গগনেন্দ্রনাথ।
গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ বা সমরেন্দ্রনাথ —না, কারও বিয়েতেই তেমন ধুমধাম হয়নি, জাঁকজমকের সামান্যও চিহ্ন ছিল না। আর্থিক দৈন্যে কোনওরকমে নমো-নমো করে হয়েছিল বিবাহ-অনুষ্ঠান।
অকালে মারা গিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথের পিতা গুণেন্দ্রনাথ। পিসেমশায় তাঁদের শুধু নয়, দেখাশোনা করতেন জমিদারিও। টাকা ছিল না বিলাসিতা করার মতো, মানসিকতাও ছিল না। ফলে গুণেন্দ্র-পুত্রদের বিবাহে তেমন আড়ম্বর হয়নি।
গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন গুণেন্দ্রনাথ ও সৌদামিনী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। বড় শিল্পী, তিনি কিউবিজমের প্রতিষ্ঠাতা। জলরঙে, তেলরঙে, আঁকা তাঁর ছবি, কার্টুনের খ্যাতি দেশান্তরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ ছিল। নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পাশাপাশি পরিশ্রম করতে হয়েছে প্রভূত। পাশাপাশি পারিবারিক দায়িত্ব পালন। বড় সংসার। পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা। শেষের সন্তানটি অবশ্য স্বল্পায়ু, শিশু-বয়েসেই মারা গিয়েছিল।
অকালে মারা গিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথের পিতা গুণেন্দ্রনাথ। পিসেমশায় তাঁদের শুধু নয়, দেখাশোনা করতেন জমিদারিও। টাকা ছিল না বিলাসিতা করার মতো, মানসিকতাও ছিল না। ফলে গুণেন্দ্র-পুত্রদের বিবাহে তেমন আড়ম্বর হয়নি।
গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন গুণেন্দ্রনাথ ও সৌদামিনী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। বড় শিল্পী, তিনি কিউবিজমের প্রতিষ্ঠাতা। জলরঙে, তেলরঙে, আঁকা তাঁর ছবি, কার্টুনের খ্যাতি দেশান্তরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ ছিল। নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পাশাপাশি পরিশ্রম করতে হয়েছে প্রভূত। পাশাপাশি পারিবারিক দায়িত্ব পালন। বড় সংসার। পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা। শেষের সন্তানটি অবশ্য স্বল্পায়ু, শিশু-বয়েসেই মারা গিয়েছিল।
গগনেন্দ্রনাথ গোপন ইচ্ছে চরিতার্থ করেছিলেন বড় ছেলের বিয়েতে। বিস্তর খরচ করেছিলেন। এলাহি আয়োজন। এই জাঁকজমক করেছিলেন মা সৌদামিনীর অনুমতি নিয়ে। মা জানিয়েছিলেন সম্মত তিনি। মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে যে বইটি লিখেছিলেন, সে বইতে আছে সৌদামিনী দেবী বলেছিলেন, ‘তোদের বিয়ে আমি দিয়েছি তাই খরচ করিনি। এখন তোর ছেলের তুই বিয়ে দিবি তোর বড়ো ছেলে — নিশ্চয়ই খরচ করবি। তা না হলে কি ভালো দেখায়?’
গগনেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘গুপু’ নামে যিনি পরিচিত, যাঁর আসল নাম গেহেন্দ্রনাথ, তাঁর বিয়েতে বিপুল আড়ম্বর হয়েছিল। গেহেন্দ্র-পত্নীর নাম ছিল মৃণালিনী। রবীন্দ্র-পত্নীর নামে নাম। তবে রবীন্দ্র-পত্নীর ‘মৃণালিনী’ নামটি কবিরই দেওয়া। আসল নাম ছিল ‘ভবতারিণী’।
গগনেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘গুপু’ নামে যিনি পরিচিত, যাঁর আসল নাম গেহেন্দ্রনাথ, তাঁর বিয়েতে বিপুল আড়ম্বর হয়েছিল। গেহেন্দ্র-পত্নীর নাম ছিল মৃণালিনী। রবীন্দ্র-পত্নীর নামে নাম। তবে রবীন্দ্র-পত্নীর ‘মৃণালিনী’ নামটি কবিরই দেওয়া। আসল নাম ছিল ‘ভবতারিণী’।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল
গগনেন্দ্র-পুত্র গেহেন্দ্রনাথের বিয়েতে যে খরচ হয়েছিল, তেমন খরচ ঠাকুরবাড়িতে অন্য কোনও বিয়েতে হয়নি। গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন তাঁর কন্যা পূর্ণিমা। পূর্ণিমা দেবীর ‘ঠাকুরবাড়ির গগনঠাকুর’ বইতে আছে এ বিয়ের বিশদ বর্ণনা। বইয়ের পাতা থেকে একটু তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘মেয়েমহলে খেমটা নাচ, গান সন্ধ্যা থেকেই শুরু হল। পুরুষমহলের আগে খাওয়া হয়ে গেলে রাত আটটা থেকে বাইনাচ শুরু হয়। দুজন বাইজি আসে, শ্রীজান ও গহরজান, কলকাতার নাম করা বাইজি। রাত দুটো অবধি নাচগান চলে। বড় বড় ওস্তাদ রাজা মহারাজা তখনকার দিনের বড় বড় সমঝদার সব বসে।…মাঝে মাঝে গোলাপজল ছিটিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। আর বড় পাখা চালাচ্ছে। কেউ কেউ পান জল সরবরাহ করছে, তামাক বদলে দিচ্ছে।’
অবনীন্দ্রনাথ।
ঠাকুরবাড়িতে সেই প্রথম বাইজি এলো, তা নয়। আগেও এসেছে। প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর বাণিজ্য-সাফল্য ও সাহেবসুবোদের মনোরঞ্জনের কথা ভেবে বাইনাচের ব্যবস্থা করেছেন। সে আয়োজন অবশ্য জোড়াসাঁকো হয়নি, হয়েছে বেলগাছিয়ায়। অবনীন্দ্রনাথের ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’তেও আছে দোলের দিন ‘নাচিয়ে’ এসে কীভাবে নৃত্য পরিবেশন করত। বাবামশায় সামনেই বসে থাকতেন, নাচের তালে তালে পায়ের আঙুল দিয়ে চাদরের নিচের আবির সরিয়ে আলপনা কাটা হয়ে যেত।
গগনেন্দ্র-পুত্রের বিয়েতে বাইনাচ হয়েছিল। গানের সুরে আত্মহারা হয়ে দেদার মদ্যপান হয়নি। পূর্ণিমা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, ‘বাবা-কাকারা নিজেরা মদ খেতেন না বলে কাউকে দিতেনও না। যদি সে রকম কেউ আসত, বাবার মন্নু বেহারার কাছে তোলা থাকত। বাবা বললে তবেই বের হত।’
গগনেন্দ্র-পুত্রের বিয়েতে বাইনাচ হয়েছিল। গানের সুরে আত্মহারা হয়ে দেদার মদ্যপান হয়নি। পূর্ণিমা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, ‘বাবা-কাকারা নিজেরা মদ খেতেন না বলে কাউকে দিতেনও না। যদি সে রকম কেউ আসত, বাবার মন্নু বেহারার কাছে তোলা থাকত। বাবা বললে তবেই বের হত।’
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা
বাইজি গহরজান বৈঠকখানায় গান গেয়ে, গান শোনাতে গিয়েছিল পূর্ণিমার দিদিমাকে। দিদিমা সৌদামিনী দেবীকে গহরজানবাই শুনিয়েছিলেন, ‘হরিনাম মহামন্ত্র হৃদয়ে জপ রসনা’। শুনে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন, উপহারও দিয়েছিলেন তাকে।
গহরজানের গান শুধু সৌদামিনী দেবীকে নয়, সেকালে কাকে না মুগ্ধ করেছে! উনিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতার প্রসিদ্ধ বাইজি। তার নৃত্যগীতি দেখার জন্য ধনীসমাজ আকুল হয়ে থাকত।
গহরজানের গান শুধু সৌদামিনী দেবীকে নয়, সেকালে কাকে না মুগ্ধ করেছে! উনিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতার প্রসিদ্ধ বাইজি। তার নৃত্যগীতি দেখার জন্য ধনীসমাজ আকুল হয়ে থাকত।
গহরজান-বাই।
গহরজান ছিলেন ইহুদিকন্যা। নৃত্যগীতি পরিবেশন করে বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন। খেয়াল- টপ্পা-ঠুংরিতে অসামান্য দখল ছিল তাঁর। গহরজানের বিলাসি-জীবন নিয়ে নানা গল্পকথা শোনা যায়, এমনও শোনা যায়, গহরজান এক গয়না দু-বার ব্যবহার করতেন না। রোজ বিকেলে টমটমে চড়ে নিজের হাতে বর্মী-টাট্টু হাঁকিয়ে ময়দানে হাওয়া খেতে যেতেন। তার কয়েকটি রেকর্ডও আছে। রবীন্দ্রনাথের দুটি গানও রেকর্ড করেছিলেন। জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়িতে, আনন্দ-উৎসবে তার ডাক পড়ত নিয়মিত। ডাক পড়ত গগনেন্দ্র-পুত্রের বিবাহে আসা শ্রীজান বাইজিরও। বিলাসবৈভবে একদা দিন কাটানো এই বাইজিদের শেষ-জীবন প্রায়শই দুঃখময় হয়ে উঠত। অবনীন্দ্রনাথ নাননিবাই নামে এক লখনৌর বাইজিকে জানতেন। যে যৌবনকালে রুপোর খাটে শুতো। শেষজীবনে বড়ই করুণ অবস্থা হয়েছিল তার। পথে ঘুরে ঘুরে গান শুনিয়ে দু-পয়সা রোজগার করত।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?
শ্রীজান বাইজির সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি ধরা আছে অবনীন্দ্রনাথের লেখায়। শ্রীজান তখন বুড়ো হয়েছে, অথচ চমৎকার গলা। অবনীন্দ্রনাথের মা তার কাছে গান শুনতে চেয়েছিলেন। শুনতে চাওয়ায় শ্রীজান বলেছিল, ‘আর কি এখন তেমন গাইতে পারি?’
যতই দ্বিধা দেখাক না কেন, শ্রীজানের গানের ব্যবস্থা হয়েছিল জোড়াসাঁকোয়, মূলত অবনীন্দ্রনাথের আগ্রহে। সারারাতব্যাপী গানের জলসা। ডাকা হয়েছিল বন্ধু-বান্ধবদের। শ্রীজান গাইতে শুরু করা মাত্র সবার চোখে মুখে মুগ্ধতা ফুটে ওঠে। দেখতে তাকে মোটেই সুন্দর ছিল না। অথচ তার কোকিলকণ্ঠ থেকে সৌন্দর্য ঝরে ঝরে পড়ছিল। উপস্থিত সব শ্রোতাদের রাতভর মুগ্ধ করে রেখেছিল শ্রীজান। সেই গান শোনার আনন্দস্মৃতি অবনীন্দ্রনাথের লেখায় ধরা আছে এ ভাবে, ‘ঘরের দরজাগুলি বন্ধ, চারিদিক নিস্তব্ধ। যে যার জায়গায় আমরা স্থির হয়ে বসে। শ্রীজান ভোরাই ধরলে। গান শেষ হল, ঘরের শেষ বাতিটি নিবে গেল — ঊষার আলো উঁকি দিল নাচঘরের মধ্যে।’
যতই দ্বিধা দেখাক না কেন, শ্রীজানের গানের ব্যবস্থা হয়েছিল জোড়াসাঁকোয়, মূলত অবনীন্দ্রনাথের আগ্রহে। সারারাতব্যাপী গানের জলসা। ডাকা হয়েছিল বন্ধু-বান্ধবদের। শ্রীজান গাইতে শুরু করা মাত্র সবার চোখে মুখে মুগ্ধতা ফুটে ওঠে। দেখতে তাকে মোটেই সুন্দর ছিল না। অথচ তার কোকিলকণ্ঠ থেকে সৌন্দর্য ঝরে ঝরে পড়ছিল। উপস্থিত সব শ্রোতাদের রাতভর মুগ্ধ করে রেখেছিল শ্রীজান। সেই গান শোনার আনন্দস্মৃতি অবনীন্দ্রনাথের লেখায় ধরা আছে এ ভাবে, ‘ঘরের দরজাগুলি বন্ধ, চারিদিক নিস্তব্ধ। যে যার জায়গায় আমরা স্থির হয়ে বসে। শ্রীজান ভোরাই ধরলে। গান শেষ হল, ঘরের শেষ বাতিটি নিবে গেল — ঊষার আলো উঁকি দিল নাচঘরের মধ্যে।’
গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি।
কোথায় কে ভালো গান গায়, তা ছিল অবনীন্দ্রনাথের নখদর্পণে। কোনও গাইয়ে-বাজিয়ে শহরে এলে তাকে বাড়িতে আনার জন্য অবনীন্দ্রনাথ চেষ্টা করতেন। একবার কাশি থেকে এসেছিল সরস্বতীবাই। খুব নামডাক তার। ছ’শো টাকা চেয়েছিল। শেষে রফা হয় তিনশো টাকায়। তিনশো টাকার বিনিময়ে সে গান শুনিয়ে গিয়েছিল জোড়াসাঁকোয়। গান শুনিয়ে সে মুগ্ধ করেছিল সবাইকে। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘সরস্বতীর চমৎকার গলার স্বরে অত বড় নাচঘরটা রমরম করতে থাকল, কী স্বরসাধনাই করেছিল সরস্বতীবাই। আমরা সব কেউ তাকিয়া বুকে, কেউ বুকে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে। এক গানেই আসর মাত। গানের রেশে তখনও সবাই মগ্ন। সরস্বতীবাই বললে, আউর কুছ ফরমাইয়ে।’
নাচ-গানের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল ঠাকুরবাড়িতে। ভালোলাগা, ভালোবাসা ছিল। বাইনাচ-গানের মধ্যে রয়েছে যে ধ্রুপদি-মেজাজ, তা ঠাকুরবাড়িতেও স্বীকৃতি পেয়েছিল।
নাচ-গানের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল ঠাকুরবাড়িতে। ভালোলাগা, ভালোবাসা ছিল। বাইনাচ-গানের মধ্যে রয়েছে যে ধ্রুপদি-মেজাজ, তা ঠাকুরবাড়িতেও স্বীকৃতি পেয়েছিল।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।