শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়।

ভারী দুরন্ত। এটা ফেলছে, ওটা ভাঙছে। রকমারি দুষ্টুমি। ‘বুড়ো আংলা’-র রিদয়ের মতো দুরন্ত, তেমনই দস্যি! অ্যাকোরিয়ামে লাল মাছ খেলছে, ছুটছে। কী খেয়াল হল, দুপুরের দিকে সবাই যখন ঘুমের দেশে, তখন শিশি ভরা লাল কালি এনে অ্যাকোরিয়ামে ঢেলে দিলেন। মুহূর্তে জলের রং বদলে গেল। এমনভাবেই সারাদিন ধরে নানা অনাসৃষ্টি করে বেড়াতেন অবনীন্দ্রনাথ। জীবনভর ‘ছোট্টটি’ থাকতে চেয়েছিলেন তিনি।
কোন্নগরের বাগানবাড়িতে বেড়াতে এসে ছবি-আঁকায় হাতেখড়ি। সেই শুরু, দিনে দিনে ছবি-আঁকাই হয়ে উঠেছে ধ্যান-জ্ঞান। ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ তখন খ্যাতির শিখরে। ব্যস্ততা তুঙ্গে। সেই ব্যস্ততার মাঝেও নিয়ম করে ছোটদের নিয়ে বসতেন। গল্পের পর গল্প বলতেন। গল্প শুনতে শুনতে তাঁকে ঘিরে বসে থাকা কচিকাঁচাদের মুখগুলো আনন্দে, খুশিতে ঝলমল করে উঠত। সে-সময় ঠাকুরবাড়ি থেকে কিছু বাল্যপাঠ্য বই প্রকাশের পরিকল্পনা হয়। কার বই দিয়ে সেই পরিকল্পনার শুভসূচনা হতে পারে, এক মুহূর্তও ভাবতে হয়নি রবীন্দ্রনাথকে। কে গল্প শোনালে ছোটদের মন মুগ্ধতায় ভরে ওঠে, তা তো অজানা নয় তাঁর! ফলে ভেবে বৃথা কালক্ষয় না করে তখনই ঠিক করে ফেলেছিলেন, প্রথম বইটি লিখবেন তাঁর ভালোবাসার অবন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

‘রবিকা’র অনুরোধ ফেরাতে পারেননি অবনীন্দ্রনাথ। অনেক দ্বিধা নিয়েই লিখে ফেলেছিলেন ‘শকুন্তলা’। ভাগ্যিস, ছোটদের ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়ে গল্প শোনাতেন, আর তা রবীন্দ্রনাথের নজরে পড়ে গিয়েছিল, তা না হলে আদৌ অবনীন্দ্রনাথ ছোটদের জন্য লিখতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তো রয়েই যায়!

‘শকুন্তলা’ লেখার পর আর অবনীন্দ্রনাথকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছবি আঁকাআঁকির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে ছোটদের জন্য লেখালিখি। বরাবরই ছোটদের তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। কোনও বই লেখা শেষ হলেই নিজের ছেলেমেয়েদের ডেকে শোনাতেন। শুধু নিজের লেখা নয়, শোনাতেন রামায়ণ-মহাভারতের গল্পও। কন্যা উমার লেখা থেকে জানা যায়, ‘দুঃখের সময় কাঁদাতেন, হাসির সময় হাসাতেন। তাঁর বলার ভঙ্গিতে এমনি যাদু ছিল…।’

মিলাডা গঙ্গোপাধ্যায়।

অবনীন্দ্রনাথ ছেলেমেয়েদের প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন, দায়িত্ববান পিতা। আকাশের রং চেনাতেন। ফুলের রং-গন্ধ কী রকম, তা বোঝাতেন! ছোটদের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের গল্প বলা, এ-সব অবনীন্দ্রনাথ পরমানন্দে করেছেন জীবনভর। কখনও বিরতি পড়েনি। অকালে মাকে হারিয়ে দৌহিত্র মোহনলাল-শোভনলাল তাঁদের ‘দাদামশায়’ অবনীন্দ্রনাথের কাছেই বড় হয়েছিলেন। মোহনলাল তখন সবে কৈশোরে পা রেখেছেন। গল্প লেখার ইচ্ছে জাগে তাঁর।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

একদিন সাহস করে মোহনলাল দাদামশায়কে জিজ্ঞাসা করলেন, কী করে গল্প লিখতে হয়! প্লট পাবেন কোথায়! শুনে দাদামশায়ের মুখে হাসির ঝিলিক খেলে যায়। বললেন, ‘এর জন্য ভাবছিস? কেন স্বপ্ন দেখিস না? স্বপ্নগুলো লিখে ফেল, দেখবি গল্প আপনি এসে যাবে।’ এরপর থেকে বাড়ির সব ছোটরা ঘুম থেকে উঠেই চলে আসত অবনীন্দ্রনাথের কাছে, দক্ষিণের বারান্দায়। শ্রীরামপুরী কাগজ লম্বালম্বি চার টুকরো করে কেটে রাখতেন তিনি। তাঁর সামনে বসে সেই টুকরো-কাগজে আগের রাতে দেখা স্বপ্ন লিখে জমা দিতে হতো। অবনীন্দ্রনাথ নিজেও আগের রাতে দেখা স্বপ্ন লিখতেন। জমা পড়া স্বপ্ন-লেখা টুকরো কাগজ পরের পর গঁদের আঠা দিয়ে জুড়ে গুটিয়ে রাখতেন। এই স্বপ্ন-সংগ্রহের একটি সুন্দর নামকরণও করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, ‘স্বপ্নের মোড়ক’। স্বপ্ন- লেখার এই আসরে বাড়ির ছেলেমেয়েরা শুধু নয়, নেপালি গৃহভৃত্য টুকুনিও আসত, স্বপ্ন লিখত।
স্বপ্ন লিখতে লিখতে ততদিনে বাড়ির ছোটদের লেখার হাত খুলেছে। তাঁরা ঠিক করলেন, হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ করবেন। ছোটদের মধ্যমণি মোহনলাল দাদামশায়কে জানালেন সে-ইচ্ছের কথা। দাদামশায় সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার নাম ঠিক করে দিলেন, ‘দেয়ালা’। শুধু নামকরণ নয়, মলাটের ছবি, ভিতরের ইলাসস্ট্রেশনও করে দিয়েছিলেন। চতুর্থ সংখ্যা থেকে অবনীন্দ্রনাথ ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন, ‘সহজ চিত্রশিক্ষা’। হাতে-লেখা পত্রিকা, নিতান্তই ছেলেমি ব্যাপারস্যাপার ভেবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেননি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

অবনীন্দ্রনাথ ছোটদের অভিনয় শেখাতেন, নাটক করাতেন। একবার করিয়েছিলেন ‘আলিবাবা।’ ডাকাত সাজতে হবে, ডাকাতের তো দাড়িগোঁফ চাই! এদিকে ছেলেরা নাছোড়বান্দা, নকল দাড়ি-গোঁফ কিছুতেই লাগাতে দেবে না। অবনীন্দ্রনাথ শেষে তাদের দাড়ি-গোঁফ কালো কালি দিয়ে এঁকে দিয়েছিলেন।

অবনীন্দ্রনাথ ছাত্রদের খুব ভালোবাসতেন। তাঁর স্নেহময়তার তুলনা হয় না। কোনও ছাত্রের অসুস্থতার খবর পেলে নিজে চলে যেতেন তাঁর বাড়িতে। ছবির এক্সিবিশনে ছাত্রদের ছবি থাকলে নিজের ছবি দিতেন না। বলতেন, ‘আমার ছবি দিলে ছাত্রদের ছবি বিক্রি হবে না যে! তাই দিইনি।’
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

ছোটরাও অবনীন্দ্রনাথকে খুব ভালোবাসতেন। নাতি মোহনলালের যত আবদার, বায়নাক্কা ছিল দাদামশায়ের কাছে। দাদামশায় ছিলেন ভীষণ ভালো বন্ধু। মোহনলাল তখন পিতা হয়েছেন। তাঁর কন্যার নাম রাখেছিলেন ‘ঊর্মিলা’। অবনীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন ডাকনাম। ঊর্মিলার মায়ের নাম ‘মিলাডা’তে আছে ‘মিলা’, ‘ঊর্মিলা’তেও ‘মিলা’। সেই ‘মিলা’ শব্দটি উল্টে ‘কত্তাবাবা’ ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটির নামকরণ করেছিলেন ‘লামি’। লামিকে নিয়ে ছড়াও লিখেছিলেন, ‘লামির দাঁত উঠলো কয়েকটা / দেখি দেখি আটটা না ছয়টা!’

রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ।

শেষের দিকে অবনীন্দ্রনাথ থাকতেন ডানলপের কাছে, ‘গুপ্তনিবাস’-এ। এই বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন রাতে। রাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল শিল্পীগুরুর মৃত্যু-সংবাদ। পুত্র অলোকেন্দ্রনাথ ‘ছবির রাজা ওবিন ঠাকুর’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। সে-বইতে আছে, ‘পুবের আকাশে রাতের ঘোর কেটে সবে মাত্র লাল রংয়ের ছিটে পড়েছে, সেই সময় পঞ্চাশ-ষাটটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল ফুল হাতে এসে হাজির —তাদের অবন দাদুকে শেষ দেখা দেখতে। আশ্চর্য, যাদের অবনীন্দ্রনাথ সব থেকে বেশি ভালোবাসতেন, সেই বাচ্চারাই সবার আগে এসে তাদের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেষ পদধূলি মাথায় নিয়ে চলে গেল।’

ছোটদের ভীষণ ভালোবাসতেন, ‘বন্ধু’ ভাবতেন অবনীন্দ্রনাথ। এই ভালোবাসায় কখনও ঘাটতি পড়েনি।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content