বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ঘোমটা (ক্রমশ)

—স্যার একটা কথা, এটা খুন বলে পুলিশ থেকে কিছু বলা হয়েছে?
— নো। আমরা কিছু না দেখে এটা বলি কী করে!
— কিন্তু মিডিয়া তো সকাল থেকেই খুন বলছে।
— ওখানেও দীপক চ্যাটার্জি রতনলাল আছেন তো।
একতলায় কলতলা রান্নাঘর দোতলায় দুটো ঘর। যাই হোক সুষমার স্বামী শান্তিলাল কর ছোট হলেও সুন্দর করে বাড়িটা করার চেষ্টা করেছেন। জমি বেশি নয়। বারান্দা নেই রাস্তার দিকে

বিছানায় পড়েছিলেন সুষমা কর। বছর ৬৫/৬৬ হবেন মনে হল। একটু ভারী চেহারা। ডায়াবেটিস ছিল। বালিশের পাশে গ্লুকোমিটার রাখা। কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। ফরেন্সিক না করলে মৃত্যুর সঠিক কারণ বোঝা যাবে না। ঘরের মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা নজরে এলো না। শ্রেয়া বাসু নিয়মমাফিক ফরেন্সিককে নিয়ে ঘরের এবং মৃতদেহের ছবি নিলেন। মৃত্যুর দিন মৃতা সুষমা কর একাই বাড়িতে ছিলেন। কাজের মেয়েটি ছিল। বৌমা আর ছেলে গিয়েছিল লেকটাউনে বৌমার বাপের বাড়িতে। খবর পেয়ে তারা সকালবেলা ছুটে এসেছে। ছেলেটির স্ত্রী খুব কান্নাকাটি করছে। ছেলেটি গুম হয়ে বসে আছে। মৃতদেহ নিয়ে যাবার পর ঘরটা খালি হল, তখন একবার ভালো করে চোখ চালিয়ে দেখলো ধৃতিমান। অনেকগুলো ক্ষেত্রে ঠিক এই সময়টাতে বিশেষ ক্লু পাওয়া যায়। পাওয়া গেল। খাটের তলায় পড়ে থাকা দুটো গ্লুকোমিটারের স্ট্রিপ। এই স্ট্রিপগুলোতে প্রায়ই খুব এরর দেয়। পকেটে রাখা টিস্যু পেপার দিয়ে আলতো করে তুলে নিল ধৃতিমান।
আরও পড়ুন:

হ্যালো বাবু! ঘোমটা, পর্ব-২: মৃতদেহ যখন স্পটে পড়েছিল, তখন অস্বাভাবিক মৃত্যুই

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

আশপাশের লোকজন এবং মৃতা সুষমা করে ছেলে পল্লব আর বৌমা বিউটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল পল্লবের বাবা মানে বিউটির শ্বশুরমশাই শান্তিলাল করের ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবসা ছিল।নিজের ব্যবসা নয়। পাওয়া। প্রহ্লাদ প্যাটেলের ডিস্ট্রিবিউশনের কোম্পানির সর্বের-সর্বা ছিলেন শান্তিলাল। ফিল্ম সংক্রান্ত নানা রকমের ব্যবসা ছিল প্যাটেলজির। দু’-দুখানা হলের মালিকানা একটা প্রোডাকশন কোম্পানি। মানিকতলায় বিরাট বাড়ি ছিল। শান্তিলাল খুব কর্মঠ এবং বিশ্বাসী। ছবি ডিস্ট্রিবিউশন-এর ব্যাপারে প্রহ্লাদ প্যাটেল শান্তিলালের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন।বেশ কয়েকবার শান্তিলালের কথা মেনে প্যাটেলজির প্রভূত লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল। সে জন্য অবশ্য তিনি শান্তিলালকে পুরস্কৃতও করেছিলেন। সব ঠিকঠাক ভালোভাবেই চলছিল।
প্রহ্লাদ প্যাটেলের একমাত্র মেয়ে আচমকা রাস্তা পার হতে গিয়ে বাড়ির ঠিক সামনেই দুর্ঘটনায় মারা গেল। এতটাই দুর্ভাগ্য যে প্যাটেলজির স্ত্রী সেই সময় বারান্দায় বসে। এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তে কলকাতার সমস্ত কিছু বিক্রি করে সস্ত্রীক পাকাপাকিভাবে গুজরাতবাসী হয়ে গেলেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে আর্থিক দেনাপাওনা হলেও শান্তিলাল করকে তিনি ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসাটা এমনিতেই দিয়ে গেলেন। শ্রেয়া বাসু ছেলে বৌমা কাজের মেয়ে এদের রুটিন ইন্টারোগেশন করছিলেন। ভৈরব দত্ত শ্রেয়ার নির্দেশ মতো ঠিক পাশের বাড়ির কাকু কাকিমাকে ডেকে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। বাড়ির লোকের প্রশ্নোত্তর হয়ে গেলে তাদের পালা। ধৃতিমান চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল। মন দিয়ে শুনছিল প্রত্যেকের কথা। ছোটবেলায় মা বলতেন
—বাবু গণপতির মূর্তি দেখেছো।
—ছোট ছোট চোখ আর বড় বড় কান ।
—সবকিছু খুব খুঁটিয়ে দেখবে আর সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনবে। গণেশ আমাদের এই শিক্ষাই দেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

মৃতা সুষমা দেবীর ছেলে পল্লব এখনও গুম হয়ে আছে। কথা জিজ্ঞেস করলে একটা দুটো উত্তর দিচ্ছে। বৌমা’র কান্না থামছে না। বাবু মানে আমাদের ধৃতিমান একটা ব্যাপারে বেশ অবাক হল। জবানবন্দির কোন গরমিল নয়! তফাতটা শ্রেয়ার। তার যা স্বভাব তাতে এতক্ষণের ক্রমাগত কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে তার দু-তিনবার টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে ওঠা উচিত। কিন্তু কি আশ্চর্য আজ শ্রেয়া বাসু একেবারে চুপচাপ। হতে পারে শ্রেয়া তার বদমেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। হতে পারে সে কোনও সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং নিচ্ছে। আজকাল লোকে হাতে কানে ব্যথারমতো – মনের সুবিধা অসুবিধেরও চিকিৎসা করিয়ে নেয়। বাড়িতে এরকম একটা মৃত্যু। কাছের মানুষদের উপর একটা ধাক্কা তো বটেই।
এরমধ্যে বাবুর শোবার ঘর দুটো একবার দেখে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে আলমারি খুলে সব দেখেশুনে বউমা বিউটি জানিয়েছে যে কিছু খোওয়া গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। দুটো ঘরেই দুটো বড় বড় জানলা। ওপরে নিচে আলাদা কাঠের পাল্লা মোটা লোহার গরাদ বসানো। যেমন তৈরি হয়েছিল। শান্তিলালবাবু মারা যাওয়ার পর আর এ বাড়িতে কোন খরচাপাতি করা হয়নি। ছেলে বৌমা ছিল না তাই তাদের ঘরের জানলা বন্ধ ছিল। কিন্তু সুষমা দেবীর ঘরে দুটো জানালার উপরের পাল্লা খোলা ছিল। নিচের জানলাটা খুলে দিলে গোটা ঘরটা একেবারে রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। ছেলে বৌমার ঘরে লম্বা পর্দা টাঙানো আছে। সুষমা দেবীর ঘরে কোনও পর্দা নেই। বাবু দেখল জানলা দিয়ে সরাসরি ওপারের ইস্ত্রিওয়ালার চাকালাগানো মাথাঢাকা ঠেলাগাড়িটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার উপর দোকানকরা মানা। তাই আইন বাঁচিয়ে এই চাকা লাগানো ঠেলাগাড়ির ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৩: উইলসন-এ-কথা

রকম-রকম, হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২১: একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে/ কী ছিল বিধাতার মনে

প্রায় সব ক্ষেত্রেই নামকরা গোয়েন্দারা যেরকম পুলিশের থেকে এককদম এগিয়ে থাকেন, বাবু তেমন পেশাদার গোয়েন্দা তো নয়। সে শখে গোয়েন্দাগিরি করে। পেশাগতভাবে সে একজন চিত্রপরিচালক লেখালেখি করে। গোয়েন্দাগিরি করে মগজের ধারটাকে বজায় রাখতে। তাই পুলিশের সঙ্গে তার সহাবস্থান। সে মন দিয়ে জবানবন্দি শোনে। ক্লুগুলো পরপর সাজিয়ে রহস্য সমাধানের দিকে এগোয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, কখনও শ্রেয়া বাসু কখনও ভৈরব দত্ত কখনও বা স্বয়ং ভৈরব চক্রবর্তী তাকে হেল্প করে। সকলে মিলে বা কখনও কখনও বাবু একাই রহস্যের সমাধানে পৌঁছে যায়। আজ যেমন সে শুধুই শুনলো। পল্লব বিউটি পাশের বাড়ির কাকু কাকিমা কাজের মাসি মলিনা। কাউকে একটিও প্রশ্ন করেনি।—চলবে

* সুষমা কর হত্যারহস্য: পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩

* হ্যালো বাবু! (Hello Babu) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ২য় খণ্ড।

Skip to content