রবীন্দ্রনাথ ও রাণু।
প্রথমদিকে তাঁকে লেখা চিঠির শেষে স্বাক্ষর থাকত ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। যাঁকে চিঠি লেখা, সেই রাণুর ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন ‘ভানুদাদা’। ছোটদের সঙ্গে ছোটো হয়ে মিশতে হয়। রাণু তখন আট বছর দশ মাসের বালিকা। রবীন্দ্রনাথ বয়সের বিচারে প্রায় প্রৌঢ়, কবির বয়েস ছাপান্ন। খ্যাতির শীর্ষে তাঁর অবস্থান। অথচ কত সহজভাবে ওই বালিকার সঙ্গে মিশেছেন কবি। স্নেহময়-প্রীতিময় সখ্য গড়ে উঠেছে। রাণুর চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আচ্ছা বেশ, রাজি। ভানুদাদা নামই বহাল হল। এ নামে আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ ডাকেনি, আর কেউ যদি ডাকে তবে তার উত্তর দেব না।’
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন ফণিভূষণ অধিকারী। তাঁরই কন্যা রাণু। ফণিভূষণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনেকদিনের যোগাযোগ। তিনি শান্তিনিকেতনেও এসেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথও গিয়েছেন বেনারসে। কবি গিয়েছিলেন বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে। ছিলেন প্রিয়জন ফণিভূষণের বাড়িতে।
বেনারসে নয়, রাণুর সঙ্গে কবির প্রথম দেখা কলকাতায়, ল্যান্সডাউন রোডের এক বাড়িতে। ফণিভূষণ কলকাতায় এসে উঠেছিলেন সেই বাড়িতে। রাণুর স্মৃতিচারণে আছে, ‘কবিকে সেই দেখা প্রথম।’ রবীন্দ্রনাথ তখন কন্যা-বিয়োগ-বেদনায় বিধ্বস্ত। কন্যার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিষ্পন্ন করে মানসিক-আশ্রয় খুঁজতেই গিয়েছিলেন রাণুর কাছে।
বেনারসে নয়, রাণুর সঙ্গে কবির প্রথম দেখা কলকাতায়, ল্যান্সডাউন রোডের এক বাড়িতে। ফণিভূষণ কলকাতায় এসে উঠেছিলেন সেই বাড়িতে। রাণুর স্মৃতিচারণে আছে, ‘কবিকে সেই দেখা প্রথম।’ রবীন্দ্রনাথ তখন কন্যা-বিয়োগ-বেদনায় বিধ্বস্ত। কন্যার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিষ্পন্ন করে মানসিক-আশ্রয় খুঁজতেই গিয়েছিলেন রাণুর কাছে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
ভানুর সঙ্গে রাণুর পত্র-বিনিময় কম হয়নি। দুই অসমবয়েসির পত্রমিতালি পরে আর পত্র-বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়েছিল। রাণু রবীন্দ্র-পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। জগদ্বিখ্যাত কবিকে শাসন করতেও দ্বিধা করেননি। স্নেহ বিষম বস্তু। রবীন্দ্রনাথের স্নেহময়তা রাণুর জীবন ভরিয়ে তুলেছিল। তাঁর বেড়ে ওঠার দিনগুলি বর্ণময় হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্র-পরিবারের অন্যান্যদেরও ভালোবাসা পেয়েছেন, স্নেহ পেয়েছেন।
মীরা।
রাণু কবির ভ্রমণসঙ্গী হয়েও গিয়েছিলেন শিলং-পাহাড়ে। সঙ্গে কবির পরিবারের অন্যরাও ছিলেন। কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ছাড়াও কন্যা মীরা, মীরা-নগেন্দ্রনাথের কন্যা কবির আদরের দৌহিত্রী নন্দিতাও ছিলেন সেই আনন্দ-সফরে। রাণুর প্রাণময় উপস্থিতিতে সে সফরে যে বাড়তি আনন্দ যুক্ত হয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শিলঙে বসে রবীন্দ্রনাথ একটি নাটক লিখেছিলেন। সে নাটকের নাম ‘যক্ষপুরী’, পরে নাম পরিবর্তিত হয়, ‘রক্তকরবী’। এ নাটকের মূল চরিত্র ‘নন্দিনী’। রবীন্দ্রনাথ রাণুকে বলেছিলেন, ‘নন্দিনী তুই।’ রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ হবে, নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করবেন রাণু অধিকারী। নাট্যকারের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়নি। তখন রানুর বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কিছুদিন পরেই তাঁর বিবাহ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়। বিবাহ হয়েছিল শিল্পপতি স্যার বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সঙ্গে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?
নীতীন্দ্রনাথকে লেখা মীরা দেবীর চিঠি থেকে জানা যায়, পাত্র-পক্ষ আশীর্বাদে রাণুকে দু-হাজার টাকা দামের নেকলেস দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কী দিয়েছিলেন, তা আমাদের মনে কৌতূহল জাগ্রত করে। রাণুর বিবাহে কী দেবেন, তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো ভেবেছেন। স্নেহভাজন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লিখেছিলেন, ‘রাণুর বিবাহে বাংলা বই রাণুকে, ইংরেজি বই বীরেনকে দেওয়া ভালো।… দুটো আলাদা সেট করে দু-জনকে দিতে ইচ্ছা করি।’ কবি অনুমান করেছিলেন তাঁর লেখা কবিতা-গল্প-উপন্যাসের বইগুলির তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হবে স্বরলিপির বইগুলি। প্রশান্তচন্দ্রকে তিনি লিখেছিলেন, ‘গানের স্বরলিপিগুলো উপহারের মধ্যে ধরে দিয়ো — কেন না যদি কোনোটার কিছুমাত্র ব্যবহার হয় ঐটেরই হবে।’
প্রতিমা।
বীরেন্দ্রনাথকে বাংলা নয়, ইংরেজি বই দেওয়ার পরিকল্পনাটি যে যথেষ্ট যুক্তিনিষ্ঠ হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শুধু নয়, কেমব্রিজের ট্রেনিটি কলেজেও পড়াশোনা করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ এই ভাবেই কন্যা মাধুরীলতার বিবাহে অনেক অনেক যৌতুকের সঙ্গে নিজের লেখা এক আলমারি বইও দিয়েছিলেন। দেওয়া বইতে কবি স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন।
রাণুকে কী বই দেবেন, কীভাবে দেবেন, তা নিয়েও রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অন্ত ছিল না। রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘ভাবছি ওকে যে বইগুলো দেব তার একটা ভালো আধার দিতে পারলে চোখ-ভরা গোছের চেহারা হত। বৌমার সঙ্গে পরামর্শ করে একটু ভেবে দেখিস।… বাংলা পদ্যগ্রন্থাবলীর মোটা কাগজের সংস্করণটাই যেন দেওয়া হয় — স্বরলিপি ও অন্যান্য সমস্ত ছোট বড় বই দিয়ে বোঝা ভারী করিস। ম্যাকমিলনের সংস্করণ সমস্ত ইংরেজি বইও দিতে হবে — সেগুলো হয়তো বিশেষ করে না বাঁধলেও ক্ষতি হবে না। বাঁধাইয়ের কাপড় তোরাই পছন্দ করে দিস…।’
রাণুকে কী বই দেবেন, কীভাবে দেবেন, তা নিয়েও রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অন্ত ছিল না। রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘ভাবছি ওকে যে বইগুলো দেব তার একটা ভালো আধার দিতে পারলে চোখ-ভরা গোছের চেহারা হত। বৌমার সঙ্গে পরামর্শ করে একটু ভেবে দেখিস।… বাংলা পদ্যগ্রন্থাবলীর মোটা কাগজের সংস্করণটাই যেন দেওয়া হয় — স্বরলিপি ও অন্যান্য সমস্ত ছোট বড় বই দিয়ে বোঝা ভারী করিস। ম্যাকমিলনের সংস্করণ সমস্ত ইংরেজি বইও দিতে হবে — সেগুলো হয়তো বিশেষ করে না বাঁধলেও ক্ষতি হবে না। বাঁধাইয়ের কাপড় তোরাই পছন্দ করে দিস…।’
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
ইন্দিরা দেবীর ‘রোজনামচা’য় আছে বিবাহদিবসের বর্ণনা। জানা যায়, ‘রাণুর বিয়েতে নিমন্ত্রিত,অতিথি, সহকারী কর্মকর্তা, সবাই বলতে গেলে জোড়াসাঁকোর। সুবীর কদিনই দৌড়োদৌড়ি করে খুব খেটেছে, পরিবেশন করেছে, সাজিয়েছে, ইত্যাদি।’ সুবীর ইন্দিরা-অগ্ৰজ সুরেন্দ্রনাথের পুত্র। সুবীরের এই সক্রিয় ভূমিকার কথা জানিয়েই থামেননি ইন্দিরা, জানিয়েছেন তাঁর ‘রবিকা’র কথা। ইন্দিরার রোজনামচা থেকে জানা যায়, ‘রবি’কা তাঁর সব গ্রন্থাবলী একই ধরনে বেশ সুন্দর বাঁধিয়ে সব বইয়ের ভিতরে সহস্তে আশীর্বাদ লিখে একটা কাঁচের আলমারিসহ রাণুকে উপহার দিয়েছেন।’
স্নেহের রাণুর বিবাহ ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ভিতরে ভিতরে খুবই বিচলিত হয়েছিলেন। চিন্তা-দুশ্চিন্তায় জেরবার হচ্ছিলেন। রাণুর বিবাহে কবির উপস্থিত থাকতে সুবিধা হবে, স্থানগত দূরত্ব কমবে, অনায়াসসাধ্য হয়ে উঠবে, এ সব ভেবে ইন্দিরা কবিকে তাঁদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। ‘রোজনামচা’য় ইন্দিরা লিখেছেন, ‘এই বিয়েবাড়ি যাবারই সুবিধা হবে বলে আর আমাদেরও ঘর পড়ে আছে, এলে খুশি হব বলে, তাঁকে সেই সময়ে দু-চার দিন আমাদের এখানে এসে থাকতে অনুরোধ করলুম।’
স্নেহের রাণুর বিবাহ ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ভিতরে ভিতরে খুবই বিচলিত হয়েছিলেন। চিন্তা-দুশ্চিন্তায় জেরবার হচ্ছিলেন। রাণুর বিবাহে কবির উপস্থিত থাকতে সুবিধা হবে, স্থানগত দূরত্ব কমবে, অনায়াসসাধ্য হয়ে উঠবে, এ সব ভেবে ইন্দিরা কবিকে তাঁদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। ‘রোজনামচা’য় ইন্দিরা লিখেছেন, ‘এই বিয়েবাড়ি যাবারই সুবিধা হবে বলে আর আমাদেরও ঘর পড়ে আছে, এলে খুশি হব বলে, তাঁকে সেই সময়ে দু-চার দিন আমাদের এখানে এসে থাকতে অনুরোধ করলুম।’
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
কবি এলেন বটে, কিন্তু দু-দিন কাটতে না কাটতেই তাঁর মধ্যে অস্থিরতা প্রবল হয়ে ওঠে। কবির এই অস্থিরতা রাণুর প্রতি প্রবল স্নেহেরই ভিন্নতর প্রকাশ। ইন্দিরা লিখেছেন, ‘তাঁকে ছোট বাড়িতে এক ঘর গুছিয়ে দিয়ে আমাদের ঘর রবিকা’কে ছেড়ে দিয়ে, আমরা তার পাশের ঘরে উঠে গিয়ে তো অনেক হেরফের করে অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা হল। কিন্তু প্রধান অতিথি কায়ক্লেশে বৃহস্পতি শুক্র দুদিন থেকে শনিবার সকালে একটু বেলা হতেই বাড়ি যাবার জন্য এত অস্থির কেন যে হয়ে পড়লেন…!’
কেন এত বিচলিত হচ্ছেন, জোড়াসাঁকোয় ফিরে যেতে চাইছেন, ইন্দিরার চোখে মুখে সে জিজ্ঞাসা। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, সেখানে বসে একটি চিঠি পর্যন্ত লিখতে পারছেন না তিনি। রথীন্দ্রনাথকে কয়েকটি জরুরি চিঠি লেখার দায়িত্ব দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে লেখা হচ্ছে কিনা, তাও বুঝতে পারছেন না।
কেন এত বিচলিত হচ্ছেন, জোড়াসাঁকোয় ফিরে যেতে চাইছেন, ইন্দিরার চোখে মুখে সে জিজ্ঞাসা। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, সেখানে বসে একটি চিঠি পর্যন্ত লিখতে পারছেন না তিনি। রথীন্দ্রনাথকে কয়েকটি জরুরি চিঠি লেখার দায়িত্ব দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে লেখা হচ্ছে কিনা, তাও বুঝতে পারছেন না।
নন্দিনী।
ইন্দিরা কবির এই অস্থিরতা নিয়ে ভাবনায় পড়েছিলেন। কেন তিনি এতখানি উতলা ও বিচলিত হয়েছিলেন, অচিরেই তা স্পষ্ট হয়েছে। আসলে রাণুকে যা দেবেন, তা কখন, কীভাবে পাঠানো হবে — জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কবি। জোড়াসাঁকো থেকে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে কিনা, সেই ভাবনা-দুর্ভাবনা মনের কোণে জাঁকিয়ে বসেছিল। সেদিন আবার সাইক্লোনের আগাম বার্তা ছিল। সে কারণেই কবি বেশি রকমের বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। বিচলিত হয়ে বাড়ি ফিরে একটুও কালক্ষয় করেননি, তখনই গাড়ি করে রাণুর বিবাহ-উপহার এক আলমারি বই পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।