রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

সিরিজ-১: ঘোমটা (অন্তিম পর্ব)

কথাগুলো শোনার পর পল্লবের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ক্রমাগত ভাবলেশহীন থাকার যে চেষ্টাটা সে করছিল সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হল না। শ্রেয়া গড়গড় করে বানানো কথা বলবার সময় আড়চোখে সেটা লক্ষ্য করছিল।

— আপনার ওই ডিজায়ার গাড়িটার সেই রাতে লেকটাউন থেকে মুচিপাড়া আরিফ রোড আসা আবার ফেরত যাওয়া। এই কিলোমিটারটা ম্যানেজ করতে গিয়ে আপনার অফিস রেকর্ডের খাতায় একটা ফলস কার রেন্টালের এন্ট্রি করেছেন। আমি গিয়ে সব খাতার জেরক্স নিয়েছিলাম মনে পড়ছে? যেখানে যে সময় এন্ট্রি করেছেন সেখানকার রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজে কোথাও আপনার ওই গাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে না। তাই আমি আপনাকে আবারও অনুরোধ করছি যা যা ঘটেছিল যে যেভাবে খুনটা হয়েছে পরিষ্কার বলুন। না হলে যেটা করব সেটা হচ্ছে না, আপনাকে প্রথমে মারধর করবো না। আপনার বউয়ের পাট বিছিয়ে দেবো। আপনার উকিল কোন রাজনৈতিক দাদা কিস্যু করতে পারবে না। মারধরের কোথাও কোনও এভিডেন্স থাকবে না। ভিডিওগ্রাফিতে দেখা যাবে আপনারা বসে সব কনফেস করছেন। আপনাকে আমি সময় দিয়ে গেলাম মনে মনে ঠিক করে নিন আপনি কি করবেন আগেই সব বলবেন নাকি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আমার ইন্টার-অ্যাকশন হওয়ার পর বলবেন।
এতটুকু সময় না দিয়ে শ্রেয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কনস্টেবল ভৈরব দত্তকে বলে এলো পল্লবকে নজরে রাখতে। এবার শ্রেয়া গিয়ে ঢুকলো বিউটির সেলে।

—আপনার স্বামী আমাকে অনেক করে রিকোয়েস্ট করছিলেন যাতে আমি আপনাকে মারধর না করি। কারণ মার দিতে শুরু করলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। খোঁজ নিয়ে দেখবেন এ বিষয়ে আমার নাম খুব খারাপ। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন তাহলে কথাবার্তার মধ্যেই ব্যাপারটা মিটে যাবে। হাত চালাতে হবে না।

পল্লব প্রথম থেকেই চুপচাপ।পল্লবের থেকে বিউটির কলেজের রোজগার অনেকটা বেশি আর সেটা মাসে মাসের বাঁধা রোজগার। তাই বিউটি উদ্ধত। সে বাড়িতে কথাটা বেশি বলে। আর মহিলারা মহিলাদের কর্তৃত্ব খুব একটা সহ্য করতে পারেন না। তাই বিউটি ভাবল ডিফেন্সিভ নয়। অফেন্সিভ খেলা খেলবে।

—দেশে আইন কানুন আছে আপনি আমাকে মারধর করতে পারেন না।
শ্রেয়ার মাথার থার্মোকাপল চালু হয়ে গেল।

— কীআছে? আইনকানুন? একজন বৃদ্ধা মহিলাকে বিষ দিয়ে খুন করেছেন তারপরে সেই দোষটা একজন নিরাপরাধ কাজের মহিলার উপর চাপাবার চেষ্টা করছেন আপনি আইন-কানুন কপচাচ্ছেন?

—এগুলো আপনারা অভিযোগ করছেন। একটাও প্রমাণ হয়নি?

—দেখুন আমি আপনাকে ঠান্ডা মাথায় অনুরোধ করছি বেশি কথা না বলে যে কথাটা বললে আপনার এবং আপনার স্বামীর সুবিধা হবে সেটা বলুন।

—আমরা এই খুনের ব্যাপারে কিছু জানি না। সকালে খবর পেয়ে দেখতে এসেছিলাম। আপনারা আমাদের শুধু শুধু হ্যারাস করছেন। আমি উকিল ছাড়া কোনও কথা বলবো না।

—খুব সিনেমা দেখেন না? এসব ডায়লগবাজি সিনেমা সিরিয়ালে হয়।

—আমি কি বলবো সেটা আপনি আমায় বলে দেবেন? পুলিশের চাকরি করেন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি?
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৯: দোতলার জানলা থেকে সুষমাকে চিনে ফেলেছিল ইস্ত্রিওলা শ্যামলাল

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪৫: নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায়

মুখে না দিয়ে উত্তর দিল শ্রেয়ার বাঁ হাতের একটা থাপ্পড়।

—এমন ক্যালান ক্যালাবো না, টয়লেটে বোসতে পারবি না। এখানে কিন্তু কমোড নেই। এখনই তোর হাজব্যান্ডকে আমি বলে এসেছি, তোর উকিল রাজনৈতিক দাদা নেতা কেউ কিস্যু করতে পারবে না। আইনের খাতায় সব লেখা আছে। লেখা আছে থানায় স্টেটমেন্টের জন্য খুনের বদমাইশ চোরজোচ্চরদের জামাই আদর করতে হবে। লেখা আছে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেবার পর আদালতে দাঁড়িয়ে বলা যাবে ধর্মাবতার পুলিশ আমাকে মারধর করে জবানবন্দি নিয়েছে।

আদালত পুলিশের জবানবন্দি তখন মানবে না। সব লেখা আছে। লেখা আছে মারধোর নয় বুঝিয়ে মনের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এখন সমস্যা হচ্ছে তোদের মত হাড়বজ্জাতদের বোঝাতে গেলে যে সময়টা লাগবে সেটা আমাদের হাতে নেই। আর অপরাধের তদন্ত সঠিক সময় না হলে টেলিভিশনের পর্দায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দীপক চ্যাটার্জি এবং রতনলালরা বসে পড়বেন। তাই পুলিশের ব্যাকরণ বইতে আইনকানুন হল কর্মধারয় সমাস। যাহাই আইন তাহাই কানুন।

শ্রেয়া নিজেকে এখন অনেক বদলে ফেলেছে। হাতে মারধর করার আগে সুকৌশলে ভয়ংকর মারধরার ভয়টা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। বড়কর্তা ভৈরব চক্রবর্তী মজা করে বলেন শ্রেয়ার নতুন এমআরআই মাথায় দেয়। ‘মারে রাঙানো ইনজেকশন’। খুব এফেক্টিভ।

সত্যিই এফেক্টিভ। প্রথমে ভাঙলো পল্লব। সত্যিই স্ত্রীকে সে ভালোবাসে। শ্রেয়ার মারের হাত থেকে বিউটিকে বাঁচাতে সেই রাতেই স্টেটমেন্ট দিতে রাজি হল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

পুরো বুদ্ধিটা যে বিউটির এটা পল্লব কিছুতেই স্বীকার করেনি বলেছে আমরা দুজনেই ঠিক করেছিলাম। আসলে যখন প্রথম প্রোমোটারের থেকে বাড়ি কেনার অফার এলো তখন সুষমা দেবী বাড়ি বিক্রি করতে রাজি হননি। তার অনেক আগে থেকেই বাড়িটা তাদের নামে লিখে দেওয়ার ব্যাপারে বিউটি বাড়িতে অশান্তি করত। বিউটির সঙ্গে পল্লবের ভাব-ভালোবাসা করে বিয়ে হয়েছিল। প্রোমোটারের কাছ থেকে এতগুলো টাকা পাবার লোভ আর শেষমেশ সুষমা যদি বাড়িটা প্রোমোটারকে দেন তাহলে টাকাটা তার ব্যাংক একাউন্টে চলে যাবে। সেই টাকা নিয়ে সুষমা কি করবেন সে ব্যাপারে বিউটি খুব একটা নিশ্চিন্ত ছিল না।

এদিকে ভবানী পাল প্রোমোটারের কমিশনের লোভে প্রায়শই এসে সুষমাকে বাড়িটা দেবার ব্যাপারে বুদ্ধি দিত। ভবানী পালকে ওরা স্বামী-স্ত্রীতে দেখাতো এ বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে তাদেরও মত নেই। গ্লুকোমিটারের স্ট্রিপের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিটা পুরোটাই বিউটির। জানতো তবে পুরোটাই বিউটি নিজে হাতে করেছিল পল্লবকে কিছু করতে দেয়নি। ধরা পড়লে তদন্তটা গুলিয়ে দেবার জন্য নানা রকম বিষের সঙ্গে সাপের বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল।

লেকটাউনে আর এক চেনা পরিচিতের সূত্রে এক সাপুড়ের কাছ থেকে গোখরা সাপের বিষ কিনেছিল বিউটি। গ্লুকোমিটারে এরর এসেছে। সুষমা আবার চেষ্টা করেছেন। আবার এরর এসেছে। আবার নতুন বিষাক্ত টেস্ট স্ট্রিপ। আবার বিষ মিশেছে রক্তে। এইভাবে মডারেট পয়জনিঙে মাল্টি-অরগ্যান ফেলিওর হয়ে গিয়েছে। বিষের প্রভাব প্রাথমিকভাবে চেহারায় পড়েনি। তবে এটা এভাবেই প্ল্যান করা হয়নি। বিষ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু “রিপিটেড মডারেট পয়জনিং” ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৫: সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?

আসলে সেদিন মাঝরাতে না ফিরে এলে হয়তো পল্লব আর বিউটি ধরাই পড়তো না। পল্লব জেরায় জানিয়েছে হঠাৎ করে বিউটির মনে হয়েছিল যে যে টেস্ট ট্রিপ ব্যবহার করা হবে সেগুলো তো বিছানায় পড়ে থাকবে। তাই সেগুলো সরিয়ে নেওয়া দরকার। বিউটি স্বীকার করেছে ফরেনসিকের লোকেরা যে ঘরের সব শুদ্ধ জিনিস টেস্ট করবে সেটা সে ভাবতে পারেনি। মলিনাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া সন্দেশটাও ফ্রিজের মধ্যে পেয়ে গেল ফরেনসিকের লোকজন।

বলা হয় অপরাধী খুব সহজ ভুল করে আসে। ভোররাত্তিরে আলো ফুটেছে কিনা দেখার জন্য জানালায় মুখ বাড়িয়েছিল বিউটি, উঁকি মারতে গিয়ে নজরে এলো শ্যামলাল ইস্তিরিওয়ালা জানালার দিকে তাকিয়েছে খাটের ছত্রি থেকে শাশুড়ির শাড়িটা কোনওক্রমে গায়ের উপর জড়িয়ে দিয়ে ঘোমটা দিয়েছিল বিউটি। পল্লব বাড়ির নিচে পাহারায় ছিল তাই সে এই সব কিছুই পরে বিউটির কাছ থেকে শুনেছে।

বিষ মিশিয়ে খুনের জন্য আদালতে বিউটিকে করের যাবজ্জীবন শাস্তি হল।আর তাকে খুনের সহায়তা করার জন্য শাস্তি পেল তার স্বামী, সুষমা করের ছেলে পল্লব। —চলবে।
 

আগামী বৃহস্পতিবার ৪ জানুয়ারি ২০২৪ নতুন বছরে নতুন রহস্যগল্প ‘উইকএন্ড এসকর্ট’

* হ্যালো বাবু! (Hello Babu) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ২য় খণ্ড।

Skip to content