুনির মতো অকারণ হত্যালীলায় নেমেছেন, তা কখন অতীতে শোনা যায়নি!”
রিমিতা বলল, “অতীতে হয়নি বলে যে কোনওদিনও হবে না, তা কি আর এত নিশ্চিতভাবে বলা যায় ভবানীবাবু?”
“তা হয়তো যায় না। কিন্তু দেবতা নামক মিথ যাঁদেরকে নিয়ে তৈরি হয়, সচরাচর তাঁরা কিন্তু বিশেষ ইমেজবন্দি হয়ে পড়েন এবং নিজেদের সেই প্রচলিত ইমেজের গণ্ডি থেকে বেরুতে পারেন না সহজে। কালাদেও তার ব্যতিক্রম নয় বলেই আমার বিশ্বাস!” ভবানীবাবু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৭: ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও?

পূষণ লক্ষ্য করল যে, কথা বলতে বলতে ভবানীবাবুর চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে কিছু যেন খুঁজছে। সে ভাবল, কিছু কি হারিয়েছেন ভবানীবাবু? সেই কারণেই এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় তাঁর আসা? কিন্তু যদি কিছু খুঁজেই থাকেন, তাহলে সেটা কী?
সে ভবানীবাবুকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কি কিছু হারিয়েছেন ভবানীবাবু?”
ভবানীবাবু ইতিউতি তাকানোর মাঝেই চমকে উঠলেন যেন। তারপর বললেন, “নাহ্‌, কিছুই হারায়নি আমার। এদিকে তো আমার তেমন আসাই হয় না, ফলে কিছু হারানোর প্রশ্নই ওঠে না। কী আর খুঁজব পূষণবাবু?”
“না না, আপনাকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে? সেই কারণেই বললাম। আপনি কি কাছেপিঠেই কোথাও থাকেন?” কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বলল পূষণ।
“না না, আমি ঠিক আছি। কেবল কালাদেওর আড়ালে থাকা সেই রহস্যময় হত্যাকারীকে আমাদের খুঁজে নিতে হবেই। তা-না-হলে হয়তো আমাদের কারও উপর যখন-তখন আক্রমণ হতে পারে। এতদিন ভাবতাম, হত্যাকারী সতর্ক, ফলে দিনের আলোয় আমরা সুরক্ষিত। কিন্তু কাল ভোরে যা ঘটেছে, তাতে আর সেই বিশ্বাস থাকে কী করে বলুন? সেই কারণেই চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছি। তেমন কেউ এলে যাতে চম্পট দিতে পারি!” তাঁর বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যাতে সিরিয়াস কথাবার্তা হলেও পূষণ হেসে উঠল। রিমিতা হাসল না বটে, কিন্তু কৌতুকমাখা মুখ করে ভবানীবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

ভবানীবাবু সম্ভবত কুন্ঠা অনুভব করছিলেন, ফলে চোখ ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে।
পূষণ বলল, “শুনেছেন তো, লালবাজার কলকাতা থেকে দু’জন গোয়েন্দা অফিসার এসেছেন, কালাদেও-সংক্রান্ত কেসগুলির তদন্ত করার জন্য?”
ভবানীবাবু মাথা নাড়লেন। তিনি শুনেছেন।
পূষণ বলল, “আপনি চাইলে আপনার অবজারভেশন ওনাদের গিয়ে বলতে পারেন। থানাতে কনট্যাক্ট করলেই হবে। থানার সুদীপ্তবাবু না কী নাম অফিসারের, তাঁকে গিয়ে বললেই ওনারা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন।”
ভবানীবাবু বললেন, “হ্যাঁ, আমি চিনি ওনাকে। প্রতিবেদন লেখার সূত্রে আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। তাহলে বলছেন, সাহস করে থানায় গিয়ে লালবাজার থেকে আসা অফিসারদের সব কথা বলে আসি? যদিও এক অফিসারকে আমি আগেই চিনি। বনে-বাদাড়ে কালাদেওর সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন। বাইরে বলতেন, ফিল্ম-কোম্পানির তরফ থেকে এসেছেন লোকেশন-আউটডোর সম্পর্কে খোঁজখবর করতে। যাই হোক, এক-আধজন যখন চেনা, তখন খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। চলেই যাই, বলুন?”
“হুঁ”, পূষণ অন্যমনস্ক হয়ে বলল। সে যেন কী ভাবছিল।
“আমি চলে এসে আপনাদের রসভঙ্গ করলাম। এদিক দিয়ে আপনাদের রিসর্টেই যাচ্ছিলাম। ওই মার্ডার দুটি নিয়ে রিপোর্টের লেখার জন্য কিছু কথা বলতে। আপনাদের জঙ্গলে ঢুকতে দেখে একটু কথা বলার লোভে চলে এসেছিলাম।”
“ও ঠিক আছে। তাহলে চলুন। আপনাকে রিসর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“কোনও দরকার নেই। আমি নিজেই যেতে পারব। আপনারা হাঁটতে বেরিয়েছেন, হাঁটুন। আমি সামান্য কিছু তথ্য কালেক্ট করেই চলে যাব। বেশিক্ষণ থাকব না। আচ্ছা আসি, আবার পরে দেখা হয়ে যাবে।” বলে যেমন হঠাৎ এসেছিলেন ভদ্রলোক, তেমনই হঠাৎ করেই চলে গেলেন।
রিমিতা বলল, “ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত তাই না?”
পূষণ অন্যমনস্ক হয়ে কিছু চিন্তা করতে করতে বলল, “হুঁ। আসলে হয়তো আমরা সকলেই অদ্ভুত, কিংবা পরিস্থিতির চাপে পড়ে অদ্ভুত আচরণ করছি।” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content