বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


 

উইকেন্ড এসকর্ট

চার বছর আগের ডিসেম্বর মাস। অনেক রাতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করে গড়িয়াহাট ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় ঠিক গোলপার্কের সামনে এক নামী ক্রিকেটার পথচারী এক বয়স্ক মানুষকে ধাক্কা দেয়। তখনও গড়িয়াহাটের সব দোকান বন্ধ হয়নি। আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এলে গাড়িটি পালাতে পারেনি। বেগতিক দেখে ওই গাড়িতেই থাকা অন্য একজন বৃদ্ধকে তড়িঘড়ি গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরিতে নিয়ে গেলেন।

ডাক্তাররা ক্যাজুয়ালটি বিভাগে দেখেই জানিয়ে দিলেন ‘পেশেন্ট এক্সপায়ার্ড’। পুলিশ কেস হল। অ্যালকোহল টেস্টার দিয়ে দেখা গেল নামী ক্রিকেটার মদ্যপ। আর তিনিই যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন সেটা অস্বীকার করা যায়নি। কারণ অন্য ছেলেটি গাড়ি চালাতেই জানত না। টাকাপয়সা দিলেও সেই মূহুর্তে ড্রাইভার বদলের কোনও সম্ভাবনাও ছিল। নামী মানুষ সরকারি যোগাযোগ রয়েছে। তাই সরাসরি থানায় না এনে হাসপাতালে বসিয়ে রাখা হল।

ইতিমধ্যে সেই ক্রিকেটার তার জানাশোনা লোকেদের মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছেন নিখিল সেনের কাছে। মৃত মানুষটির বাড়ি হালতু পোস্ট অফিসের কাছে। লেক টেরেসে একটি অনেক পুরোনো নার্সিংহোম রয়েছে। এ মানুষটি সেখানে কাজ করেন। বয়স হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাজ করতে হয়। দেশপ্রিয় পার্ক থেকে ২১২ নম্বর বাসে করে রাতের বেলা হয়তো আধ ঘণ্টা লাগবে হালতু পোস্ট অফিস পৌঁছতে। কিন্তু রাতে প্যাসেঞ্জার কমে, বাসও কমে যায়। বেসরকারি বাস ফাঁকা তো নিয়ে যাবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে, লোক ডাকবে। তার চেয়ে শ্রীচরণ ভরসায় পূর্ণদাস রোড ধরে গোলপার্ক মিনিট কুড়ি। রাস্তা পার হয়ে ভিতরের রাস্তা ধরে গিয়ে কাঁকুলিয়া রেলগেট টপকে হালতু বাজার হয়ে হালতু পোস্ট অফিস। আরও ৩০-৩৫ মিনিট। শরীর অসুস্থ না থাকলে হেঁটেই ফেরেন।

এই বয়সে চলাফেরা করলে শরীর ঠিক থাকে, অর্থের সাশ্রয় হয়। স্ত্রীর অসুস্থতা, মেয়ের পড়াশোনার খরচ। অর্থের সাশ্রয় না করলে চলবে কী করে? সকালে আসার একটা তাড়া থাকে। ফেরার তো নেই। বাড়িতেই তো যাবেন। কিন্তু সেইদিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি। বাড়ির লোকজন কোনও দুশ্চিন্তা করেননি। রোজই একই সময়ে ফেরেন। কখনও হয়তো রাস্তায় কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ফিরতে হয়তো-বা একটু দেরিই হল। কিন্তু সে রাতে দুশ্চিন্তার আগেই দুঃসহ খবরটা এসেছিল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-১৮: শ্রুতি সেন কি সত্যি বলছেন?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫৪: একে একে

নিখিল সেনের পরামর্শে কিছুটা আর্থিক সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন সেই নামী ক্রিকেটার। মৃতের বাড়ির থেকে সেই সাহায্য নিতে অস্বীকার করা হয়েছিল। নিখিল সেন সত্যি সত্যি সাহায্য করতে তো চাননি। সাহায্য করার একটা বাতাবরণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। পরিস্থিতির প্রমাণটা দরকার ছিল। গড়িয়াহাটে রাস্তায় যারা ধরাধরি করে ক্রিকেটারের গাড়িতে রক্তাক্ত মানুষটিকে তুলে দিয়েছিল তারাই কোর্টে স্বীকার করল, লোকটি আপন খেয়ালের রাস্তার মধ্যে চলে এসেছিলেন। শীতের রাত। ব্রিজের উপর থেকে দ্রুত গাড়ি নামছিল, লোকটি নাকি একটি বাসের মুখোমুখি পড়ে যায়। বাসটি শেষ মুহূর্তে কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। আর ভয় পেয়ে লোকটি সামনে না গিয়ে পেছনে ফিরতে চায়, ততক্ষণে এই গাড়িটি খুব কাছাকাছি হয়ে গিয়েছে। কাটাবার চেষ্টা করেও পারে না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

গাড়ির আরোহীরা পালাবার কোনও চেষ্টা না করে সঙ্গে সঙ্গে লোকটিকে গাড়িতে তুলে সামনে থাকা নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিবারকে বেশ কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। পরিবার টাকা নিতে অস্বীকার করে। একেবারে নিখুঁত চিত্রনাট্য। তখনও সিসিটিভি এতো চালু নয়। তাই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ধ্রুব সত্য। হোক না সে ‘সত্য’ অর্থের বিনিময় কেনা। এমন একটা চিত্রনাট্যে অসাধারণ অভিনয় করে নিখিল সেন কোর্টে প্রমাণ করে দিলেন যে, স্ত্রীর চিকিৎসা ও মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে না পেরে আর্থিক অনটনে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটি আচম্বিতে মাঝরাতে ফ্লাই-ওভারের মুখে মাঝরাস্তায় এসে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। তিনি বাসের ড্রাইভারের ডানদিকে ছিলেন। ড্রাইভারও ডানদিকে। তাই লোকটিকে দেখতে পেয়ে কাটাবার সুযোগ ছিল বাস ড্রাইভারের। দুর্ভাগ্যবশত পিছনে জোরে আসা গাড়িটির বাঁ দিক থেকে মানুষটি পিছনে আসতে যান। গাড়ির ড্রাইভার ডানদিকে। স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির বাঁদিকের কোণটা তার ব্লাইন্ড স্পট। গাড়ির ড্রাইভার কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি এসে গাড়ির সামনে পড়ে। এটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৩: ইন্দিরা দেবী—ঠাকুরবাড়ির আলো!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

আমার ক্লায়েন্ট সমাজের একজন বিশিষ্ট মানুষ। তিনি দায়িত্ব নিয়ে লোকটিকে নার্সিংহোমে নিয়ে যান একথা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এই দুর্ভাগ্যজনিত মৃত্যুর সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে জড়িয়ে পড়ার জন্য তিনি একটা আর্থিক ক্ষতিপূরণও দিতে চেয়েছিলেন। মৃত্যু সব সময়ই দুঃখজনক। কিন্তু তার জন্য কোনও নিরাপরাধ মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়। সেই ক্রিকেটারের বেকসুর খালাস হয়েছিল। তার অ্যালকোহল মিটার টেস্ট রিপোর্ট সে রাতেই প্রভূত অর্থে চাপা পড়ে গিয়েছিল।

এর ঠিক দু’বছর পর এই ক্রিকেটারের ভয়ঙ্কর মৃত্যু হল দিল্লিতে। অদ্ভুতভাবে সেটাও পথ দুর্ঘটনা। তবে কোনও গাড়ি ধাক্কা দেয়নি। ঘনকুয়াশার মধ্যে দেখতে না পেয়ে তাঁদের গাড়ি ফ্লাইওভারের রেলিং ভেঙ্গে নিচে গিয়ে পড়ে। ড্রাইভারের বেল্ট বাঁধা ছিল। চোট যথেষ্ট হলেও সে প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু আলোচ্য ক্রিকেটার পিছনে বসেছিলেন, যথারীতি বেল্ট বাঁধার কথা ভাবেননি। ওই যেমন স্কুটার মোটরবাইক যিনি চালান তাঁর মাথায় হেলমেট থাকে, অন্যদের উন্নত মম শির হেলমেটহীন। সেই ক্রিকেটারের মাথাটা গাড়ির ছাদের ধাক্কায় চুরমার হয়ে যায়।

পুলিশ চেষ্টা করলে অসাধ্য সাধন করতে পারে। যেটা আবার ধৃতিমান বা আমাদের বাবুর মতো গোয়েন্দাদের কর্ম নয়। পুলিশের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক-এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলল, ঠিক কোন এজেন্সি নিখিল সেনকে উইকেন্ড এসকর্ট সরবরাহ করত। এরপর শ্রেয়া বসু অবতীর্ণ হলেন। তাদের গোপনীয়তার শর্তকে ভেঙেচুরে দুরমুশ করে নিখিল সেনের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত এসকর্টদের খোঁজখবর পাওয়া গেল। —চলবে।
 

নিখিল সেন হত্যা রহস্য: আগামী পর্ব বৃহস্পতিবার ৭ মার্চ ২০২৪

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content