শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

বাসটা খুবই শম্বুক গতিতে এগোচ্ছিল। আসলে হয়তো দ্রুত যেতে পারলেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। কিন্তু তা হওয়ার জো নেই। একে রাস্তা খুব খারাপ, জায়গায় জায়গায় পিচ উঠে গিয়ে লাল খোয়া মাটি দেখা যাচ্ছে, তার উপর সারা রাস্তা জুড়েই বড় বড় গর্ত। ফলে সে এমন ভাবে এগোচ্ছিল, যেন স্লো-রেসে নাম লিখিয়েছে। কম্পিটিশন চলছে, কোনওমতেই তার তাড়াতাড়ি যাওয়ার জো নেই। কিংবা হতেও পারে, এরপরেই সে জলে নেমে জাহাজ হিসেবে বাকি জীবন জনগণকে সার্ভিস দেবে। সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে জাহাজ যেমন এদিক-ওদিক দোলে, বাসটাও তেমনি বিপজ্জনকভাবে দুলছিল।

এক-একবার কোন একদিক করে এমনভাবে কাত হচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি উল্টে গিয়ে দু’পাশের জঙ্গলে ধাক্কা মারে। রাস্তার দু-ধারের শাল-সেগুন-পিয়াল-আকাশমণির গাছ, কিংবা কুসুম ফুলের গাছ রুদ্ধশ্বাসে যেন তারই প্রতীক্ষা করছিল। বাসটা ধীরে ধীরে চলতে চলতে মাঝে মাঝেই এক-একটা জায়গায় দাঁড়াচ্ছে, আর বাসের কন্ডাক্টার মঙ্গল মাহাতো মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে বলছে, “সাবধান, সাবধান! বাস পৌঁছ গেলান। বাস পৌঁছ গেলান!” কিন্তু বাস যে কোথায় কোথায় পৌছচ্ছিল, তা না-বলায় রিমিতা বা পুষণের পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না, বাসটা কোন কোন স্টপে দাঁড়াচ্ছে।

পুষণ বিরক্ত হচ্ছিল মনে মনে, একে তো বাসে ওঠার পর এই এক ঘণ্টা দশ মিনিট সে কোনও সিগারেট ধরাতে পারেনি। অথচ, চারপাশের দেহাতি মানুষজন অনেকেই বিড়ি টানছিল অবলীলায়। একবার তার নিজের চোখের সামনে মঙ্গল মাহাতো তাদের একজনের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে নিয়ে ধরিয়ে মৌজ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল, “কুথা থেকে এ বিড়ি কিনচ বটি? দেমাগ তাজা করে দিঁন্‌চেন!”
লোকটা তার জবাবে বলেছিল, “মোদের গাঁয়ে যে মাস্টার আছেন বটে, উয়ো অশোক মাস্টার রে, তার দুকান থেকে কিনা। দাম খানিক বেশি নেয় উয়ো, কিন্তু মাল যা দেয়, উদ্‌মা!”

মঙ্গল মাহাতো বলল, “তুকে টাকা দিইন দিব, মোকে এনে দিস পরের বার যখন আসবি।”

আগের লোকটি সন্দেহ মেশানো গলায় বলল, “তুকে এনে দিব, তকন তুই বলবি, তুর লাগবেক লাই। কিংবা বলবি কী, টাকা পরে লিয়ে যাস! গেলবারের পাঁচ টাকা বাকি এখনও শোধ করিস লাই, মুনে আচে তোর?”

মঙ্গল মাহাতো দাঁত বার করে হাসে, “হ! উয়ো পাঁচ টাকার তরে তুর ঘুম উড়্যা গেচে! লাহয়, উয়ো পাঁচ টাকা তুই আমায় মিষ্টি খেতে দিয়েচিস ভেবে লে না!”

“ক্যানে রে? তুর বউ আবার বিয়োবে না কি যে তুকে মিষ্টি খেতে টাকা দিব? নিজেরাই কতদিন বলে মিষ্টির মুক দেকিনি! আর উনি এলেন কোন রাজা-মহারাজা যে, ওঁকে পাঁচ টাকা দিতে হবে। উ টাকা শোধ না দিলে তুকে বিড়ি কেন, কচুও এনে দিবক লাই!”

পুষণ তাদের কথাবার্তা শুনে বিরক্ত হয়ে আপন মনেই বলল, “ডিসগাস্টিং! জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না! একে বাসের এই অবস্থা, বাস না কি গরুর গাড়ি চলছে বোঝা দায়, তার উপর এদের এই বিরক্তিকর বিষয় নিয়ে ক্লান্তিকর কথোপকথন! উফ!”

রিনিতা জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। বাসে ওঠবার আগেই সে বলেছিল, “আমাকে কিন্তু জানালার ধারের একটা সিট ম্যানেজ করে দিতে হবে!”

পুষণ ইয়ার্কি করার চেষ্টা করেছিল, “তুমি আমাকে দেখবে না কি বাইরের ওই একঘেঁয়ে দৃশ্য দেখবে?”

“ইশ! তোমাকে দেখতে বয়েই গিয়েছে আমার। অসভ্য কোথাকার!”
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-৬: পর্‌সতার

কিম্ভূতকাণ্ড, পর্ব-৩: হঠাৎ মেয়েলি খোঁনা গলায় কে যেন খিলখিল করে হেসে বলল—ভঁয় পেঁলে নাঁকি ঠাঁকুর!

পর্ব-৩, বসুন্ধরা এবং…/২য় খণ্ড: লিখতে বসে সুবর্ণর মনে হয়েছে ‘বসুন্ধরা এবং…’ তার কনফেশন বক্স …

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

আগের দিন রাতে পুষণ ওকে চুমু দিতে গিয়ে তার অধরে এমন ভাবে দাঁত বসিয়েছিল, রিমিতা চেঁচিয়ে উঠেছিল। আনন্দের শীৎকার নয়, ব্যথা লাগার প্রতিক্রিয়ায় বিশুদ্ধ চেঁচানো!
এখনও তার ঠোঁটের নীচটা ফুলে আছে। যখনই সে কোনও পাবলিক প্লেসে যাচ্ছে, তখনই সে ওপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের অধর ঢেকে ফেলছে।

সেই অপরাধবোধ থেকেই সম্ভবত মঙ্গল মাহাতোকে বিশ-পঞ্চাশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিতেই মিরাকলের মতো একটা ভালো জায়গায় সিট জোগাড় করে দিয়েছিল মঙ্গল। পুষণরা যাবে একেবারে বাস যেখানে তার পথচলা শেষ করবে, সেই গন্তব্য অবধি। অনেকটা পথ।

বেড়ানোর গ্রুপটায় লিখেছিল, প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগবে মেইন রোড থেকে। জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা খুব খারাপ। ফলে খুব দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছনোর আশা করা বৃথা। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, আড়াই ঘণ্টার কমে এই রুটে কখনও বাস বা ট্রেকার যেতে পারবে না। এতটা পথ নিজের হবু বউয়ের জন্য একখানা জানালার সিট যদি না সে জোগাড় করে দিতে পারে, তবে সে কিসের প্রেমিক? এখন মঙ্গলকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই।

মঙ্গল অবশ্য সত্যিই ম্যাজিক জানে। পুষণ দেখল, সেখানে যারা বসেছিল, তাদের কানে কানে মঙ্গল কী সব বলতেই তারা দ্বিরুক্তি না করে উঠে গিয়ে অন্যত্র বসল। দেখে পুষণ মনে মনে ভাবছিল, এটা যদি তাদের কলকাতা হতো, এতক্ষণে হাতাহাতি লেগে যেত, এক-আধটা লাশ পড়লেও কেউ আশ্চর্য হতো না।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৬: প্রকৃতি নিয়ে পর্যটন

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫: মেরুর দিকে পৃথিবী কিছুটা চাপা, তাই এখানে দুটি কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যেও সূর্যালোকের পার্থক্য অনেকটা

হেলদি ডায়েট: কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন? সুস্থ থাকতে কোন ১০টি ফল খাবেন?

সে তখনই গর্বের সঙ্গে বলেছিল, “আমি মঙ্গল মাহাতো আছি স্যার। কোনও অসুবিধা হলে বলবেন। এ তল্লাটে মঙ্গলকে কেউ চেনে না, তেমন কেউ লাই স্যার!”

“বাঃ!” পুষণ ঠাট্টা করেছিল, “তাহলে তো তোমাকে একজন কেষ্ট-বিষ্টু বলতে হয়!”
বুঝতে না পেরে মঙ্গল বলেছিল, “আজ্ঞে!”

“বলছি, তুমি একজন নেতা গোছের মানুষ। সকলেই এক ডাকে চেনে !”

মঙ্গল মাহাতো ভারি খুশি হয়ে বলেছিল, “আপনাদের আশীর্বাদ ছ্যার!”
সে-সব কথা ভাবতে ভাবতে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর ম্যাচবক্সটা বার করে ধরাতে যাবে, এমন সময় রিমিতা কড়া গলায় বলে উঠল, “ওঃ! এই ব্যাপার!”

পুষণ একটু থমত খেয়ে বলল, “কী হল? এই ব্যাপার মানে?”

“অনেকক্ষণ সিগারেট খেতে না পেরে তুমি একেবারে হেদিয়ে মরছো, আর ওদিকে সবাই বিড়ি-টিড়ি খাচ্ছে দেখে একেবারে ফাস্ট্রু খেয়ে গিয়েছ, সেই জন্যই তোমার এত বিরক্তি! জানো না, বাসের মধ্যে বিড়ি-সিগারেট বারণ?”

“তোমার চারপাশটা একবার দেখো মামনি! সবাই মনের সুখে “বিড়ি জ্বালাইলে” করছে। আর আমি শহুরে শিক্ষিতবাবু, ‘বাসের মধ্যে ধূমপান নিষেধ’—এই সতর্কীকরণ মেনে ভিজে বেড়ালের মতো বসে আছি। তাও যদি একটু চুমু খেতে দিতে…!” কথা শেষ করল না পূষণ, ঠোঁট দিয়ে চুমু খাওয়ার ভঙ্গি করল, সেই সঙ্গেই অশ্লীল একটা ইঙ্গিত করল। করেই হেসে উঠল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

দশভুজা: সুন্দরবনের অনেক শিশুর শিক্ষার অধিকার রক্ষায় ব্রতী এই শিক্ষিকা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৬: কানে খোল, তেল দেন?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৩: মোর সাধের বাসরে ঘটল ‘গৃহ প্রবেশ’

রিমিতা সজোরে চিমটি কাটল, “খুব অসভ্য হয়েছ না?”

“আরে অসভ্য আর হতে দিচ্ছো কই? ব্যাগ বয়ে এতগুলো কনডোম আনলাম, একটা বই পরশু থেকে তো আর খরচ হয়নি। এরপর বাকি কটা বাড়িতে না ফেরত নিয়ে যেতে হয়!” বলে আক্ষেপের মিথ্যে ভঙ্গি করল সে।

রিমিতা বলল, “তাহলে তোমার এখানে আসা ওই উদ্দেশ্যে? সুন্দর বনভূমি, আজিব টিলা, আহামরি ঝর্না আর তার প্রেক্ষাপটে ছবির মতো এক রিসর্ট—এ সবই আসলে সেকেন্ডারি ব্যাপার! তাই তো?” কপট রাগে রিমিতাও কম যায় না।

পূষণ বাসের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। সকলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় মগ্ন। বাইরের আলো প্রায় নিভে এসেছে। বাসের মধ্যে আলো আছে কি না সে জানে না, তবে মঙ্গল এখনও সে আলো জ্বালাবার কোন দরকার বোধ করেনি। এই অবস্থায় আর কিছুদিন পরেই বিয়ে করবে যে যুগল, তাদের কেউ যদি অপরজনের কোমরে হাতের বেড় দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়, তাকে দোষ দেওয়া যায় না। পূষণকেও দেওয়া গেল না। রিমিতা তাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু পারল না। তারপর অসহায় কিন্তু আনন্দিত আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কি-ই বা সে করতে পারে?

পূষণের অবাধ্য হাত অজান্তেই রিমিতার বুকে উঠে এসেছিল, অস্থির হাত চঞ্চল হয়ে উঠতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বাস থেমে গেল। মঙ্গলের গলা শোনা গেল, “হায় বুরুংবাওয়া, উটা কী বটে?” তার গলার আওয়াজ কেবল আওয়াজ না, আর্তনাদ।—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ

Skip to content