মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


মৃণালিনী দেবী।

যশোরের ফুলতলি গ্রামের বেণীমাধব রায়চৌধুরী ও দাক্ষায়ণী দেবীর কন্যা ভবতারিণী বধূ হয়ে এসেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের বধূ। বধূমাতাকে কিশোরী না বলে বালিকা বলা যেতে পারে। বয়স তাঁর তখন দশও ছোঁয়নি। সাল-তারিখ মিলিয়ে হিসেব করলে ন’ বছর ন’ মাস। বরের বয়েস দ্বিগুণের থেকেও ঢের বেশি। বাইশ বছর সাত মাস। ঠাকুরবাড়ির রীতি মেনে পিরালি ব্রাহ্মণ চাই। তাই অধিকাংশক্ষেত্রেই অর্থ ও মর্যাদায় পিছিয়ে থাকা পরিবারে মেয়ে খুঁজতে হত। হয়তো-বা ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার কর্মী। অতি সামান্য রোজগার, তেমন পরিবার থেকেও বধূ এসেছে। ভবতারিণী-ই তো বড় উদাহরণ। তাঁর পিতা বারো টাকা মাস মাইনেতে সেরেস্তায় কাজ করতেন। যশোরে সদলবলে মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা আছে ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিচর্চায়। সেই দলে জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ — কে ছিলেন না! হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথও গিয়েছিলেন। বৃদ্ধ-বয়সে পুরোনো দিনের কথা বলতে গিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীকে অবশ্য কবি বলেছিলেন, ‘তাঁরাই যশোরে গিয়েছিলেন, আমি যাইনি।’
বিয়ে করতে রবীন্দ্রনাথ যশোরে যাননি। নির্দিষ্ট দিনে পিতার হাত ধরে পাত্রী নিজেই এসেছিলেন জোড়াসাঁকোয়। বিবাহ-অনুষ্ঠানে বাড়তি জাঁকজমক তেমন কিছু হয়নি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও তখন জোড়াসাঁকোয় ছিলেন না। তিনি তখন নদীপথে দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
অতীব সাধারণ গ্ৰাম্যর-বালিকা। রবীন্দ্রনাথ নিজের মতো করে গড়েছেন তাঁকে। ‘ভবতারিণী’ হয়ে উঠেছিলেন ‘মৃণালিনী’। এই গড়া তো কোনও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়, তেমন পদ্ধতি আজও অনাবিষ্কৃত। মৃণালিনীর মধ্যেও ছিল নিজেকে গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছে। ভেতরে গোপনে থাকা সেই ইচ্ছাকে রবীন্দ্রনাথ শুধু জাগিয়ে নয়, রাঙিয়ে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মনের মতন হয়ে ওঠার জন্য চেষ্টার কোনও কসু্র করেননি তিনি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

শান্তিনিকেতন ঘিরে রবীন্দ্রনাথের যে স্বপ্ন, সে স্বপ্নপূরণে মৃণালিনী সারাক্ষণই পাশে ছিলেন। নিজের গায়ের গয়না খুলে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আশ্রম গড়ার কাজে রবীন্দ্রনাথকে স্ত্রীর গয়নাও নিরুপায় হয়ে বেচতে হয়েছিল।

মৃণালিনী দেবী আশ্রম গড়ার কাজে শুধু গয়না দিয়েছিলেন, তা নয়। যেভাবে তিনি শ্রম দিয়েছিলেন, তা অভাবনীয়। আশ্রমের পড়ুয়াদের তিনি সারাক্ষণ আগলে রাখতেন।

মৃণালিনী দেবীর দাম্পত্য-জীবনে রোমাঞ্চ ছিল, রোমান্সের অভাব হয়নি। গাজিপুর-বাসের আনন্দ-স্মৃতি কবির মনে সুদূর প্রসারিত প্রভাব ফেলেছিল। দূর-দেশ থেকেও কবি স্বপ্নে পৌঁছে যেতেন জোড়াসাঁকোয়। শ্যামদেশ থেকে লেখা একটি চিঠিতে ‘একটু-আধটু আদর’ করার কথা আছে। দাম্পত্য-প্রেম কত গভীর হলে স্বপ্নে এভাবে স্ত্রীর কাছে পৌঁছনো যায়, তা সহজেই অনুমেয়। বিবিধ ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সম্পর্কের সেই গভীরতা, মাধুর্যময়তা।

রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী।

রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর বিবাহিত-জীবনের স্থায়িত্ব তেমন দীর্ঘ নয়। প্রায় উনিশ বছর। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু পথযাত্রী মৃণালিনীর শুশ্রূষা করেছেন নিজের হাতে। শয্যাপার্শ্বে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন, তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করেছেন। পত্নী-বিয়োগের একুশ দিন পর অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেনকে কবি একটি চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠিতে গোপন থাকেনি এই শোক
তাঁকে কতখানি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কবির মনে হয়েছে, ‘তাহার কল্যাণী স্মৃতি আমার সমস্ত কল্যাণকর্মের নিত্যসহায় হইয়া আমাকে বলদান করিবে।’ শোকাচ্ছন্ন কবি সে সময় প্রায় প্রতিদিনই লিখেছেন বেদনাবিধুর কবিতা। সে সব কবিতা একত্রিত করে পরে বই হয়েছে, ‘স্মরণ’।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: প্রাক-কথন

রবীন্দ্রনাথ ভেতরে ভেতরে কতখানি ভেঙে পড়েছিলেন, তার খণ্ডচিত্র ধরা আছে রথীন্দ্রনাথের লেখায়। কবিপুত্র লিখেছেন, ‘বাবা সকলের সঙ্গেই শান্তভাবে অসম্ভব ধৈর্যের সঙ্গে কথা বলে গেলেন, কিন্তু কি কষ্টে যে আত্মসংবরণ করে তিনি ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারছিলুম।’ লোকজন চলে যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ডেকেছিলেন রথীন্দ্রনাথকে। কিশোর-পুত্রের হাতে তাঁর মায়ের সব সময় ব্যবহার করা চটিজুতো দিয়ে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এটা তোর কাছে রেখে দিস্, তোকে দিলুম।’

সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে মৃণালিনী।

কেন অকালে অসময় মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। নানাজনের স্মৃতিচর্চায় নানারকম কথা আছে। একটার সঙ্গে আর একটাকে ঠিক মেলানো যায় না। মৃণালিনী দেবী আশ্রম-পড়ুয়াদের নিজের সন্তানের থেকে কম ভালোবাসতেন না। আশ্রমে আবাসিক ছাত্র কম ছিল না। তাদের জন্য রান্না করতেন মৃণালিনী নিজে। এতজনের রান্না করতে কম ধকল হত না। পর্যাপ্ত বড় রান্নাঘর নয়। উনুনের তাপে গরমকালে প্রচণ্ড কষ্ট হত। ঘেমেনেয়ে একশা। অতিরিক্ত গরম, অনর্গল ঘাম। এর ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। মৃণালিনীর তেমনই হয়েছিল। ইন্দিরা দেবীর লেখায় আছে, ‘শান্তিনিকেতনে থাকার সময় আশ্রমের ছেলেদের জন্য আগুন-তাতে রেঁধে-রেঁখেই কাকিমার শেষ অসুখের সূত্রপাত হয়।’
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

ইন্দিরা দেবী অসুস্থ হওয়ার যে কারণ বলেছেন, তাতে জীবনহানি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হেমলতা দেবী, দ্বিপেন্দ্রনাথের পত্নী। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি শান্তিনিকেতনেই থাকতেন। হেমলতা রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে এ বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়েছিলেন, মৃণালিনীর মৃত্যুর কারণ বলতে গিয়ে তিনি সেই তথ্য পেশ করেছেন। জানা যায়, ‘অন্তঃসত্ত্বা মৃণালিনী অসতর্ক-মুহূর্তে পড়ে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছিলেন। প্রভাতকুমার লিখেছেন, ‘হেমলতা ঠাকুরের মুখে শুনিয়াছিলাম মৃণালিনী বোলপুরে মুন্সেফবাবুর বাড়িতে বর্ষাকালে কোন নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিলেন। সেখানে পড়িয়া যান ও আঘাত পান। তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা।’ রথীন্দ্রনাথ অন্য কথা বলেছেন। ‘পিতৃস্মৃতি’ বইতে তিনি লিখেছেন, ‘তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা।…একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারা রাত জেগে কাটল। ভোরবেলায় অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমি তখনই বুঝতে পারলাম আমার মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

মৃণালিনীর হস্তাক্ষর।

রথীন্দ্রনাথের ধারণা মায়ের অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের অ্যালোপ্যাথির ওপর তেমন ভরসা ছিল না। বিখ্যাত সব হোমিওপ্যাথ ডাক্তার মৃণালিনীর চিকিৎসা করেছিলেন। সেকালের খুব নামি ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ছাড়াও ডিএন রায় বাড়িতে এসে চিকিৎসা করেছেন। হোমিওপ্যাথিক-বায়োকেমিক চিকিৎসায় রবীন্দ্রনাথের প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি নিজেও কখনও ওষুধ দিয়েছেন, আবার কি ওষুধ দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।

মৃণালিনী দেবীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল আটাশ টাকা দু’পয়সা। ঠাকুরবাড়ির ‘ক্যাশবহি’তে আছে সে সাক্ষ্য।

মায়ের শেষযাত্রায় কিশোর রথীন্দ্রনাথ যাননি। পুত্রের হাতের আগুন পাননি মৃণালিনী। শোকস্তব্ধ রবীন্দ্রনাথও যাননি। শোকযন্ত্রণার মধ্যে কবি টানা ক-দিন বাড়িতেই ছিলেন। পাঁচ দিন পর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গিয়েছিলেন প্রিয়-বান্ধব আচার্য জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে, পার্শিবাগানে।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content