শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

বাস অমনভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে থামতে অনেকেই বাসের মধ্যে ছিটকে গিয়েছিল। তারা সকলেই ‘বাপ, মা’ তুলে মঙ্গল মাহাতোকে খিস্তি দিতে আরম্ভ করল। সেই সঙ্গেই যাকে দেখা যায় না, কাজের মধ্যে দিয়ে অনুভব করা যায়, সেই সরকারকে। সরকারকে কেউ দেখেনি, এমনকি কেউ যে আছে, তারও হালহদিশ কেউ করতে পারেনি আজ অবধি। অতএব তাকে খিস্তি দিতে দেরি করল না তারা।
রিমিতা আর পূষণের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি লেগেছিল। সেই কারণে বিরক্ত হয়ে সে পূষণকে একটু রেগে বেশ জোরেই ঠেলে দিল। পূষণ পড়ে যাচ্ছিল। সামলে নিল কোনওরকমে। বলল, “আরে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ কেন? ড্রাইভার ওভাবে ব্রেক না কষলে কী ঠোকাঠুকি লাগত? বেশ একটা সেক্সি মুড এসেছিল, দিল ডেসট্রয় করে!” বলে চাপা খিস্তি দিল।
“তোমাকে কে বলেছিল, ওইসব অসভ্যতা করতে?” রিমিতা কড়া গলায় বলল।
“লে হালুয়া! নিজের ভাবি বউকে একটু আদর করবো, একটু ঘপাঘপ করবো, তার জন্যই তো আসা! তাতেও যদি না করে বসো, তাহলে আমি কাল সকালেই ফিরে যাব। গিয়ে নামাবলি কিনে গায়ে জড়িয়ে মায়াপুর-নবদ্বীপে যাবো।”
“নাটক না করে দেখ কী হয়েছে।” রিমিতা কড়া গলায় বলল।
“আরে, কী হবে আবার? ওঠা ইস্তক দেখলে না, এরা সাধারণ ব্যাপারকে কত বড় করে তোলে? হয়তো দেখবে, একখানি হরিণ বাচ্চা-সহ রাস্তা পার হচ্ছে, তাতেও এরা সবাই উত্তেজনা খোঁজে। সেরকমই কিছু হয়েছে হয়তো!”
“তা হোক বা না-হোক, তুমি নেমে দেখবে না?”
“বউকে দেখেই চোখ ক্লান্ত। আর কাউকে দেখতে বলো না ডার্লিং!”
রিমিতা রাগ দেখায়, তার গলায় সতর্কতার সুর, “আবার?”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২: এসেছে দৈব পিকনিকে

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি

বাসের মধ্যে অনেকেই তখন হল্লা জুড়েছিল। বাসটাও থেমে গিয়েছে তো গিয়েছেই। মঙ্গল মাহাতোর উত্তেজিত গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল নীচ থেকে। বাসের অনেকেই তখন নেমেও পড়েছে। এমনকি ড্রাইভারও। পূষণ নেমে পড়তে বাধ্য হল। যাওয়ার আগে রিমিতাকে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বসে থাকো। আমি দেখে আসছি কী হয়েছে! এমন কী কাণ্ড ঘটল যে, সকলে নেমে হল্লা করছে! দেখা যাক!”

রিমিতা হবু বরের হাত ছুঁল, বলল, “কী আবার ঘটবে। কোনও গরু-ছাগল রাস্তা পার হচ্ছিল, দেখ গিয়ে ধাক্কা মেরেছে বাস। কাটাও পড়তে পারে। এসব জায়গায় গরু-ছাগল হল মানুষের ফিনান্সিয়াল স্ট্যাটাসের প্রাইমারি সোর্স। সে কারণেই ওরা হয়তো হল্লা জুড়ে দিয়েছে। না হলে যার গরু-ছাগল, সে মেরে একেবারে মদন বানিয়ে দেবে।”
পূষণ বলল, “হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখ রিমিতা, এসব জঙ্গলঘেরা জায়গায় সন্ধ্যে নেমে এসেছে প্রায়, এখনও যার গরু কিংবা ছাগল, সে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না! এ অসম্ভব বলে মনে হয় না তোমার?”
‘হয়তো সে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই গরু কিংবা ছাগলটাই পথ হারিয়ে এখানে এসে পড়েছে, এমনটাও তো হতে পারে?”
‘পারে। দেখা যাক, কোনটা হয়েছে? যদি তোমার কথা মেলে, তাহলে আজ রাতটুকু আমি ব্রহ্মচারী হয়ে কাটাবো। যদি না মেলে, তাহলে আজ রাতে তিন রাউন্ডের জন্য তৈরি থেকো।” বলে অসভ্যের মতো হাসতে হাসতে বাসের পাদানি বেয়ে নীচে নেমে গেল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৫: “এই যে যন্ত্র দেখছিস, এটা সেগুন কাঠের, এখান থেকেই সুর আসে…”

ছোটদের গল্প: রূপসীর চোখে

নামতে নামতেই শুনল কেউ বলছে, “হায় রাম! ই তো কুনো শহুরে বাবু লারছে! মাথটা পুরা চিবাইন খাইঞ্চে! উ কালাদেও আবার বেরেঞ্চে রে!”
আর-একজন উত্তর দিল, “আমি বলচি, ইটো চিতার কাজ। হুই সেদিন ফিরার সময় আমি বললাম না যে, জঙ্গলের মধ্যে একটা হলুদ-কালো ডুরা দেওয়া কী ঢুকে গেল! ইটা সেই চিতার কাজ!”

পূষণ তাকিয়ে দেখল, সামনে একটা জায়গা গোল করে ঘিরে সকলে উত্তেজিত হয়ে নিজের নিজের মত বিনিময় করছে। বুধন মাহাতোকে দেখা গেল না। সে হয়তো ওই মানববৃত্তের মাঝামাঝি আছে। পূষণ এগিয়ে গিয়ে সামনেই যাকে পেল, তাকে জিজ্ঞাসা করল সে, “ভাই, কী হয়েছে? কেউ চাপা পড়ল না কি?”
লোকটার গায়ের রঙ আবলুশ কাঠের মতো কালো। সন্ধ্যের সিল্যুয়েটে সে যেন মিশে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় লোকটা বলল, “কালাদেও একটা লুকের মাথা চিবাইন খাইঞ্চিল। বাস আসতে পুরা খেতে পায় নাই। পলাইন গেঁইছে। আবার পরে আসবে, বাকি লাশটাও গায়েব করে দেবে!”
পূষণ অবাক হয়ে বলল, “কালাদেও? সে কে? আর সে একজন মানুষের মাথা চিবিয়ে খেয়েছে মানেটাই বা কী?”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৮: জ্বরে ভাত খাবেন?

চলো যাই ঘুরে আসি: মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড় নয়, আমাদের এই বাংলাতেই রয়েছেন ডোকরা শিল্পীরা

লোকটা হাত তুলে সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, “সামনের দিকে দেখেন না কেন বাবু! উখানে তো মুণ্ডুচিবানো লাশ পড়ে আছে। আহা গো, কোন ট্যুর পার্টি হবে। পাশে আপনাদের মতো ব্যাগ আর ক্যামেরাও পড়ে আছে। তবে সে-সব এখন রক্ত মাখা। মাথা কেটে খেয়েছে তো কালাদেও। চারদিক যেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে বট্যে!”

পূষণ চমকে গেল, মুণ্ডুচিবানো লাশ! এ তো পুলিশ কেস। কিন্তু এরা এতো নির্বিকারভাবে বলছে যে! যেন এমনটা ঘটা কোন অসম্ভব ব্যাপার না। পুলিশ ডাকছে না কেন?”
“ভাই, সত্যিই যদি কেউ ওই ভাবে মারা গিয়ে থাকে, পুলিশ ডাকছেন না কেন আপনারা?”
“পুলিশ!” লোকটা হাসল, “পুলিশ কী পাত্তা দেবে ভাবছেন বাবু? তাইড়ে দেবে! এমন ঘটনা এ-মুলুকে মাঝেমধ্যেই ঘটে। চিতায় খাওয়া লাশ বলে পুলিশ সব ধামা চাপা দিয়ে দেয়। দেখবেন, এতেও দেবে। এ-কী আর আপনাদের শহর বাবু? আঁধারদেও গ্রাম। এখানে কালাদেওর রাজত্ব। আপনি আজ এলেন বুঝি? গ্রামদেবতার মন্দির দেখে নেবেন। আমার নাম, ঈশ্বরীপ্রসাদ। আমি ওই মন্দিরের পুরুতের ছেলে। গেলে, দর্শন করিয়ে দেবো, যা খুশি হয়ে দিতে চান দেবেন।”
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে শিশুদের মধ্যে! ভাইরাস এড়াতে খুদের পাতে কী কী রাখবেন?

ষাট পেরিয়ে: পর্ব-২৪: বয়সেও আসুক বসন্ত

পূষণ বিরক্ত হল। সামনে একজনের লাশ পড়ে আছে বলছে, কিন্তু এই অবস্থাতেও দেবতাকে নিয়ে ব্যবসা করতে ছাড়ছে না লোকটা! হাইলি সাসপিশাস! একে কালচার করা উচিত। কালাদেওর গপ্পো ছড়িয়ে এ-কোনও সত্যকে আড়াল করতে চাইছে হয়তো! সে এগিয়ে গেল, “মঙ্গল! মঙ্গল! এই সরো সরো! কী হয়েছে আমায় দেখতে দাও।”

সে ক’পা এগিয়েছে, এমন সময় কেউ চেঁচিয়ে উঠল, ঈশ্বরীপ্রসাদও হতে পারে, “আরে আরে, উ আবার কে? জঙ্গলের মধ্যে ছুটে পালাল? আরে কে রে? ধর ধর ধর!”
সকলে তার চিৎকারে ঘুরে দাঁড়াল। পূষণও। —চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content