সোমবার ৩ মার্চ, ২০২৫


ফাদার স্যামুয়েল একা বসে আসছেন ফাঁকা চার্চে। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন প্রভু যীশুর পায়ের কাছে বেদির ওপর জ্বলতে থাকা মোমবাতির দিকে কুড়িটা বছর পিছিয়ে যাচ্ছে স্মৃতি…

দুলাল সেন ওয়েলেসলি জুটমিলে টাইম অফিসের কর্মী। এছাড়াও দুলালের একটা বড় পরিচয় সে একজন লড়াকু নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক কর্মী। জুট মজদুর ইউনিয়নের নেতা। এখন মধ্যবয়সী, কিন্তু তার ছোটবেলা থেকেই দুলাল অত্যন্ত জনপ্রিয় এক চরিত্র। মানুষের বিপদে-আপদে সর্বদা সকলের পাশে। কৈশোর থেকে যুবকবয়সে খুব ভালো আবৃত্তি করত, অল্পস্বল্প নাটকও করেছে। তারপর আচমকাই দুলালের বাবা মারা গেলেন।
অমৃতলাল সেন। হাইস্কুলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তিন মেয়ে দুইছেলে স্ত্রী বিধবামা আর নিজেকে নিয়ে মোট আটজনের পরিবার। স্কুলের মাইনেতে চলে না। তাই স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে একনাগাড়ে টিউশনি করতে হতো অমৃতস্যারকে। অঙ্কের ওপর ইনজেকশন নেবার মতই একটা সামাজিক ভয় আছে। খুব কমসংখ্যক ছাত্রছাত্রীরা এই ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারে।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৬: আকাশ এখনও মেঘলা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯o: ছাতারে

বাঙালি সমাজে প্রথম থেকেই আরও একটি মূল্যবান বিশ্বাস চালু ছিল। গোড়া থেকে ভালো করে ইংরেজিটা না শিখলে জীবনে কিছু করে উঠতে পারা মুশকিল। এই ধারণা থেকেই বাঙালিরা জাত হিসেবে ইংরেজি ভাষাটা খুব মন দিয়ে পড়েছে। স্কুলের উঁচু ক্লাসে শুধু অঙ্ক করালেও মাঝেমধ্যে নিয়মিত টিচারের অনুপস্থিতিতে ইংরেজিও পড়াতেন অমৃতলাল। ক্লাস ফাইভ সিক্স সেভেন-এ তো নিয়মিত ক্লাস নিতে হতো। প্রাইভেট টিউশনিতে ইংরেজি আর অংক পড়ানোর ফলে তাঁর চাহিদা ছিল প্রবল। ছোটবাড়ি তাই একসঙ্গে অনেককে পড়ানোর সুযোগ ছিল না, ভোরবেলা থেকে স্কুলে যাবার আগে পর্যন্ত আর বিকেলে স্কুলছুটির পর থেকে সন্ধে পেরিয়ে রাত—অমৃতলাল সেন সাইকেল নিয়ে এ পাড়া ও পাড়া চষে বেড়াতেন।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৫: সরজমিনে

কাকভোরে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়তেন ছটা থেকে নটা এই তিনটি ঘণ্টায় তিনটি টিউশনি সেরে বাড়ি ছুঁয়ে স্কুল। বিকেলে দু-দফায় ছজন করে বারোজনের কোচিং সেরে সপ্তাহে তিন দিন করে ভাগাভাগি করে দু-দুটি প্রাইভেট টিউশন। বারবার মানা করা সত্ত্বেও মাস্টারমশাইয়ের জলখাবার বন্ধ হতো না, ফলে অমৃতলালের ক্ষুধা-তেষ্টা এ বাড়ি ও বাড়িতে মিটে যেত। শুধু রোববার দিনটা ছুটি, কিন্তু ছুটি থাকত না। সে সময়ে নানান স্কুলের অনেক শিক্ষক পাঠ্যবই বা সহায়িকা বইপ্রকাশ করতেন সেগুলির প্রুফ দেখার উপযুক্ত মানুষ ছিলেন অমৃতলাল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’

এ ভাবেই অসম্ভব অভাবের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করে অমৃতলাল সেন তার পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন। আর্থিক অসঙ্গতিকেই সঙ্গী করে বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিলেন। তাদের একজন স্কুল ফাইনাল আর একজন হায়ার সেকেন্ডারি পাস। নিজে মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন মেয়েরা বিএ পরীক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে যাক। কিন্তু মা, স্ত্রী বা পাঁচজন শুভানুধ্যায়ীর কথা মেনে অমৃতলাল আর তাদের বিয়েতে না বলবার সুযোগ পাননি। বড়ছেলে দুলাল যখন বিকম পরীক্ষায় পাস করল, সেদিন অমৃতলাল আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। ছেলেকে বলেছিলেন ‘যত কষ্টই হোক তুই এমকমটা কর’!
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৩: নির্বাসিত অর্জুনের দাম্পত্যজীবনে নতুন সম্পর্কের বিচিত্র সংযোজন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

দুলাল চেষ্টা করেছিল কিন্তু আচমকা দুর্ভাগ্য তার চেষ্টার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল।

ফাদার স্যামুয়েল চার্চে আসার আগে এখানে ছিলেন ফাদার মরিস। তাঁর সঙ্গে শিক্ষক অমৃতলাল সেনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর কাছ থেকেই অমৃতলাল সেন এবং তার পরিবার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছেন ফাদার স্যামুয়েল।

সেই সময় মানে ১৯৭৮-৭৯ সাল নাগাদ গ্রাম বাংলায় শহরতলির পরিবেশটা একেবারে অন্যরকম ছিল। পড়াশোনা খেলাধুলো গান-বাজনা এসবের মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে বড় হচ্ছিল একটা প্রজন্ম। প্রেম ছিল স্নেহ ছিল। শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা ছিল। ক্রুরতা শঠতাও ছিল। রোগজ্বালা অভাব অভিযোগ ছিল। আর তার সঙ্গে পারিবারিক ও সমাজ জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল মূল্যবোধ। ভালো আর খারাপের তফাতটা সাদাকালোর মতো স্পষ্ট ছিল। সে সময় মধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবনের একটা অন্যরকম মর্যাদা ছিল। খ্যাতি পরিচিতি প্রতিপত্তির মোহ বা আকর্ষণ সবই ছিল, কিন্তু সেটা নিষ্ঠাকে কখনওই দুর্বল করে দিত না।—চলবে।

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পরের পর্ব আগামী রবিবার ৯ মার্চ, ২০২৫

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content