রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


 

উইকেন্ড এসকর্ট

অনেক রাতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করে গড়িয়াহাট ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় ঠিক গোলপার্কের সামনে এক নামী ক্রিকেটার পথচারী এক বয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলেও বেমালুম খালাস পেয়ে গেল। নিখিল সেন কোর্টে প্রমাণ করে দিলেন যে স্ত্রীর চিকিৎসা মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে না পেরে আর্থিক অনটনে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটি নিতান্ত উদ্ভ্রান্তের মতোই প্রায় মাঝরাতে ফ্লাই-ওভারের মুখে রাস্তা পার হচ্ছিলেন।

নিখিল সেন ডিভোর্সি। পাঁচ বছর আগে স্ত্রী শ্রুতির সঙ্গে সম্পর্কের ইতি। একই বাড়িতে আলাদা থাকেন কিন্তু কোনও অজানা কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। কোনও দাম্পত্য সম্পর্ক নেই। এখানেও ম্যারেজ ফর কনভেনিয়েন্স। বিয়ের রকমফের দেখে ঘেন্না ধরে গেল। ভাগ্যিস বাবু বিয়ের কথা ভাবে না।

টাকার মতোই নিখিলের নারীসঙ্গের লোভ ভয়ংকর। সারাসপ্তাহ পরিশ্রমের পর নানান রিসর্টে যায় নিখিল সেন কিন্তু রাত কাটানোর জন্যে পুরোনো সঙ্গী রিপিট করে না। রিসর্ট বদলানোটাও নিয়ম ছিল। কিন্তু হালে গোপনীয়তার কারণেই একই রিসর্টে আসছেন নিখিল। প্রতিবারই সন্ধেবেলা রিসর্টে পৌঁছে নিখিল সেন একা রিশেপসনে যান। নিজের আর তার বিবাহ-বিচ্ছিন্না স্ত্রীর আইডি কার্ড আর একটা পাঁচশো টাকার নোট দেন। এতেই শতকরা ৯০ ভাগ জায়গায় প্রশ্ন ওঠে না, বাকি দশভাগ জায়গায় গাঁইগুঁই করলে কার্ডটা দেখিয়ে বলতে হয় “আমি হাইকোর্টের ক্রিমিনাল ল ইয়ার, অতো চাপ নেনেন না”। ব্যাস, এতেই কাজ হয়। এন্ট্রি সেরে আইডি কার্ড ফেরত নিয়ে বেয়ারা দিয়ে গাড়ি থেকে ব্যাগ রুমে পৌঁছে দিতে বলে। তারপরে ডিনার অর্ডার করে তারপর “জায়গাটা একটু ঘুরে আসি” বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে রাত করে ফেরেন ।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-১২: পার্টি থেকে ফিরে সঞ্জয় দেখলেন পুনম বাথটবে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছেন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪৮: আদিম অরণ্যের আগন্তুক

এরকম উইকেন্ড এসকর্ট সার্ভিসের যোগান যারা দেন তাদের বলা আছে কোনওভাবে ব্যক্তিগত পরিচয় যেন প্রকাশ না পায়। কমবয়েসী কলেজ ছাত্রীদের খুব পছন্দ নিখিল সেনের যাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলা যায়। আজকালকার জেনারেশনের খুব একটা ছুৎমার্গ নেই, উইকেন্ডের এই মজাটা এরা সহজ ভাবে নেয়। তারাও ব্যক্তিগত পরিচিতি না রেখে সহজভাবে খায়দায় গল্প করে অনলাইনে গুণে টাকা নেয়। টাকাটা এজেন্সি ঘুরে কমিশন বাদ দিয়ে আবার তার মোবাইলে ঢোকে। এটা তাদের পকেট মানি।তারা রাত কাটায়। শনিবারে যেমন তাদের আলাদা গাড়ি নিয়ে আসে তেমনি পরদিন রোববার আলাদা অন্য গাড়ি আসে তাদের কলকাতার নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৮: শান্তা দেবী— এক মহীয়সী!

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম

সেই নিখিল সেনকে এক রিসর্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। দু-তিনখানা মদের বোতল প্রচুর সিগারেটের বাডস। পোস্টমর্টেমে কোনও অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেল না এবং খুনের কোনও প্রমাণ পাওয়া গেলো না। পুলিশ দেখলো রিসর্টের রের্কড অনু্যায়ী সঙ্গে তার স্ত্রী ছিল। স্ত্রী শ্রুতি জানালেন, নিখিল সেনের সঙ্গে গত পাঁচ বছর কোনও যোগাযোগ নেই। যদিও তারা একই বাড়িতে আলাদা থাকতেন এবং বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। ধৃতিমান না থাকলে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুতে কেসটা থমকে যেত। কিন্তু ভৈরব চক্রবর্তী এখন শুধু ধৃতিমানকে ভরসা করেন তাই নয় তদন্তের সুবিধের জন্যে সঙ্গে দিলেন তাঁর খুবই বিশ্বাসভাজন ও কৃতী অফিসার শ্রেয়া বাসু ও কনষ্টেবল দত্তকে।

ধৃতিমান স্ত্রীর কথাকে বিশ্বাস করেই তদন্ত শুরু করল তার মতো করে। রিসর্টের রিশেপশনের কর্মী সঙ্গের মহিলার বিষয়ে আমতা আমতা করছিল। বলেছিল আসার সময় সে ম্যাডামকে দেখেনি। কিন্তু পরদিন একবার যেন পিছন থেকে দেখেছিল। বেয়ারাকে ব্যাগ দিয়ে নিখিল সেন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান, ফেরেন অনেক রাতে। রাতে রুমে ডিনার নিজে বেয়ারার থেকে নিয়েছিলেন। পরেরদিন অনেকবেলায় বেয়ারা রুমে বেল দেয়, রিশেপশন থেকে ফোন করেও না পেয়ে লোকাল থানায় খবর দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৬: যুগান্তরেও সম্মানিতা হন সীতা, তাঁর বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে কী তার কোনও প্রভাব আছে?

পুলিশের সামনে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখা গেল নিখিল সেনের মৃতদেহ পড়ে আছে। ধৃতিমান খোঁজ নিতে নিতে নিখিলের চরিত্র ও অভ্যেসের খবরাখবর পেয়ে গেল। নিখিলের গাড়ি পুলিশের সাহায্যে মেকানিক দিয়ে খুলে সার্চ করে ড্যাশবোর্ডের ভিতর থেকে অনেক পুরোনো উইকেন্ডের দুটি রিসর্টের রসিদ পাওয়া গেল। এটা সম্ভবত নিখিলের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে গড়ে ওঠা বেপরোয়া ভাবসাবের কারণে রয়ে যাওয়া ভুল। রিসর্ট থেকে জানা গেল হুবহু একইরকম রুটিন।

শনিবার সন্ধেবেলা শ্রুতি সেনের আই কার্ড দিয়ে চেক-ইন। ব্যাগ ঘরে পাঠিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, বেশি রাতে ফেরা। রিসর্টে অনেক গেস্ট কাপল থাকেন। চেক ইন করার পর রিশেপশন থেকে কোন মহিলা কোন রুমে যাচ্ছেন সেটা তো মনিটর করা যায় না। আর এটা জেনেই নিখিলের নিখুঁত প্ল্যানিং। রুমেই ডিনার পরের দিনের ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ রুমে নিজে বেয়ারার থেকে নেওয়া, ব্যাগ বেয়ারাকে দিয়ে গাড়িতে নিজে তুলে দিয়ে, ক্যাশ পেমেন্ট দেওয়া। বেয়ারাদের মোটা টিপস দেওয়া। আর এর মাঝের কোন একটা সময়ে লাঞ্চ সেরে সঙ্গিনী ফিরে গিয়েছেন।

নিখিলের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাঙ্ক থেকে এই অভিসার জীবনের কোন তথ্য পাওয়া গেল না। অন লাইনে নানান লোককে পেমেন্ট করেছেন, মোবাইল নং ধরে ধরে কল রেকর্ড মিলিয়ে পুলিশ পৌঁছল উইকেন্ড এসকর্ট সার্ভিসের যোগান যারা দিত তাদের কাছে। এসকর্টদের মধ্যে থেকেশেষ দিনের সেই মেয়েটির কাছে। জানা গেল এটা একটা প্রায় নিখুঁত খুন। কিন্তু খুনীর মুখোমুখি পৌঁছেও প্রথম আর সম্ভবত এই শেষবারের মতো ধৃতিমান খুনিকে ছেড়ে দিল। কিন্তু কেন?—চলবে।
 

নিখিল সেন হত্যারহস্য: পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৪

* হ্যালো বাবু! (Hello Babu) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ২য় খণ্ড।

Skip to content