শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দ্বিপেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্র-অগ্ৰজ দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ সন্তান। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র তিনি, একই বয়েসি দু-জনে। রবীন্দ্রনাথ বছরখানেকের বড়ো। ছোটোবেলা থেকেই তিনি অন্যরকম। কুকুর-বেড়ালের ওপর অত্যাচার করতেন, বিরক্ত করতেন। এতেই ছিল তাঁর আনন্দ। বাড়ির বড়ো নাতি। স্বভাবতই সকলের আদরের। তাঁর এইসব অপকর্মের বিরোধিতা করলে দুর্গতি ছিল অনিবার্য। কুকুরকে বিরক্ত করা নিয়ে দু-কথা তাঁকে শোনানোয় রবীন্দ্রনাথকে বালক-বয়সে খেসারত দিতে হয়েছিল। সেই অবিচারের কথা ভুলতে পারেননি কবি। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে মৈত্রেয়ী দেবীকে ঘটনাটির কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এইরকম ছোটদের উপর প্রায় অবিচার হয়।’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছে দ্বিপেন্দ্রনাথ অভিযোগ করেছিলেন, ‘আমাকে মেরেছে!’ আদরের নাতির অভিযোগ, দ্বিজেন্দ্রনাথ তো মান্যতা দেবেনই, দিয়েওছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
দ্বিপেন্দ্রনাথ ছিলেন বড়ো বৈষয়িক, সেই সঙ্গে শৌখিনও। অগাধ সম্পত্তির অধিকারী, ফলে রকমারি বিলাসিতা করতে পারতেন। মহর্ষিদেব ইচ্ছাপত্রে দ্বিপেন্দ্রনাথকে অন্যতম ট্রাস্টি করে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী করেছিলেন। পাঁচশো টাকা তাঁর মাসোহারা নির্দিষ্ট ছিল। পিতৃদেবও তাঁকে মাসোহারা দিতেন, দু’শো পঁচিশ টাকা প্রতি মাসে। হাতে অপর্যাপ্ত অর্থ। ফলে অপচয়ও করতেন বিস্তর। শান্তিনিকেতনে বসে দ্বিপেন্দ্রনাথ নিয়মিত মদ্যপান করতেন। শিল্পী মুকুল দে ‘আমার কথা’য় লিখেছেন, ‘দিপু ঠাকুর খুব ড্রিঙ্ক করতেন।’ তাঁর মদ খাওয়ার গ্লাস আসত বিদেশ থেকে। দামি কাঁচের বাহারি গ্লাস। সেই গ্লাস ভেঙে গেলে ছোটোরা কেউ কেউ ঘষে ঘষে লেন্স বানাত। মুকুল দেও এমন করতেন, তাঁর স্মৃতিকথাতে আছে সে স্বীকারোক্তি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

পারিবারিক আয় থেকে যা প্রাপ্য হত, তা পরিমাণে খুব কম ছিল না । এলোমেলোভাবে খরচ করে, মহাআনন্দে শখ মেটাতেন দ্বিপেন্দ্রনাথ। কিছু টাকা নিজের ইচ্ছামর্জি মাফিক খরচ করতেন। যাঁর প্রয়োজন, তাঁর হাতে তুলে দিতেন নগদ অর্থ। সুস্থ মানুষজনের জন্য নয়, পাগলদের জন্য খরচ করে তাঁর ছিল স্বস্তি।

ঠাকুরবাড়িতেও পাগল ছিল। পাগলের আনাগোনাও ছিল। রবীন্দ্রনাথের কাছে বিচিত্র ধরনের লোকজন আসতেন। হ্যাঁ, পাগলও আসত। বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র জ্যোতিপ্রকাশের মাথার ব্যামো ছিল,তা তাঁকে দেখে তো বটেই, তাঁর আচার-আচরণেও বোঝা যেত। একবার হঠাৎ করে হাজির হলেন তিনি। সঙ্গে একটি বন্দুক। বন্দুকটি নিয়ে রবি ঠাকুরের ঘরের দিকে তাক করে আপন মনে বলতে থাকলেন, গুলি করে রবি ঠাকুরকে ঠাণ্ডা করে দেবেন। বলা-ই বাহুল্য, বন্দুকটি সত্যিকারের ছিল না, ছিল খেলনা-বন্দুক।

জোড়াসাঁকো।

রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিদিনই অনেক চিঠি আসত। অধিকাংশ চিঠিরই কবি উত্তর দিতেন। এমন চিঠি মাঝেমধ্যেই পেতেন, যা পড়তে গিয়ে কবির মনে হত, পত্রলেখক নির্ঘাত পাগল। ঠাকুরবাড়িতেও পাগল ছিল। মহর্ষিদেবের দুই পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথের মাথার ব্যামো ছিল। বীরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেকেই বলত, অঙ্ক কষতে কষতে তিনি নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। অঙ্কে ছিলেন তুখোড় । তখন মাথার সমস্যা তীব্র, এই অবস্থার মধ্যেও অঙ্কে মনোযোগ হারাননি। কে আর তাঁকে খাতা-কলম দেবে, তাই কাঠকয়লা দিয়েই মনের খেয়ালে দেয়ালে দেয়ালে অঙ্ক কষতেন। বীরেন্দ্রনাথকে পাগলাগারদেও পাঠাতে হয়েছিল। মাঝেমধ্যে তাঁর উন্মত্ততা এতই বেড়ে যেত যে, তাঁকে বাধ্য হয়ে বেঁধে রাখতে হত।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন মহর্ষিদেব ও সারদাসুন্দরীর চতুর্থ সন্তান। সোমেন্দ্রনাথ ছিলেন ত্রয়োদশ সন্তান। রবীন্দ্রনাথের থেকে বছর দুয়েকের বড়ো। একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন তাঁরা, ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে সে তথ্য। সোমেন্দ্রনাথ ছিলেন অধিকমাত্রায় আত্মভোলা। সারাক্ষণ নিজের মধ্যেই মগ্ন হয়ে থাকতেন। উন্মাদরোগগ্রস্ত মানুষটি ছিলেন ভারি উপভোগ্য। তাঁর দৈনন্দিন কাণ্ডকারখানায় না হেসে উপায় ছিল না।

পিঠোপিঠি ভাই, তাই রবীন্দ্রনাথকে খুব ভালোবাসেন। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, এ সংবাদ জোড়াসাঁকোয় পৌঁছানোর পর সোমেন্দ্রনাথের সে কী আনন্দ! সারা বাড়ি দৌড়োতে থাকেন আর চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘রবি প্রাইজ পেয়েছে, রবি প্রাইজ পেয়েছ!’

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই আনন্দের সঙ্গে কৌতুকও মিশে ছিল। সোমেন্দ্রনাথ বাড়ির ছোটোদের ডেকে নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, ‘একটা কথা জানিস? গীতাঞ্জলির সব কবিতা কিন্তু আমার লেখা । রবি আমার কাছ থেকেই তো নিয়েছে।’ ছোটোরা কথায় কম যায় না। পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, ‘তাহলে তুমি এত আনন্দ করছ কেন?’ এমন কথা শুনে সোমেন্দ্রনাথ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেছিলেন, ‘তোদের এত হিংসা কেন রে, আমার ছোটোভাই নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। আমি আনন্দ করব না তো কে করবে?’
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

এহেন সোমেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় পরীক্ষা করে দেখতেন কে পাগল, আর কে পাগল নয়! ব্যাপারটি খুলে বলা যেতে পারে। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাগলদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তাদের দানধ্যান করতেন। এতেই ছিল তাঁর আনন্দ। বাড়ির অনেকেই বলতেন, পাগল-পোষেন তিনি। পাগলসমাজের কাছে এই বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল, জোড়াসাঁকোয় এসে দাঁড়ালেই হাতে হাতে আদায়। পাবে নগদ অর্থ।

হাবভাবে পাগল মনে হলেই মিলত অর্থ-সাহায্য। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আসল পাগলের সঙ্গে নকল পাগলও আসত। আসল পাগল, নকল পাগল— এসব অবশ্য আগে কারও মাথায় আসেনি, প্রথম মাথায় এসেছিল যাঁর, তিনি সোমেন্দ্রনাথ। একদিন দ্বিপেন্দ্রনাথের কাছে ছুটতে ছুটতে এলেন তিনি।এসে জানালেন, ‘বোগাস পাগল এসে তোমায় ঠকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরে নিজে পাগল না হলে কী করে বুঝবে, কে পাগল, কে পাগল নয়?’

সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সত্যিই, সোমেন্দ্রনাথের কথার মধ্যে সত্যতা ছিল। স্বেচ্ছায় তিনি বড়ো দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, তিনি আগে পরীক্ষা করবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন, তারপর ওই সাহায্যটাহায্য। কেমন হবে সে পরীক্ষা, কৌতূহল শুধু দ্বিপেন্দ্রনাথের নয়, জোড়াসাঁকোর অনেকেরই। যাঁর নিজেরই ঠিক নেই মাথার, তিনিই খুঁজবেন কার মাথা সত্যিই খারাপ! অনেকের মুখেই হাসির ঝিলিক খেলে গিয়েছিল।

এরপর থেকেই শুরু হয়েছিল পরীক্ষা-পর্ব। কোনো পাগল জোড়াসাঁকোয় এলে সোমেন্দ্রনাথ নিজে পরীক্ষা করতেন। তিনি নিজে ঠকাস করে আগে দেয়ালে মাথা ঠুকতেন। তারপর আগত লোকটিকে বলতেন, মাথা ঠোকো! যে সত্যিই পাগল, সে দ্বিধা না করে মুহূর্তে মাথা ঠুকত, আর নকল পাগল ‘ঠুকবো কি ঠুকবো না’ ভাবতে ভাবতে খানিকটা সময় নষ্ট করে ফেলত। বিনা দ্বিধায়, অম্লান বদনে মাথা ঠোকার পর মিলত নগদ অর্থ। দ্বিপেন্দ্রনাথ মনে কোনো সংশয় না রেখে নির্দ্বিধায় নির্ধারিত অর্থ তুলে দিতেন সত্যিকারের পাগলের হাতে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৭: নৃপেনবাবুকে বহিষ্কার, ইতিহাসের করুণ পরিণতি

অর্থ-সাহায্য পেয়ে পাগল হয়তো-বা হাসত, আবার নির্বিকারও থাকত কেউ কেউ । মাথা ঠোকা নিয়ে যার মনে হাজার দ্বিধা, শেষ পর্যন্ত হয়তো ঠুকতই না, তার দিকে তাকিয়ে সোমেন্দ্রনাথ শেষে চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘ভেজাল ভেজাল, পাগল নয়, পাগল নয়।’

সোমেন্দ্রনাথ উদ্ভাবিত এই পাগল, না-পাগলের পরীক্ষার প্রকারভেদও ছিল। ছিল অন্যতর পরীক্ষা। নতুন পাগল এলে সোমেন্দ্রনাথ ধপাস করে মাটিতে পড়ে যেতেন। বুঝেসুঝে পড়া, ফলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত না। মাটিতে পড়ার প্রাক্ মূহূর্তে পাগল সাজা অর্থ-প্রত্যাশীকে বলতেন, ‘ঠিক আমার মতো মাটিতে পড়।’ কোনো দ্বিধা না করে যে পড়ে যেত, সে পাশ করত। পড়ব কি পড়ব না, ভেবে কালক্ষয় করলে ফেল অনিবার্য।

দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এইভাবে দিনের পর দিন জোড়াসাঁকোয় চলেছে পাগল- যাচাই। সোমেন্দ্রনাথ যাচাইয়ের দায়িত্ব পেয়ে আনন্দ পেয়েছিলেন। দ্বিপেন্দ্রনাথের অর্থ-সাহায্য সত্যিকারের পাগলের হাতে পৌঁছেছে। কেউ আর কৌশলে পাগলের ভান করে দ্বিপেন্দ্রনাথের টাকা হাতাতে পারেনি।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content