সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।

ঠাকুরবাড়িতে রূপবতী নারী ছিল। ছিল রূপবান পুরুষও। রবীন্দ্রনাথও কম রূপবান ছিলেন না। বালক-বয়সে মাতা সারদাসুন্দরী যে ভাবে তাঁর রূপ-পরিচর্যা করতেন, তা অভাবনীয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, লাবণ্যময় সে রূপ-মাধুর্য ধরা আছে নানাজনের স্মৃতিচর্চায়। রূপের খ্যাতি সবথেকে বেশি কার — এ প্রশ্নের উত্তরে যে নামটি বলতে হবে, সে নাম আজ আর তত পরিচিত নয়। ঠাকুরবাড়ির তিনি বিস্মৃত ব্যক্তিত্ব, নগেন্দ্রনাথ।
দ্বারকানাথের কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত রূপবান। ঠাকুরবাড়ির পুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন রূপ-শ্রেষ্ঠ। বিভিন্নজনের স্মৃতিচর্চায় আছে সে রূপ-মুগ্ধতার কথা। নগেন্দ্রনাথের মাতা দিগম্বরী দেবী ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। দেখে মনে হত মানবী নন, দেবী; প্রতিমা যেন। ঠাকুরবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোয় কুমোর মূর্তি বানাতেন তাঁর মুখের আদলে। মায়ের রূপ—ঐতিহ্য নগেন্দ্রনাথ বহন করেছিলেন। শোনা যায়, তিনি স্নান করার জন্য পুকুরে নামলে মনে হত, একটি পদ্ম-ফুল ফুটেছে বুঝি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল

সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর ছোটকাকা নগেন্দ্রনাথ সম্পর্কে ‘আমার বাল্যকথা’য় লিখেছেন, তাঁর রূপ-লাবণ্যের দরুন তিনি সাহেব বিবিদের, বিশেষত বিবিদের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন, প্রবাস থেকে স্বদেশে সহজে ফিরতে চাইতেন না।’ যাঁর সঙ্গে পরবর্তীকালে নগেন্দ্রনাথের বিবাহ-বন্ধন হয়, তিনি ত্রিপুরাসুন্দরী। ত্রিপুরাসুন্দরী গগনেন্দ্র-কন্যা পূর্ণিমাকে বলেছিলেন, ‘জানিস নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতে গিয়ে মেম রেখেছিলেন। দেশে আসতে চাইতেন না। তখন শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন না। তাই আমার বড় জা ঠিক করলেন, দেওর বখে যাচ্ছে, তাই বিয়ে দেওয়া দরকার।’ অবনীন্দ্রনাথও জানিয়েছেন তিনি ‘অতি সুন্দর’ ছিলেন।

প্রিন্স দ্বারকানাথ।

দ্বারকানাথের পাঁচ পুত্র। দ্বিতীয়বার বিলেত যাবার সময় তিনি অন্য পুত্রদের না নিয়ে এই কনিষ্ঠ পুত্রটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। নগেন্দ্রনাথের বিদ্যানুরাগ দ্বারকানাথকে আকৃষ্ট করেছিল। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার অধিকারী পুত্রটিকে তিনি বিলেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির জামাতা কৃষ্ণ কৃপালনীর লেখা, যে লেখার অনুবাদ করেছিলেন আশ্রমিক ক্ষিতীশ রায়, সে লেখা থেকে জানা যায়, দ্বারকানাথ তাঁর পুত্রকে ‘এমনভাবে শিক্ষাদীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে সে সম্ভ্রান্ত ইংরেজ সন্তানের মতো বড় হয়ে উঠতে পারে।’ জানা যায়, ‘নগেন্দ্র তখন নিয়মিত অশ্বপৃষ্ঠে হাইড পার্কে বেড়াতে যান, অভিজাতবংশীয় ইংরেজ তরুণের সব রকম কায়দাকানুন ও সহবৎ তাঁর তখন নখাগ্ৰে।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৪: অপরাজিতা রাধারাণী

বিলেতে নগেন্দ্রনাথের অনুরাগিনীর সংখ্যা কম ছিল না। ফ্যানি স্মিথ নামের এক মহিলার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়েছিল। পিতৃদেবের আকস্মিক প্রয়াণে সব এলোমেলো হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়।

ও দেশ ছেড়ে নগেন্দ্রনাথ এ দেশে ফিরে আসতে চাননি। ষোলো বছর বয়সে বিলেতে গিয়েছিলেন তিনি। তখন তো গড়ে ওঠার সময়। নিজেকে ও দেশের মতো করেই গড়ে তুলেছিলেন। গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর পিতৃদেবের সমর্থন শুধু নয়, সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পিতৃদেবের উচ্চপদস্থ সাহেববন্ধুরাও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। পরে পরিস্থিতি অন্য দিকে বাঁক নেয়। দ্বারকানাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন, শেষে ও দেশেই মারা যান। ও দেশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ।

দ্বারকানাথের মৃত্যু নগেন্দ্রনাথের জীবনটিকে এলোমেলো করে দেয়। স্বপ্নভঙ্গ হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেশে ফিরে এসেছিলেন। কত আনন্দময় স্মৃতি রয়ে যায় সাগরপারে। ফ্যানি স্মিথ নামের এক তরুণীর সঙ্গে ভালোবাসাময় সখ্য তৈরি হয়। দু’জনে নির্জনে বাগানে বসে শেক্সপিয়ার পড়তেন, বায়রন পড়তেন। সে সব লেখা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলায় কিংবা সংস্কৃতে অনুবাদ করেও স্মিথকে শোনাতেন। স্মিথ শুধু সাহিত্যমনস্ক ছিলেন না, ভালো ছবিও আঁকতেন। নগেন্দ্রনাথকে তাঁর একটি প্রতিকৃতি এঁকে দিয়েছিলেন। পরিস্থিতির চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে দেশে ফিরতে হয়। ফেরার আগে গিয়েছিলেন ভালোবাসার জন স্মিথের কাছে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন নানা উপহার। কিছুই তিনি গ্রহণ করেননি। নগেন্দ্রনাথের গায়ের শালটি শুধু চেয়ে নিয়েছিলেন। নগেন্দ্রনাথ তাঁকে লেখা স্মিথের সব চিঠি সঙ্গে এনেছিলেন। জীবনভর পরম যত্নে বুকে আঁকড়ে রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?

স্বদেশে ফেরার পর অগ্রজ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্নী সারদাসুন্দরী নগেন্দ্রনাথের বিবাহ দিয়েছিলেন। বিবাহ হয়েছিল ত্রিপুরাসুন্দরীর সঙ্গে। যশোর থেকে অনেকেই বধূ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে এসেছেন। ত্রিপুরাসুন্দরী ছিলেন যশোরের মেয়ে। সারদাসুন্দরী নিজেও যশোর থেকে এসেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। নগেন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরাসুন্দরী ছিলেন নিঃসন্তান। নগেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে জোড়াসাঁকো-বাড়ির সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর ভাইদের সঙ্গে অন্যত্র বসবাস করতেন।

দ্বারকানাথের চিঠি।

নগেন্দ্রনাথ ও দেশে যেভাবে জীবন শুরু করেছিলেন, সেই আনন্দময় নানারঙের দিনগুলি আর এ দেশে ফিরে আসেনি। প্রতিদিনই ছ’নম্বর বাড়ির একতলায় তিনি সুরাপাত্র নিয়ে বসতেন। মদ্যপান করতেন। কেউ হয়তো তিনতলায় মহর্ষিদেবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। তাঁকে ডাকতেন। ডেকে বলতেন, ‘ওহে শোনো শোনো। কোথায় চললে? বড়দার কাছে?’ আগন্তুক হয়তো ঘাড় নাড়ালেন, নগেন্দ্রনাথ তখন বলতেন, ‘একপাত্র খেয়ে যাও। বড়দার সঙ্গে গুরুগম্ভীর আলোচনা জমবে ভালো।’ যার উদ্দেশে বলা, তিনি প্রায়শই জিভ কাটতেন, মুখ কাঁচুমাচু করতেন। গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইতে আছে এ তথ্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১২: ‘মিসা’ বন্দি সম্পাদকের চিঠি

রূপবান নগেন্দ্রনাথকে কঠিন বাস্তবের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছে। হারানো দিনগুলির পুরোনো স্মৃতি তাঁকে কুরে কুরে খেত। হয়তো সে কারণই অত্যধিক সুরাপান করতেন। মানুষটি অবশ্য ছিলেন অতীব চমৎকার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে, ‘তাহার হৃদয় অতিশয় কোমল এবং পরদুঃখ-কাতর ছিল। কেহ কোনও বিপদে পড়িলে অথবা ঋণজালে জড়িত হইলে তিনি তাহাকে মুক্ত করিতে ব্যস্ত হইতেন। এই পরোপচিকীর্ষায় তিনি একেবারে জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িতেন। নিজে ঋণ করিয়াও অপরকে ঋণ মুক্ত করিতেন।’

নগেন্দ্রনাথ।

এমন ঔদার্যের নজির নগেন্দ্রনাথ দৈনন্দিন জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বারবার রেখেছেন। সাহেব-দেশে আনন্দে কাটিয়েছিলেন, ইংরেজি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তারপরও তিনি সাহেব হয়ে যাননি। অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিচর্চায় তাঁর ফিরে আসা নিয়ে জোড়াসাঁকোয় কতখানি কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল, রয়েছে তার বিবরণ। যতই বিদেশে থাকুন না কেন, বাঙালিত্ব বিসর্জন দেননি। বাঙালিয়ানাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে আছে, ‘কী সম্মান সেখানে তাঁর। তিনি ফিরে আসছেন দেশে। ছোটদাদামশায় সাহেব হয়ে ফিরে আসছেন — কীভাবে জাহাজ থেকে নামেন সাহেবি সুট পরে, বন্ধু-বান্ধব সকলেই গেছেন গঙ্গার ঘাটে তাই দেখতে।’ অচিরেই মোহভঙ্গ হয় তাদের। বিলেতে বাস করেও তিনি সাহেবিয়ানাকে অনুকরণ করেননি। মনে-প্রাণে ‘বাঙালি’ থেকে গিয়েছিলেন। তাঁর আগমনের দিনে যথেষ্ট ভিড় হয়েছিল। নগেন্দ্রনাথ কী পোশাকে নামবেন, তা নিয়ে মানুষজনের কৌতূহলের অন্ত ছিল না। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘ধুতি পাঞ্জাবি চাদর গায়ে, পায়ে জরির লপেটা। ছোট দাদামশায় জাহাজ থেকে নামলেন। সবাই তো অবাক।’

নগেন্দ্রনাথের জীবনযাপনে ছিল চূড়ান্ত আভিজাত্য। কিন্তু সাহেব-দেশ থেকে জাহাজে করে এলেও সাহেব-বেশ পরেননি। এটা কম বড় কথা নয়।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content